প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১৮ আগস্ট, ২০২৫
ইসলামে ইতিহাসচর্চার সূচনা হয় নবী করিম (সা.) এর জীবনচরিত ও তাঁর যুদ্ধাভিযানের অধ্যয়নের মাধ্যমে। সাহাবায়ে কেরাম (রা.) রাসুল (সা.)-এর গাজওয়া ও সিরাহ অধ্যয়নে তাদের সন্তানদের উৎসাহ দিতেন এবং গুরুত্বের সঙ্গে নিজেরাও আলোচনা-পর্যালোচনা করতেন।পরে সাহাবায়ে কেরাম এবং তাবেয়িন, তাবে-তাবেয়িনরা ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহ লিপিবদ্ধ করার দিকে মনোযোগী হন, যাতে বংশপরম্পরায় হাদিসের সনদ সংরক্ষণে কোনো বিচ্যুতি না ঘটে। পাশাপাশি তারা ইসলামপূর্ব যুগের ঘটনাবলি, কোনো জাতির পুরোনো কাহিনি, বংশগতি এবং পূর্বসূরিদের ইতিহাস সম্পর্কেও আগ্রহ নিয়ে তা সংরক্ষণ করতে শুরু করেন।
সূচনালগ্নে ইসলামি ইতিহাস চর্চার কেন্দ্রবিন্দু ছিল হাদিসশাস্ত্রের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। হাদিসশাস্ত্রের পণ্ডিতদের মুসলিম সমাজে ইতিহাস গবেষণার পথিকৃৎ হিসেবে গণ্য করা হয়। তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিলেন আবান ইবনে ওসমান ইবনে আফফান (রা.), যিনি খলিফা উসমান (রা.)-এর ছেলে এবং উরওয়া ইবনে জুবায়ের (রা.), যিনি নবীজির স্ত্রী উম্মুল মুমিনীন আসমা (রা.)-এর ছেলে। ইসলামি ইতিহাস বহু ধাপ ও ঘাত-প্রতিঘাত অতিক্রম করে আজকের অবস্থানে এসেছে।
প্রথম পর্যায় : সত্যতা ও পূর্ণ স্বাধীনতার যুগ, এই ধাপে ইতিহাসচর্চা ছিল তুলনামূলকভাবে সহজ-স্বাধীন। ঐতিহাসিকরা তখনকার ঘটনা বর্ণনায় প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনার চেয়ে জনশ্রুতির ওপর বেশি নির্ভর করতেন, তবে এতে সত্যবিচ্যুতি ঘটত না। কারণ তৎকালীন ইতিহাসবিদরা ধর্মীয় পক্ষপাত, রাজনৈতিক প্রভাব বা গোষ্ঠীগত মোহ থেকে মুক্ত থেকে ঘটনাবলি সংরক্ষণ করতেন। তাঁরা কোনো কিছু যোগ বা বাদ না দিয়ে যা পেয়েছেন তা-ই বিশ্বস্তভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন। এই পর্যায়ের ইতিহাসচর্চা ছিল নিরপেক্ষতা ও সত্যনিষ্ঠতার দিক থেকে অনন্য।
দ্বিতীয় পর্যায় : এই ধাপে ইতিহাসচর্চা অনেকটা গল্পনির্ভর হয়ে পড়ে, যার ফলে ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ জটিল ও বিভ্রান্তিকর হয়ে ওঠে। ইতিহাসের বিশুদ্ধতা এই পর্যায়ে আংশিকভাবে বিকৃত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। বিশেষ করে পূর্ববর্তী জাতিগুলো ও তাদের ঘটনাবলি ব্যাখ্যার সময় অনেক তাফসিরকারী এসব কল্পকাহিনি কোরআনের ব্যাখ্যায় বলতে শুরু করেন। যখন তাঁরা কোরআনে এসব বর্ণনার বিস্তারিত বিবরণ খুঁজে পেতেন না, তখন ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের ধর্মগ্রন্থ, পারস্য ও গ্রিক সভ্যতার লোককথা এবং নব-মুসলিমদের মাঝে প্রচলিত বর্ণনার দিকে ঝুঁকে পড়তেন।
ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের মধ্যে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং পরে ইসলামি জ্ঞানচর্চার সঙ্গে যুক্ত হন, তাদের মাধ্যমেই এসব উপকথা ও কল্পকাহিনির ইসলামী বইপত্রে অনুপ্রবেশ ঘটে। মুসলিম তাফসিরকারীরা যখন তাদের বই বা বর্ণনায় মিল খুঁজে পেতেন, তখন তারা এসব গল্পকে তাফসিরের অংশ হিসেবে গ্রহণ করে নিতেন। পরে বহিরাগত এই কাহিনিগুলোকেই ‘ইসরায়েলিয়াত’ নামে পরিচিত করা হয়, যা তাফসিরশাস্ত্রে বিতর্কিত ও সাবধানতার সঙ্গে বিশ্লেষণযোগ্য উপাদান হিসেবে বহুল আলোচিত একটি অধ্যায়। তখন ইতিহাসবিদরা মূলত মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত বর্ণনা এবং অন্যান্য বাহ্যিক উৎস থেকে ইতিহাস সংগ্রহে মনোযোগী ছিলেন। তাঁরা ইতিহাসের অন্তর্নিহিত সত্য বা মূল বক্তব্য বিশ্লেষণের চেয়ে বরং তথ্য খুঁজে বের করাকেই বেশি গুরুত্ব দিতেন। এককথায়, এই যুগের ইতিহাসবিদদের কাছে ইতিহাসচর্চা ছিল মূলত বর্ণনাগুলোর সংরক্ষণ এবং সেগুলোর সনদ যাচাই করা। কিন্তু তারা পাঠ্যের প্রকৃত বিষয়বস্তু বা উপস্থাপিত তথ্যের সত্যতা বিশ্লেষণে খুব একটা মনোযোগ দিতেন না। ফলে ইতিহাস তখন একটি তথ্যভিত্তিক দলিল রচনার কাজ হয়ে দাঁড়ায়, যার মধ্যে গভীর বিশ্লেষণ বা পাঠ্য সমালোচনার অভাব ছিল চোখে পড়ার মতো।
তৃতীয় পর্যায় : সমালোচনা ও যাচাই-বাছাইয়ের যুগ, এই পর্যায়ে ইতিহাসচর্চায় এক নতুন ধারা সূচিত হয়। ইতিহাসবিদদের এমন একটি শ্রেণির আবির্ভাব ঘটে, যারা পূর্ববর্তী যুগে ইসলামী ইতিহাসে অনুপ্রবেশ করা ইসরায়েলি উপকথার ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সচেতন হয় এবং ইতিহাসের ওপর যে ধোঁয়াশা ও বিভ্রান্তি নেমে এসেছিল, তা দূর করার প্রচেষ্টা শুরু করে। এই যুগের গবেষকরা ইতিহাসের তথ্য সংগ্রহের চেয়ে বরং পূর্ববর্তী ইতিহাসবিদদের সংকলিত তথ্য ও বর্ণনার সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ এবং সত্য যাচাইয়ে বেশি মনোযোগ দেন। এভাবে ইসলামি ইতিহাস এক ধারাবাহিক উন্নয়নের মধ্য দিয়ে পরিপক্ব হয়েছে। প্রথমে ছিল সত্যনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ তথ্য সংরক্ষণের যুগ, এরপর আসে গল্প-উপকথার প্রভাবিত একটি সময়, আর শেষ পর্যায়ে শুরু হয় সমালোচনা ও যাচাই-বাছাইয়ের ধারা। এভাবেই ইতিহাসচর্চা ধীরে ধীরে বিশুদ্ধতা ও গ্রহণযোগ্যতার দিকে অগ্রসর হয়েছে।
আলুকাহ ডটনেট থেকে ভাষান্তর করেছেন- ওমর বিন নাসির