ঢাকা রোববার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ২২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

প্রায় সাড়ে ৪০০ বছরের পুরোনো খেরুয়া মসজিদ

মোস্তফা কামাল গাজী
প্রায় সাড়ে ৪০০ বছরের পুরোনো খেরুয়া মসজিদ

করতোয়া নদী তীরবর্তী স্থান বগুড়ায় বাংলার প্রাচীনতম সভ্যতা গড়ে ওঠার কথা ছোটবেলা বইয়ের পাতায় পড়েছি। মহাস্থানগড়সহ বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া যায় এ অঞ্চলজুড়ে। এর মধ্যে অন্যতম একটি নিদর্শন হলো খেরুয়া মসজিদ। প্রায় ৪০০ বছর পুরোনো এই মসজিদ বগুড়ার শেরপুর উপজেলা সদর থেকে এক কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে গ্রামীণ সবুজ শ্যামল ছায়াঘেরা মনোরম পরিবেশে খন্দকারটোলা গ্রামে অবস্থিত। মসজিদের চারপাশ সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। আশপাশটা সবুজ ঘাসে ছাওয়া। গাছের ডালে বসা হাজারো পাখির কলকাকলিতে মধুছন্দে মুখরিত হয় চৈত্রের শেষ বিকেল।

৫৯ শতাংশ ভূমি নিয়ে গঠিত মসজিদের সম্পূর্ণ অংশ। ইটের দেয়ালের ওপরটা লোহার রেলিং দিয়ে ঘেরা। মূল গেটের কাছেই রয়েছে বেশ বড় একটি সাইনবোর্ড। বাংলা ও ইংরেজিতে এতে লেখা আছে মসজিদের ইতিহাস। রং উঠে যাওয়ায় বোর্ডের লেখার পাঠোদ্ধার করা যায় না। তবে মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলামের লেখা ‘ঐতিহ্যের স্বরূপ সন্ধানে’ এবং অধ্যক্ষ মুহম্মদ রোস্তম আলীর ‘শেরপুরের ইতিহাস (অতীত ও বর্তমান)’ থেকে পাওয়া যায় মসজিদটির সংক্ষিপ্ত নির্মাণ ইতিহাস।

তখন ১৫৮০ খ্রিষ্টাব্দ। স্থানীয় বুজুর্গ ফকির আবদুস সামাদ একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠার চিন্তা করেন। সে সময়ে এখানকার প্রাদেশিক জায়গিরদার মির্জা মুরাদ খান কাকশালের পৃষ্ঠপোষকতায় মসজিদের নির্মাণকাজ শুরু করেন তিনি। দিল্লির মসনদে তখন আসীন মোগল সম্রাট জালালুদ্দিন আকবর।

১৫৮২ সালে তিনি দ্বীনে এলাহি প্রতিষ্ঠা করলে বাংলার কিছু অঞ্চলে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দেখা দেয়। মির্জা মুরাদ খান কাকশালও যোগ দেন সম্রাটের বিদ্রোহীদের দলে।

এই বিদ্রোহের সময় বন্ধ থাকে মসজিদ নির্মাণের কাজ। শেষ পর্যন্ত মুরাদ খান সম্রাটের প্রতি আনুগত্য স্বীকারে বাধ্য হন। সম্রাটের আনুগত্য মেনে নেওয়ার পর আবারও শুরু হয় খেরুয়া মসজিদের নির্মাণকাজ। ফলে প্রায় পাঁচ বছর লেগে যায় মসজিদটির নির্মাণ প্রক্রিয়া।

মসজিদটি উত্তর-দক্ষিণে ৫৭ ফুট দৈর্ঘ্য ও পূর্ব-পশ্চিমে ২৭ ফুট প্রস্থ। মসজিদের দেয়ালগুলো ৬ ফুট চওড়া। পূর্ব দেয়ালে রয়েছে তিনটি প্রবেশ পথ। উত্তর ও দক্ষিণের দেয়ালে আছে একটি করে ছোট্ট দরজা। বর্তমানে এর দরজায় কোনো চৌকাঠ নেই। হয়তো পাল্লাও ছিল না। এখন লোহার কাঠামোয় বানানো হয়েছে দরজা। মূল দরজার নিচে রয়েছে কালো পাথরের পাটাতন।

