প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১১ আগস্ট, ২০২৫
আল্লাহতায়ালা তাঁর বান্দাদের বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করেন, আর ধৈর্যশীলরাই হন সফল। ইসলামের দৃষ্টিতে এই দুনিয়া মুমিনের জন্য পরীক্ষাস্থল। আল্লাহ বলেন, ‘আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা, সম্পদ, প্রাণ ও ফল-ফসলের ক্ষয়ক্ষতি দ্বারা। আর তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও।’ (সুরা বাকারা : ১৫৫)। এ আয়াতটি আমাদের স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয় যে, দুনিয়ার যাবতীয় বিপদ, দুর্ঘটনা ও কষ্ট মূলত আল্লাহর পক্ষ থেকে এক ধরনের পরীক্ষা। মানুষের ধৈর্য, ঈমান ও তাকওয়া এই পরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই করা হয়।
দুর্ঘটনায় ধৈর্য ধারণকারীদের মর্যাদা : দুর্ঘটনা ঘটলে অনেকেই হতাশায় পড়ে যান, কেউ কেউ আল্লাহর প্রতি সন্দেহ পোষণ করেন। কিন্তু একজন মুমিনের উচিত ধৈর্য ধারণ করা এবং আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা রাখা। রাসুল (সা.) বলেন, ‘একজন মুসলমান কোনো কষ্ট, অসুখ, উদ্বেগ, দুঃখ, দুশ্চিন্তা কিংবা বিষণ্ণতায় পতিত হলে, এমনকি তার শরীরে কোনো কাঁটা বিঁধলেও, আল্লাহ তাতে তার গুনাহ মাফ করে দেন।’ (বোখারি : ৫৬৪১)। এই হাদিস প্রমাণ করে, আল্লাহ তাঁর বান্দাকে কোনো দুর্ঘটনার মাধ্যমে কষ্ট দিলেও, এর বিনিময়ে তিনি বান্দার গুনাহ ক্ষমা করে দেন, যা পরকালীন মুক্তির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
নবী-রাসুলরাও পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছেন : পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বিভিন্ন নবীর জীবনে দুর্ঘটনা ও কষ্টের উল্লেখ করেছেন, যা থেকে বোঝা যায় যে, আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাদেরও বিপদে ফেলেন। যেমন ইউসুফ (আ.)-কে তাঁর ভাইয়েরা কূপে ফেলে দেয় এবং পরে দাস হিসেবে বিক্রি করে। আইয়ুব (আ.) দীর্ঘ ১৮ বছর রোগে ভোগেন এবং সব সন্তান ও সম্পদ হারান। মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনে উহুদ যুদ্ধ, তায়েফের ঘটনা, স্ত্রী খাদিজা ও চাচা আবু তালিবের মৃত্যু সবই ছিল কঠিন পরীক্ষা। আল্লাহ বলেন, ‘আপনি কি মনে করেন যে, আপনি ঈমান আনবেন এবং পরীক্ষা করা হবে না?’ (সুরা আনকাবুত : ২)।
দুর্ঘটনার সময় করণীয় : যখন কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, তখন একজন মুসলমানের উচিত এসব বিষয় মেনে চলা- এক. ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন বলা : এ দোয়া পড়া সুন্নত। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে আমরা আল্লাহরই এবং তাঁর কাছেই ফিরে যাব। (সুরা বাকারা : ১৫৬)। দুই. ধৈর্য ধারণ ও সালাত কায়েম : এরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে সাহায্য চাও।’ (সুরা বাকারা : ৪৫)। তিন. আল্লাহর প্রতি আস্থা রাখা : দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ হয়তো আমরা বুঝি না; কিন্তু একজন মুমিন বিশ্বাস করে- আল্লাহর ফয়সালায় কোনো ভুল নেই। সব কিছুতেই কল্যাণ আছে, যা আমরা এখন বুঝি না; কিন্তু ভবিষ্যতে বুঝতে পারি। চার. দোয়া করা : হাদিসে এসেছে, ‘দোয়া ভাগ্যও পরিবর্তন করে দিতে পারে।’ (তিরমিজি)।
দুর্ঘটনা কি শাস্তি নাকি দয়া? : দুর্ঘটনা কখনও শাস্তি হতে পারে, আবার কখনও হতে পারে পরিশুদ্ধির মাধ্যম। যদি কারও গুনাহের কারণে বিপদ আসে, তবে তা শাস্তি। আর যদি কোনো ঈমানদার ব্যক্তি ধৈর্যসহকারে বিপদে থাকে, তবে তা তার জন্য রহমত। রাসুল (সা.) বলেন, ‘মুমিনের অবস্থা আশ্চর্যজনক! তার সব অবস্থাই কল্যাণকর। এটা শুধু মুমিনের জন্যই সম্ভব। যদি সে সুখে থাকে, তবে সে শুকরিয়া আদায় করে, এতে তার জন্য কল্যাণ রয়েছে। আর যদি বিপদে পড়ে, সে ধৈর্য ধারণ করে, তাতেও তার জন্য কল্যাণ রয়েছে।’ (মুসলিম : ২৯৯৯)।
সমাজে দুর্ঘটনার পর করণীয় : দুর্ঘটনা ব্যক্তিগত না থেকে সামাজিক পর্যায়ে চলে গেলে তখন আমাদের করণীয় হলো- ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানো, তাদের জন্য দোয়া করা ও সহযোগিতা করা, সাবধানতা অবলম্বন করা (প্রযুক্তি, সতর্কতা, সড়ক শৃঙ্খলা ইত্যাদি মেনে চলা), তওবা ও ইসতেগফার বৃদ্ধি করা, কারণ সমষ্টিগত গুনাহ আল্লাহর গজব ডেকে আনতে পারে।
দুর্ঘটনা আত্মিক উন্নতির সোপান : দুর্ঘটনা নিঃসন্দেহে এক হৃদয়বিদারক ঘটনা, তবে একজন বিশ্বাসীর জন্য তা হতে পারে আত্মিক উন্নতির সোপান। কোরআন ও হাদিস আমাদের শিক্ষা দেয় যে, আল্লাহ আমাদের পরীক্ষা করেন বিপদাপদ দিয়ে, যাতে আমাদের ঈমান পরীক্ষা হয় এবং আমরা তাঁর দিকে আরও বেশি করে ঝুঁকে পড়ি। পরিশেষে বলাই যায়, দুর্ঘটনা আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি পরীক্ষা। আমাদের উচিত ধৈর্য ধারণ, আত্মসমালোচনা এবং আল্লাহর ওপর নির্ভরতা বৃদ্ধি করা। তাহলে দুনিয়ার এই কঠিন মুহূর্তগুলোও আমাদের জন্য জান্নাতের সোপান হয়ে উঠবে, ইনশাআল্লাহ।
লেখক : আলেম ও মাদ্রাসা শিক্ষক