প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ০৬ অক্টোবর, ২০২৫
মৌলভীবাজার শহর থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে গয়ঘর গ্রামে পাঁচ শতাধিক বছরের ইতিহাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে খোজার মসজিদ। দেয়ালের শুভ্র রঙের কারণে দূর থেকেও জ্বলজ্বল করে মসজিদটি। গ্রামের প্রধান সড়কের পাশে এর অবস্থান। আশপাশটা সবুজ গাছগাছালিতে ছাওয়া। পাখির কলকাকলিতে মুখর থাকে চারপাশ। একটি টিলার মতো উঁচু স্থানে নির্মিত এই মসজিদ সতেরো শতাব্দের সাক্ষ্য বহন করছে আজো। ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে এই মসজিদ মুসলমান ছাড়াও আশপাশের অন্যান্য ধর্মের মানুষের কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। মসজিদের মেঝে ও গম্বুজে সাদা রঙের টাইলস দিয়ে বাঁধাই করা। মসজিদের তিনটি বড় দরজা ও ছয়টি ছোট দরজা রয়েছে। দেয়ালের ইটের গাঁথুনি অনেক পুরু। মূল মসজিদ দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে ২৪ হাত করে। গম্বুজ ১৮ ফুট উঁচু।
ইতিহাস পর্যালোচনা করে জানা যায়, ১৪৭৬ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান বরবক শাহের ছেলে সুলতান শামসউদ্দিন ইউছুফ শাহর আমলে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। হাজী আমিরের পৌত্র ও সেই সময়ের মন্ত্রী মজলিসে আলম এটি নির্মাণ করেন। সিলেটের হজরত শাহজালাল (রহ.)-এর মসজিদ ও খোজার মসজিদের শিলালিপিতে উল্লেখ থাকা মজলিসে আলম একই ব্যক্তি। মসজিদ দুটো নির্মিত হয়েছিল চার বছরের ব্যবধানে। মসজিদটিকে অনেকে গায়েবি মসজিদও বলে থাকে। আর এ নিয়ে মানুষের মনে রয়েছে নানা কৌতূহল।
খোজার মসজিদের নামকরণ নিয়ে অনেক লোককথা রয়েছে। সবচেয়ে বেশি যে কথা প্রচলিত আছে- তা হলো, বাংলার সুবেদার মানসিংহের কাছ থেকে বিতাড়িত হয়ে পলায়নের সময় পাঠান বীর খাজা উসমান মসজিদটির এই স্থানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেই থেকে খাজা নামের অপভ্রংশ ‘খোজা’ থেকে এর নামকরণ।
স্থানীয় লোকজনের মতে, একসময় এই এলাকা ঘন জঙ্গলে পূর্ণ ছিল। মসজিদ নির্মাণের সময় এ এলাকায় বাঘের বিচরণ ছিল প্রচুর। এমনকি মসজিদ নির্মাণের সময় একটি বাঘ মসজিদের কাঁচা দেয়ালে থাবা বসিয়েছিল। কয়েক শত বছর ধরে আজও টিকে আছে সেই চিহ্ন। জায়গাটা সযত্নে সংরক্ষণ করে রেখেছেন স্থানীয় মানুষ। দেয়ালের ওপরের দিকে রয়েছে আরবি লেখা ও বিভিন্ন ফুলের আঁকা অপূর্ব কারুকাজ। পশ্চিম দেয়ালে রয়েছে কৃষ্ণ পাথরের বহু পুরোনো একটি শিলালিপি। চুরি ঠেকাতে লোহার খাঁচার বেষ্টনী দেওয়া হয়েছে এতে।
স্থানীয়দের মতে, এই মসজিদের বাইরে ছিল দুটি বড় কষ্টিপাথর। প্রচলিত আছে, এগুলো রাতের আঁধারে ঘোরাফেরা করত। তাই মানুষ পাথর দুটোকে মনে করত জীবন্ত। পাথরে হাত দিয়ে অনেকে সে হাত মুখে-বুকে লাগাতেন। ভক্তি করে পাথর ধোয়া পানিও খেতেন। পরে পাথর দুটো থেকে একটা নাকি মারা যায়। সেটা পাশের পুকুরে ফেলে দেওয়া হয়। আর অন্যটি চুরি হয়ে যায়। মসজিদের পাশে রয়েছে মাঝারি আকৃতির সুন্দর একটা পুকুর। পুকুরে রয়েছে নানা ধরনের বড় বড় মাছ। এই মাছ কেউ খায় না, বরং বরকতের জন্য অনেকে এদের খাবার দেয়, এদের নামে মান্নত করে। পবিত্র রমজানে এই মসজিদে ধর্মপ্রাণ মানুষের সমাগম বেড়ে যায়। অন্যান্য সময়ে সমজিদে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের উপস্থিতি হলেও রমজানে শুধু মুসলমানরা ইবাদত করতে আসেন। তারাবির নামজে প্রায় পাঁচ শতাধিক মানুষ উপস্থিত হোন।
মসজিদ কমিটির সাবেক সম্পাদক জয়নাল আবেদিন জানান, ১৯৩৮-১৯৪০ সালের মধ্যে আজম শাহ নামের একজন কামেল পীর এ মসজিদে আসেন। ১৯৪০ সালের দিকে মসজিদের গম্বুজ ভেঙে পড়ে। তখন তিনি মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে টাকা সংগ্রহ করে হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ের পরিচিত একজন মিস্ত্রিকে দিয়ে সংস্কার করান। ১৯৬০ সালে আরও একবার মসজিদটি সংস্কার করান তিনি। সংস্কারের পর আজম শাহ চলে গেলে এটি অরক্ষিত হয়ে পড়ে। ঝোপজঙ্গলে ছেয়ে যায় পুরো স্থান। এমনকি গম্বুজেও গজিয়ে ওঠে বটের চারা ও লতাগুল্ম।
১৯৮৪ সালের পর অপরিকল্পিতভাবে সংস্কার শুরু হয় এ মসজিদের। মুসল্লিদের স্থান সংকুলান না হওয়ায় পূর্ব দিকে মসজিদের জায়গা বাড়ানো হয়। প্রাচীন স্থাপত্যকলার নিদর্শন হিসেবে যথাযথ রীতি মেনে যেভাবে এর সংস্কার দরকার ছিল, তা করা হয়নি। ১৯৯৩ সালে মসজিদটি সংরক্ষণে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছিল। পরে লোকজন এসে মাপজোখ করে যান। কিন্তু কিছুই করা হয়নি। এখন মসজিদের পুরোনো সৌন্দর্যের অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে। রহস্যময় মসজিদটি এক নজর দেখার জন্য দেশের দূর-দূরান্ত থেকে অসংখ্য পর্যটন ভিড় করেন এখানে।