পূর্ব দেয়ালের তিনটি দরজার সোজা পশ্চিমে আছে তিনটি মেহরাব। মধ্যেরটি অপেক্ষাকৃত বড়।

কারুকার্যময় মেহরাবগুলো আজও মোঘল আমলের স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন বহন করছে। পূর্ব দেয়ালে ফার্সি অক্ষরে লেখা দুটি শিলালিপি ছিলো। প্রথম ও দ্বিতীয় দরজার মধ্যবর্তী স্থানে অর্থাৎ মূল প্রবেশদ্বারের বাঁ পাশে ওপরের দিকে একটি শিলালিপির অস্তিত্ব এখনও পাওয়া যায়। মুহম্মদ রোস্তম আলি তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন অপর শিলালিপিটি নাকি করাচি জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। মসজিদের ওপরে রয়েছে তিনটি গম্বুজ। সমান আকৃতির গম্বুজগুলোর প্রত্যেকটি ৩.৭১ মিটার ব্যাসের। অর্ধগোলাকৃতির গম্বুজগুলোর কার্নিশ ধনুকের মতো বাঁকা। এ ছাড়া মসজিদের চার কোণে রয়েছে আট কোণাকৃতির চারটি মিনার। মোগল-পূর্ব সুলতানি আমলের স্থাপত্যশৈলীর সঙ্গে মোগল আমলের স্থাপত্যশৈলীর অনন্য নিদর্শন হচ্ছে শেরপুরের খেরুয়া মসজিদ। মসজিদটির ছাদের নিচে পায়রাদের বসবাসের জন্য পৃথক কিছু জায়গা নির্মাণ করা হয়েছিল। তা ছাড়া মসজিদের একটি শিলালিপির ভেতর রক্ষিত ছিল মূল্যবান স্বর্ণখণ্ড যা পরবর্তী সময় বেহাত হয়। মসজিদের একটি শিলালিপি বর্তমানে করাচি জাদুঘরে রক্ষিত রয়েছে।

খেরুয়া মসজিদের নামকরণ স্পষ্ট নয়। আবুল কালাম মোহাম্মদ জাকারিয়া তার ‘বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ’ বইতে উল্লেখ করেছেন, মসজিদটি ‘খেরুয়া’ বলে নামকরণের কোনো ইতিবৃত্ত পাওয়া যায়নি। আরবি ভাষায় খেরুয়া বলে কোনো শব্দ নেই। তবে ফার্সিতে ‘খায়ের গাহ’ বলে একটি শব্দ আছে। যার অর্থ কোনো স্থানের ভেতরে। রাজা মানসিংহ যখন বাংলার সুবাদার, তখন তিনি শেরপুরে একটি দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন। এই দুর্গের কোনো অস্তিত্ব এখন নেই। তবে মসজিদটি যদি শেরপুর দুর্গের ভেতরে নির্মিত হয়ে থাকে, তবে ‘খায়ের গাহ’ থেকে খেরুয়া নাম হতে পারে বলে অনুমান করা হয়। মসজিদটিতে একসঙ্গে প্রায় একশজন নামাজ পড়তে পারেন। বর্তমানে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় সামাজিকভাবে মসজিদটি পরিচালিত হয়। মসজিদটি দীর্ঘ সময় অবহেলায় পড়ে থাকে। ৯০-এর দশকে দেশের প্রত্নতত্ত বিভাগ মসজিদটি সংস্কারের উদ্যোগ নিয়ে আগের অবস্থায় ফিরে আনে। পরে ১৯৮৮ সাল থেকে প্রত্নতত্ত বিভাগ মসজিদটিসহ-এর সম্পত্তি দেখভালের জন্য একজন খাদেম নিয়োগ দেয়।

মসজিদের সামনেই বাঁধাই করে রাখা হয়েছে এর স্বপ্নদ্রষ্টা ফকির আবদুস সামাদের কবর। ইতিহাস সমৃদ্ধ এ মসজিদটি পরিদর্শনে প্রতিনিয়ত দেশ-বিদেশের বহু পর্যটক ও দর্শনার্থীসহ স্থাপত্য বিশারদরা আসেন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত