প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
ঝিনাইদহের বারোবাজার দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থান। এখানে রয়েছে সুলতানি আমলের ৫০০ থেকে ৮০০ বছর পুরোনো অসংখ্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। ঝিনাইদহ-যশোর মহাসড়কের যে স্থানে বারোবাজার অবস্থিত, তার আশপাশে ৩ থেকে ৪ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের বৃত্ত আঁকলে যে স্থানটি ধরা পড়ে, তার মধ্যেই রয়েছে অনেকগুলো প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। এই নিদর্শনগুলো প্রমাণ করে আজ থেকে ৫০০ বছর আগে এই অঞ্চলে একটি সমৃদ্ধ সুলতানি জনপদ ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে বিভিন্ন শাসনামলে এই জনপদ ক্রমশ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। গত শতকের আশির দশকে বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর বারোবাজার এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন উঁচু উঁচু মাটির ঢিবি খনন করে এসব অত্যাশ্চর্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কার করেন। আশপাশের জনপদ সমতল থাকলেও শুধু এই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো মাটির নিচে চাপা পড়ে ছিল। এই এলাকায় সুলতানি আমলের ১৯টি মসজিদ মাটির নিচ থেকে উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে গলাকাটা মসজিদ অন্যতম। ২১ ফুট লম্বা ও ১৮ ফুট চওড়া মসজিদটি বাংলাদেশ প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তর ১৯৯২-৯৩ সালে খনন করে। বারোবাজার প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রক্ষণাবেক্ষণ আন্দোলনের অন্যতম সদস্য আলমগীর হোসেন বলেন, ‘গলাকাটা মসজিদের মতো এ এলাকার অনেক মসজিদ দীর্ঘদিন ধরে মাটির নিচে ছিল। স্থানটি ছিল উঁচু ঢিবি। এ ঢিবির ওপর জঙ্গল ও বড় বড় গাছপালা গজিয়ে উঠেছিল। সেগুলো পরিষ্কার করে অনন্য এই নিদর্শনগুলো বের করা হয়। খনন করার সময় শাহ সুলতান মাহমুদ ইবনে হুসাইনের আমলের (৮০০ হিজরি) আরবি ও ফার্সিতে লেখা কয়েকটা পাথর এখানে পাওয়া যায়। সেগুলো দেখে অনুমান করা হয়, মসজিদটি সুলতানি শাসনামলের তৈরি। একসময় এ জনপদে বাস করতেন প্রাচীন রাজারা।’
তাহেরপুরের প্রধান সড়কের পাশে মসজিদটি অবস্থিত। গাছগাছালিতে ছেয়ে আছে আশপাশের পুরো এলাকা। ঘন গাছগাছালির ভেতর মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সুন্দর মসজিদটি। মসজিদের চারপাশ সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। সামনে রয়েছে সুন্দর বেসমেন্ট।
মসজিদের ছাদে রয়েছে ছয়টি গম্বুজ। ভেতরে রয়েছে দুটি কষ্টিপাথরের মিনার। মসজিদটি খনন করার সময় একটি হাতে লেখা কোরআন শরিফ ও একটি তলোয়ার পাওয়া যায়। সেগুলো মসজিদের ভেতরেই সংরক্ষিত আছে। চারটি ৬ কোণাকৃতি বড় মোটা পিলারের ওপর মূল মসজিদটি দাঁড়িয়ে আছে। পিলারগুলো ২৫ ফুট করে লম্বা। মসজিদের দেয়াল ৫ ফুট চওড়া। সামনের দিকে ৩টি দরোজা রয়েছে। এছাড়াও উত্তর ও দক্ষিণপার্শ্বে দুইটি করে প্রবেশপথ ছিল। এগুলো ইটের জাল করে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। প্রতিটি দরোজার উপরে রয়েছে সুচালো খিলান।
ভিতরে পশ্চিমের দেয়ালে ৩টি মেহরাব আছে। এতে পোড়ামাটির কারুকাজ এবং ফুল, লতাপাতা, ঘণ্টা, চেইন ইত্যাদির নকশা করা আছে। কালো পাথরের ৮ ফুট উচ্চতার দুটো স্তম্ভ ছাদের সঙ্গে মিশে আছে। মসজিদের গম্বুজগুলো স্তম্ভের সামনে ও পেছনে স্থাপিত হয়েছে।
এই মসজিদের সঙ্গে বাংলাদেশের আরও অনেকগুলো মসজিদের সাদৃশ্য আছে। যেমন, গৌরের ধবীচক ও ঝনঝনিয়া মসজিদ, ঢাকা রামপালে বাবা আদমের মসজিদ, শৈলকুপার শাহি মসজিদ ও বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদ। ইসলামি স্থাপত্যের এক অপূর্ব নিদর্শন হিসেবে গলাকাটা মসজিদ বাংলাদেশের পুরাকীর্তিকে সমৃদ্ধ করেছে।
মসজিদের পাশে রয়েছে গলাকাটা দিঘি। খান জাহান আলি (রহ.)-এর সমসাময়িক এ দিঘি বলে প্রবল জনশ্রুতি আছে। এ দিঘিটি চর্তুদিকের পাড়সহ বারো বিঘা জমির ওপর অবস্থিত। দিঘির জলে হাঁসের ভেসে বেড়ানোর দৃশ্য খুবই চমৎকার। দিঘির শান্ত জল সুলতানি আমলের জৌঁলুস মনে করিয়ে দেয়। আগের দিনে বড় মসজিদ নির্মাণ করলে তার সামনে অজু-গোসলের জন্য এমন একটি দিঘি নির্মাণ করা হতো। তবে এই দিঘির নাম কেন গলাকাটা হলো সে সম্বন্ধে খুব একটা জানা যায় না। জনশ্রুতি আছে, বারোবাজারে একজন অত্যাচারী রাজা ছিলেন। তিনি প্রজাদের বলি দিয়ে এই দিঘির মধ্যে ফেলে দিতেন। এ কারণেই এর নাম হয় গলাকাটা দিঘি। অনেকে মনে করেন, দিঘির ওপর দিয়ে রাতে গলাকাটা ঘোড়া চলত। তাই মানুষ এর নাম দিয়েছে গলাকাটা দিঘি। এর থেকে মসজিদেরও নাম হয় গলাকাটা মসজিদ।
দিঘির পশ্চিম পাড়ে রয়েছে একটি ছোট অনুচ্চ ঢিবি। এই ঢিবি সম্পর্কে স্থানীয়দের মধ্যে মতভেদ আছে। কেউ কেউ এটিকে মন্দির বলে দাবি করে। কিন্তু ব্রিটিশ সরকারের পরগনা শাহা উজালা ভূমি রেকর্ডে এটি মসজিদেরই অন্তর্ভুক্ত ছিল।
মসজিদের ভেতরের দেয়ালে রয়েছে বিভিন্ন প্রকার জ্যামিতিক ও ফুলের নকশা। তিনটি মেহরাবের প্রান্তভাগ আয়তক্ষেত্রাকৃতির ফ্রেম দ্বারা বাঁধানো। উত্তর ও দক্ষিণ পার্শ্বের মেহরাবের ক্ষেত্রাকৃতির ফ্রেমের মধ্যে পোড়া মাটির জ্যামিতিক নকশা রয়েছে। আয়ত ক্ষেত্রাকৃতির ফ্রেমের ওপরে আছে বন্ধ মার্শনের সারি। এলাকাবাসী জানায়, সংস্কার ও সংরক্ষণের আগে মসজিদের দেয়ালগুলো একটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় অবস্থিত ছিল এবং এর কোন গম্বুজ ছিলনা। সম্প্রতি কয়েকটি গম্বুজসহ মসজিদটি পুর্ননির্মিত হয়েছে।
গোলাকার ঢিবির ওপর স্থাপিত মসজিদটির উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালের প্রতিটিতে আছে দুটি করে জালিবিশিষ্ট জানালা। পূর্ব দেয়ালে রয়েছে তিনটি খিলানযুক্ত প্রবেশপথ। মসজিদের ভেতরে ২.৯৮ মিটার ব্যবধানে দুটি বহুভুজাকার পাথরের স্তম্ভ রয়েছে। এর দেয়ালগুলো প্রায় পাঁচ ফুট চওড়া। মাঝখানে আছে লম্বা দুটি কালো পাথর। মেহরাবের দুপাশের দেয়ালে উৎকীর্ণ হয়েছে পোড়া মাটির রেখাকৃতির বিভিন্ন ধরনের জ্যামিতিক ও ফুলের নকশা। এছাড়া মসজিদের দেয়াল ও ছাদজুড়ে আছে পোড়ামাটির ঘণ্টা ও চেইনের নকশা। মসজিদের সামনে নবনির্মিত একটি বারান্দা আছে।