ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

শতবর্ষী কাঠের মমিন মসজিদ

মোস্তফা কামাল গাজী
শতবর্ষী কাঠের মমিন মসজিদ

বরিশালের পিরোজপুর জেলার বুড়িরচর গ্রামে ১৯১৩ সালে নির্মিত হয় দৃষ্টিনন্দন কাঠের মসজিদ। মূল নাম ‘মমিন মসজিদ’ হলেও স্থানীয় মানুষ ‘কাঠের মসজিদ’ বলেই চিনে। সম্পূর্ণ মসজিদ কাঠের তৈরি। এমনকি এতে কোনো লোহা বা পেরেক ব্যবহৃত হয়নি। মসজিদটি দক্ষিণ এশিয়া তো বটেই, বিশ্বের একমাত্র কাঠের তৈরি দৃষ্টিনন্দন মুসলিম স্থাপত্য ও অনুপম নিদর্শন। সারা বিশ্বে এ ধরনের মসজিদ আর নেই বলে দাবি করেন স্থানীয়রা। পুরো কাঠের তৈরি আরেকটি মসজিদ ইরানের খোরাসানে থাকলেও তার বৈশিষ্ট্য কিছুটা ভিন্ন। এ ধরনের কাঠের তৈরি আরও একটি মসজিদ একসময় ভারতের কাশ্মীরেও ছিল; কিন্তু ১৮৮৫ সালের ভূমিকম্পে সেটি ধ্বংস হয়ে যায়। সে হিসেবে মমিন মসজিদ পৃথিবীর একক নিদর্শন।

দৃষ্টিনন্দন মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন তৎকালীন পিরোজপুরের ধর্মপ্রাণ যুবক মৌলভি মমিন উদ্দিন আকন্দ। তার নাতি মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ রচিত ‘মমিন মসজিদ : স্মৃতি-বিস্মৃতির কথা’ গ্রন্থে বলেন, ‘ফরায়েজি আন্দোলনের নেতা মহসিন উদ্দিন দুদু মিয়ার ছেলে বাদশা মিয়ার অনুসারী ছিলেন মমিন উদ্দিন আকন্দ। নিজ বাড়িতে কাঠ দিয়ে একটি মসজিদ নির্মাণের স্বপ্ন দেখতেন তিনি। এ উদ্দেশে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে কাঠের নানা নকশা দেখে নিজেই সম্পূর্ণ কাঠের তৈরি মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ নেন। স্বজনদের আর্থিক সহায়তায় ১৯১৩ সালে নির্মাণকাজ শুরু করেন।

সে সময়ের বরিশাল অঞ্চলের কাঠশিল্পের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি থেকে তিনি হরকুমার নাথ নামে প্রসিদ্ধ এক মিস্ত্রিকে মাসিক ৪০ টাকা বেতনে মসজিদ তৈরির কাজের দায়িত্ব দেন। ২২ জন মিস্ত্রি ৭ বছর ধরে কাজ করে ১৯২০ সালে শেষ করেন নির্মাণকাজ। মমিন উদ্দিন আকন্দ সর্বদা মিস্ত্রিদের কাজ পরিচালনা করতেন এবং সূক্ষ্মভাবে কারুকাজ পরীক্ষা করে দেখতেন।’

মসজিদ তৈরিতে ব্যবহৃত কাঠ সংগ্রহ করা হয়েছিল মিয়ানমার, ত্রিপুরা ও আসাম থেকে। মসজিদের ফলকে এমনই তথ্য খোদাই করা রয়েছে।

জনশ্রুতি রয়েছে যে, বাড়ি থেকে দূরের মসজিদে নামাজ পড়তে যেতে কষ্ট হতো বলে যুবক মমিন উদ্দিন আকন্দ নিজ বাড়িতেই মসজিদ নির্মাণের চিন্তা করেন। দৃষ্টিনন্দন মসজিদ নির্মাণের লক্ষ্যে তিনি বিভিন্ন মসজিদ পরিদর্শন শুরু করেন। প্রথমে ইট দিয়ে মসজিদ নির্মাণের চিন্তা করলেও পরে কাঠ দিয়ে তৈরির পরিকল্পনা করেন। গ্রাম্য পরিবেশে গড়ে ওঠা মসজিদটির আশপাশটা বেশ নিরিবিলি। মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটি সুপারি গাছ। রোজ পাশের বড় কড়ই গাছটায় হাজারো পাখির মেলা বসে। তাদের কলকাকলীতে মুখর থাকে চারপাশ। মসজিদের সামনে ছোট্ট পাকা বারান্দা। এর সীমানা ছোট্ট প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। ডিজাইন করা কাঠের দেয়াল বেশ চমৎকার। মসজিদ তৈরিতে শুধু শাল, সেগুন গাছের কাঠ ব্যবহার করা হয়েছে। আনুমানিক ১২ ফুট প্রস্থ ও ২৪ ফুট দৈর্ঘ্যরে মসজিদের প্রতিটি ইঞ্চি অনন্য সব নকশায় ভরপুর। তবে মজবুত ও টেকসই এ মসজিদের কাঠামো তৈরিতে লোহার পেরেক ব্যবহারের পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়েছিল কাঠের শলা।

মসজিদের চৌচালায় টিনশেড দিয়ে পাটাতন তৈরি করা হয়েছে। ভেতরে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস প্রবেশ ও সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য পাটাতনের মাঝে তৈরি করা হয়েছে দ্বিতীয় আরেকটি দোচালা টিনের ছাউনি। মসজিদের উত্তর ও দক্ষিণে দুটো করে এবং পূর্ব ও পশ্চিমে চারটি করে জানালা রয়েছে। পূর্ব দিকে রয়েছে একটি প্রবেশদ্বার। তাতে কারুকার্যখচিত দুটি পিলার। তাতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সূক্ষ্ম শিল্পকর্ম। প্রবেশদ্বারের ওপরে বাঁ দিকে আরবি হরফে ক্যালিওগ্রাফিতে ইসলামের চার খলিফার নাম ও মাঝখানে মহানবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর নাম অলংকৃত করা হয়েছে। প্রবেশদ্বারের মাঝামাঝি অংশে খোদাই করা হয়েছে ‘লা ইলাহা ইল্লালাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’। ভেতরে মেহরাবের ওপরও রয়েছে দারুণ ক্যালিওগ্রাফি।

পুরো মসজিদ তৈরিতে জ্যামিতিক নকশার ব্যবহার এবং কাঠের ওপর আরবি ক্যালিগ্রাফির বৈশিষ্ট্য মমিন মসজিদকে বিশ্বে একক ঐতিহ্যে পরিণত করেছে। কাঠের কারুকাজের অনন্য উদাহরণ এটি; যা ইন্দো-পারসিক আর ইউরোপীয় ধারার মিশেলে সৃষ্ট জগদ্বিখ্যাত স্থাপত্য। এতে টুকরো টুকরো কাঠ শিল্পকর্মের জ্যামিতিক বিন্যাসে গড়ে তোলা হয়েছে অনুপম নৈসর্গ। ফুটিয়ে তোলা হয়েছে হরেক ফুল, ফুলদানি ও ফলের নকশার সমন্বয়ে দেশীয় লোকজ উপাদান। প্রাকৃতিক দৃশ্যের মধ্যে আরও রয়েছে- পাতা, ফুল, লতা, ফল, ডালপালা ও গাছ। মমিন মসজিদের নকশায় উদ্ভিদ অলঙ্করণের পরিমাণই সবচেয়ে বেশি এবং দারুণ আকর্ষণীয়। আনারস, নয়নতারা গাছসহ বিভিন্ন গাছ দিয়ে অলঙ্করণ করা হয়েছে। কুমড়াপাতা, আঙুরলতা ও কলমিলতা ছাড়াও কদম, সূর্যমুখী দিয়ে সাজানো হয়েছে মসজিদের অবয়ব। এসব কারুকাজে ব্যবহার করা হয়েছে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক রং, যা এর আরেক অনন্য দিক।

এর ঐতিহাসিক ও প্রত্নমূল্য বিবেচনা করে ২০০৩ সালের ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিপ্ততর এটিকে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি ঘোষণা দিয়ে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেয়। কিন্তু আদতে রক্ষণাবেক্ষণের কোনো চিহ্ন দেখা যায় না। টিনের চাল নষ্ট হয়ে বৃষ্টির সময় মেঝেতে পানি পড়ে। কাঠের গায়ের রংও উঠে গেছে কয়েক জায়গায়।

মমিন মসজিদ বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য ৩০টি শিল্পসম্পৃদ্ধ মসজিদের মধ্যে অন্যতম বলে ইউনেসকোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। ইউনিসেফ প্রকাশিত বিশ্বের অন্যতম মসজিদ নিয়ে প্রকাশিত ৪০০ পৃষ্ঠার এক গ্রন্থে মমিন মসজিদের সচিত্র বর্ণনা রয়েছে। বাংলাদেশের সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত মসজিদের মধ্যে যেগুলো বেশি গুরুত্ব বহন করে, সেসব মসজিদের ছবি জাতীয় জাদুঘরেও প্রদর্শিত হয়। মঠবাড়িয়ার মমিন মসজিদের কয়েকটি বণর্ণনাসহ আলোকচিত্র জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত