ঢাকা শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মুহাম্মাদ (সা.)-এর নাম বনাম স্প্রেঙ্গার-আর্মস্ট্রংয়ের ভ্রান্তিবিলাস

মুসা আল হাফিজ
মুহাম্মাদ (সা.)-এর নাম বনাম স্প্রেঙ্গার-আর্মস্ট্রংয়ের ভ্রান্তিবিলাস

প্রাচ্যবিদদের এলাকায় শোনা গেল এক দাবি। তারা মুহাম্মাদ (সা.)-এর নাম নিয়ে নতুন বয়ান হাজির করলেন। বয়ানটি হলো, মুহাম্মাদ নাম আল্লাহর রাসুলের প্রাথমিক নাম ছিল না। মুহাম্মাদ (সা.) নাম এসেছে চারটি সুরায়, আর সেগুলো হচ্ছে- সুরা আলে ইমরান, সুরা আহজাব, সুরা মুহাম্মাদ ও সুরা ফাতাহ। এ চারটি সুরাই মাদানি। অতএব, তারা বলতে থাকলেন, রাসুল (সা.) হিজরতের আগে মুহাম্মাদ নামে পরিচিত ছিলেন না। তার অন্য নাম ছিল!

অস্ট্রিয়ান প্রাচ্যবিদ এলয়স স্প্রেংগার তার ঞযব Life of Muhammad বইয়ে বলেন, রাসুল (সা.)-এর মূল নাম ‘কাসাম’। তিনি মদিনাতেই, বিশেষত খ্রিষ্টানদের সাথে সংস্পর্শের পর মুহাম্মাদ নামে পরিচিত হয়ে উঠেন। আসলেই কি তাই? প্রমাণাদি কী বলে?

আমরা দৃষ্টি দেব নবীজির জন্মেরও আগের সময়ে। সূর্যোদয় আসন্ন। মহাকালের প্রতীক্ষা ভোরের পূর্বমূহূর্তে উপনীত। মানবতার দুঃখ ও দুর্গতির কালোরাত শেষ হতে যাচ্ছে। মুহাম্মাদ (সা.) এখন মাতৃগর্ভে। জননীর স্বপ্নে মহাপুরুষের শুভবার্তা। ইতিহাসের গ্রন্থাবলি তার স্বপ্নভাষ্য বয়ান করেছে।

মা আমেনা বলেন এক আগন্তুকের কথা। যিনি তার নজরে নুরের মতো জ্বলে উঠেন। মহানবী (সা.) তাঁর গর্ভে আগমন করলে অচেনা আগন্তুক বললেন, ‘আপনি যাকে গর্ভে ধারণ করলেন, তিনি মানবজাতির মহানায়ক। তিনি যখন জন্ম নেবেন, তখন বলবেন, ‘সকল হিংসুকের অনিষ্ট থেকে এ শিশুকে এক ও অদ্বিতীয় প্রভুর আশ্রয়ে সমর্পণ করছি। আর তাঁর নাম রাখবেন মুহাম্মাদ (সা.)।

মা আমেনার এই ভাষ্য ইবনে সাদ বর্ণনা করেছেন তার তাবাকাতে, ইয়াজিদ ইবনে আবদুল্লাহর সূত্রে, ইমাম বায়হাকি বর্ণনা করেন মুহাম্মদ ইবনে ইসহাকের সূত্রে। (মুহাম্মাদ বিন ইউসুফ আস সালেহি শামি, সুবুলুল হুদা ওয়ার-রাশাদ, খণ্ড : ১, পৃষ্ঠা : ২৮৬)।

আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, মা আমেনাকে বলা হয়, আপনি সৃষ্টির উত্তম চরিত্রের অধিকারী জাতির নেতাকে গর্ভে ধারণ করেছেন, তাঁর নাম রাখবেন মুহাম্মাদ। (মুহাম্মাদ বিন ইউসুফ আস সালেহি শামি, সুবুলুল হুদা ওয়ার-রাশাদ, খণ্ড : ১, পৃষ্ঠা : ২৮৭)।

আব্দুল মুত্তালিবও দেখলেন স্বপ্ন। বিস্ময়কর স্বপ্নটি তিনি দেখেন নবীজির জন্মের আগে। তিনি দেখলেন, তাঁর পিঠ থেকে বের হলো এক রহস্যময় বেড়ি, যার একটি মাথা আসমানে, আরেকটি জমিনে। একটি প্রান্ত ছড়িয়ে গেছে পূর্বাচলে, আরেক প্রান্ত পশ্চিম চক্রবালে। কিছুক্ষণের মধ্যে বেড়িটি একটি বৃক্ষে পরিণত হয়। যার প্রতিটি পাতা সূর্যের আলোর চেয়ে ৭০ গুণ বেশি উদ্ভাসিত ছিল। পূর্ব ও পশ্চিমের গণমানুষ ওই বৃক্ষের ডালের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। কুরাইশের কিছু লোকও গাছের ডালটি আঁকড়ে ধরেছে। আবার কুরাইশের কিছু লোক বৃক্ষটি কাটতে উদ্যত। তারা গাছের কাছাকাছি এলে সুদর্শন সুঠাম দেহের এক যুবক এসে তাদের সরিয়ে দিলেন। স্বপ্নের ব্যাখ্যাকারগণ এই স্বপ্নের ব্যাখ্যায় বলেন, আপনার বংশে এমন একজন জন্মগ্রহণ করবেন, পূর্ব-পশ্চিমের লোকেরা তাঁর অনুসরণ করবে এবং আসমান ও জমিনের অধিবাসীরা তাঁর প্রশংসা ও স্তুতি জ্ঞাপন করবে। এই ব্যাখ্যা জানার পর আব্দুল মুত্তালিব স্থির করেন আসন্ন নাতির নাম রাখবেন মুহাম্মাদ। (ইদরিস কান্দালবি, সিরাতে মুস্তাফা সা. ১/৬৩)।

জন্মের সপ্তম দিনে আবদুল মুত্তালিব নাতির আকিকা করেন। আকিকা অনুষ্ঠানে কুরাইশের সবাইকে দাওয়াত করলেন। সবার সামনে নাতির নাম ঘোষণা করা হলো। আবদুল মুত্তালিব বললেন, আমি তাঁর নাম রেখেছি মুহাম্মাদ। মজলিসের কুরাইশগণ বললেন, হে আবুল হারিস, (আব্দুল মুত্তালিবের উপনাম)। আপনার পূর্ব-পুরুষ বা সম্প্রদায়ের কেউ তো আগে এমন নাম রাখেনি। আপনি কেন এই নাম নির্ধারণ করলেন? আব্দুল মুত্তালিব বললেন, এ নাম রাখার কারণ হলো যেন পৃথিবীর সকল প্রাণ যেন এ নবজাতকের প্রশংসা করে। (সিরাতে মুস্তাফা সা. : ১/৬৩)।

জুবাইর বিন মুতইম (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমার অনেক নাম রয়েছে। আমি মুহাম্মাদ (প্রশংসিত), আমি আহমাদ (সর্বাধিক প্রশংসিত), আমি মাহি (বিদূরিতকারী)। আমার মাধ্যমে আল্লাহ কুফরিকে বিদূরিত করেছেন। আমি হাশের (জমাকারী)। কেননা, সমস্ত লোক কেয়ামতের দিন আমার কাছে জমা হবে (এবং শাফাআতের জন্য অনুরোধ করবে)। আমি আকেব (সর্বশেষে আগমনকারী)। আমার পরে আর কোনো নবী নেই।’ (বোখারি : ৪৮৯৬)।

এ সব নামের মধ্যে মুহাম্মাদ ও আহমাদ হলো রাসুলে খোদার মূল নাম। বাকিগুলো তাঁর গুণবাচক নাম। (মানসুরপুরী, রহমাতুল্লিল আলামিন, খণ্ড : ৩, পৃষ্ঠা : ১৯৮)। মুহাম্মাদ নামে তিনি শুরু থেকেই পরিচিত। এই নামে জননী তাঁকে ডাকতেন, দাদা ডাকতেন এই নামেই। পরিবারের অন্যরাও এই নামেই তাকে ডাকতেন, চিনতেন, চিনাতেন।

গরিব (বিরল) সনদে বর্ণিত উপাখ্যান জানায় মাররাজ জাহরানের সিরিয় পাদ্রী আসির কথা। নবীজির জন্মের পর পরই মক্কায় তিনি আসেন আবদুল মুত্তালিবের কাছে। জানতে চান, মহান এই সন্তানের কী নাম রেখেছেন? আবদুল মুত্তালিব জানালেন নাম রেখেছি মুহাম্মাদ। পাদ্রী বললেন, এই নবজাতক মহাপুরুষ হবেন, এর তিন লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি। যার একটি হলো, তাঁর নাম মুহাম্মাদ। (তাফসিরে তাবারি : ১২/৪৯৮, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া : ২/২৭২, তারিখে দামেশক : ৩/৪২৭, ইবনে কাসির সিরাতে নববিইয়া : ১/২২৩)।

নবীজি যখন ধাত্রী মা হালিমা সাদিয়ার প্রতিপালনে, তখনও তাদের কাছে তিনি ছিলেন মুহাম্মাদ। এ নামেই তারা জানতেন, ডাকতেন ও ব্যক্ত করতেন। দ্বিতীয় দফায় হালিমার কাছে আসার পর চার কিংবা পাঁচ বছর বয়সে মুহাম্মাদের (সা.) বক্ষ বিদারণের বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে। এই সময় সাথি বাচ্চারা ছুটে গিয়ে হালিমাকে খবর দিল যে, মুহাম্মাদ নিহত হয়েছে। মানে তারাও তাঁকে এই নামেই ব্যক্ত করত। (মুসলিম : ১৬২)।

খাদিজা (রা.)-কে বিয়ের পরে জায়েদ ইবনে হারিসাকে লালন-পালন করেন আল্লাহর রাসুল। একারণে তিনি পরিচিত হন মুহাম্মাদ ইবনে জায়দ বা মুহাম্মাদের পুত্র জায়দ নামে। (বোখারি : ৪৭৮২)। এর মানে পরিষ্কার। মুহাম্মাদ নাম নবীজির যৌবনে গোটা মক্কায় বিখ্যাত ছিল। এই খ্যাতি এতই প্রভাবশালী ছিল যে, তার আজাদকৃত গোলামকেও ইবনে মুহাম্মাদ বলত লোকেরা!

মুহাম্মাদ নাম শুধু চাচা আবু তালিবের পরম প্রিয় ছিল, তা নয়। বরং তিনি নিজের মহান ভাতিজা ও তাঁর নামের মহিমাবয়ানে মুখর ছিলেন। আবু তালিব বলতেন, ‘তাঁর মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য আল্লাহ নিজের নাম থেকে তার নাম বের করে এনেছেন। তাই আরশের মালিক হলেন- মাহমুদ এবং ইনি হলেন মুহাম্মাদ।’ (বোখারি, তারিখুল আওসাত : ১/১৩ (ক্রমিক ৩১); যাহাবি, সিয়ারু আলামিন নুবালা : ১/১৫৩)। উল্লেখ্য যে, উক্ত কবিতাটি হাসসান বিন ছাবিত আনছারি (রা.) ও তার দিওয়ানের মধ্যে যুক্ত করেছেন। (দিওয়ানে হাসসান, পৃষ্ঠা : ৪৭)।

এগুলো সবই মক্কার জীবনের বিবরণী। শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য, যৌবনে তিনি গোটা মক্কা ও আরবের কাছে ছিলেন মুহাম্মাদ। কিন্তু স্প্রেঙ্গার আবিষ্কার করলেন, এই নামে নবীজিকে কেউ জানত না। তিনি নিজের এই নাম প্রচার করলেন তখন, যখন বাইবেলের পারাক্লিতস বিষয়ক ভবিষ্যদ্বাণী জানলেন। মনে মনে তিনি নিজেকে পারাক্লিতস ভাবলেন আর এর আরবি অনুবাদ হিসেবে নিজের নামকরণ করলেন মুহাম্মাদ।

মজার ব্যাপার হলো, স্প্রেংগারের এই কল্পনাকে সমর্থন করেন আরও বহু প্রাচ্যবিদ। এর মধ্যে ফরাসি-ইহুদি পণ্ডিত হার্টউইগ ডেরেনবার্গ, জার্মান প্রাচ্যবিদ থিওডর নোলডেক এবং ইতালীয় প্রাচ্যবিদ প্রিন্স লিওন ক্যাটানি অন্যতম। এই সব প্রাচ্যবিদ নিজেদের দাবিকে আকার দেবার জন্য তদ্বির করেছেন অনেক। তারা দেখাতে চাইলেন, নবীজির আসল নাম ‘কাসাম’। কিন্তু এই নামকে আসল নাম সাব্যস্ত করতে হলে অন্তত একটা আশ্রয় তো লাগবে। তারা সর্বশক্তি দিয়ে তালাশ করলেন কোনো প্রমাণ। অবশেষে হাজির করলেন এমন প্রমাণ, যা আদৌ প্রমাণ নয়। সিরাতে হালবিয়ার বিচ্ছিন্ন একটি বর্ণনাকে তারা আশ্রয় বানালেন। কিন্তু এই বর্ণনা নিজেই তাদের দাবিকে খারিজ করে দেয়। বর্ণনাতে আছে যে, জন্মের পর কাসাম নাম রাখা হলে আবদুল মুত্তালিব সঙ্গে সঙ্গে সে নাম পরিবর্তন করেন এবং মুহাম্মাদ রাখেন। এর মানে হলো- জন্মের পরই কাসাম নাম গৃহিত হয়নি।

রোনাল্ড ভিক্টর বডলি স্বীকার করেন যে, ‘জন্মের পর তার নাম রাখা হয় কাসাম। কিন্তু আবদুল মুত্তালিব পুরুষ নাতি পাওয়ায় কাবায় উপাস্যের কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তার নাম রাখেন মুহাম্মাদ। পরে মানুষ যখন এ নাম সম্পর্কে জানতে পারল, তারা আবদুল মুত্তালিবকে জিজ্ঞেস করল, ‘পিতৃপুরুষদের নাম এড়িয়ে এমন নাম রাখার কারণ কি?’ আবদুল মুত্তালিব বললেন, ‘আমি চাই সে তার চরিত্রের কারণে এ জমিনে ও আসমানে প্রসংশিত হবে।’ (আর-রসুল: হায়াতে মুহাম্মাদ, পৃষ্ঠা : ৩২)। ভিক্টর এখানে ভুল বলেছেন। জন্মের পরে কাসাম নাম রাখা হয়নি। বরং নিতান্তই দুর্বল একটা বর্ণনার দাবি হলো, কাসাম নাম রাখার ইচ্ছে করেছিলেন আবদুল মুত্তালিব। আলি ইবনে ইবরাহিম হালাবি কিতাবুল ইমতা থেকে বিবরণ পেশ করেন যে, রাসুলুল্লাহর (সা.) জন্মের আগে আবদুল মুত্তালিবের এক সন্তান ছিলেন কাসাম। তিন বছর বয়সে তিনি মারা যান। আবদুল মুত্তালিব এতে খুবই মর্মাহত হন। নবীজির জন্ম হলে তিনি নাম রাখতে চান কাসাম। মা আমেনা তখন তাকে নিজের স্বপ্নের কথা জানালেন, যে স্বপ্নে বাতলে দেওয়া হয় মুহাম্মাদ নাম। আবদুল মুত্তালিবও স্মরণ করতে পারলেন তার স্বপ্ন, তাকেও একই নাম বাতলে দেওয়া হয়েছিল, নবজাতকের নাম হবে মুহাম্মাদ। (সিরাতে হালাবিইয়া, খণ্ড : ১, অধ্যায় : ৬, পৃষ্ঠা : ২৪১)।

তাহলে দেখা যাচ্ছে- কাসাম নামে নবীজির নামকরণের ঘটনাই ঘটেনি। আবদুল মুত্তালিব ইচ্ছে করেছিলেন মাত্র। যে নাম রাখাই হয়নি, প্রাচ্যবিদরা দাবি করছেন, মুহাম্মদ (সা.) সেই নামে পরিচিত ছিলেন।

শত শত দলিল বলছে, তিনি ছিলেন মুহাম্মাদ (সা.)। এর বিপরীতে হালাবিইয়ার এই বিবরণী দলিল হতে পারে না। বরং এই বিবরণীও বলছে, তাঁর নাম রাখা হয় মুহাম্মাদ।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত