ঢাকা শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মালয় দ্বীপপুঞ্জে যেভাবে ইসলাম এলো

হাবিবা আক্তার
মালয় দ্বীপপুঞ্জে যেভাবে ইসলাম এলো

মালয় জগতের জন্ম সম্পর্কে প্রায় ৫০০ বছর আগে যে বাক্যটি লেখা হয়েছিল, তা আজও তেমনি সত্য যেমন সত্য ছিল তখন। একজন মালয় শাসক বলেছিলেন, ব্যবসা সব জীবকে একত্র করে। কয়েক শতাব্দী কাল আগে বলা কথাটি আজও চিরসজীব বলেই মনে হয়। কেননা মালয় অঞ্চলের সঙ্গে ইসলামের সংযোগ ঘটেছিল ব্যবসা-বাণিজ্যের পথ ধরে। মালয় অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যবসা-বাণিজ্যের ধারণা পাওয়া যায় মালাক্কার সুলতান মানসুর শাহের বক্তব্য থেকে। তিনি ১৪৬৮ সালে রাউকিউয়ের রাজাকে বলেছিলেন, ‘আমরা নীল সমুদ্রকে আয়ত্ত করতে শিখেছি। মানুষের উচিত ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত হওয়া। এমনকি তাদের দেশ বিরানভূমি হলেও।

পৃথিবীর সব ভূমিকে সমুদ্র এক দেহের মতো একত্র করেছে। সব জীব ভালোবাসার ওপর বেঁচে আছে। আজকের মতো আগে জীবন এত সমৃদ্ধ ছিল না।’ মালয় জগৎ বলতে শুধু মালয় দ্বীপপুঞ্জকে বোঝায় না, বরং তা এক বিস্তৃত সামুদ্রিক অঞ্চল, যা দক্ষিণ চীন সাগর ও ভারত মহাসাগরের মধ্যে অবস্থিত।

সুপ্রাচীনকাল থেকে অঞ্চলটি গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্র বাণিজ্যের রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, বিশেষত তা ছিল বিশ্বের অন্যতম মসলা বাণিজ্যের কেন্দ্র। এই বাণিজ্য মালয় জগেক ভারত মহাসাগর ছাপিয়ে বিশ্বের আরও বিস্তীর্ণ অঞ্চলের সঙ্গে সংযুক্ত করেছিল। সুদূর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে মালয় অঞ্চল সংযুক্ত হয়েছিল ব্যবসার সূত্র ধরে। ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে একসময় মালয় অঞ্চলকে সিল্ক রোডের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হতো। মসলা ব্যবসার পথ ধরে একসময় হিন্দু-বৌদ্ধদের দ্বারা শাসিত মালয় অঞ্চলে ইসলামের বিকাশ ঘটে। দক্ষিণ আরবের সঙ্গে মালয় অঞ্চলের যোগাযোগ একসময় বাণিজ্যিক সম্পর্ককে অতিক্রম করে ধর্মীয় সম্পর্কে রূপ নেয় এবং তা এই অঞ্চলে ইসলাম প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে এটাও ঠিক এই অঞ্চলে ইসলাম প্রচারকারী হাদরামি গোত্রের লোকেরা সরাসরি ইয়েমেন থেকে আগমন করেনি। তারা গুজরাট থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল। হাদরামিদের পাশাপাশি ভারতীয় উপমহাদেশের লোকেরাও মালয় অঞ্চলে ইসলাম প্রচারে অবদান রেখেছে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলের মুসলিমরা সমুদ্র বাণিজ্যের পথ অনুসরণ করে মালয় অঞ্চলের দুর্গম ভূমিতে ইসলামের বাণী পৌঁছে দেয়। মালয় অঞ্চলে ইসলাম প্রসারের ফলে স্থানীয় ভাষা ও লিপিতে পরিবর্তন এসেছিল। পল্লবা ও কাবি-এর মতো ভারতীয় লিপি জাভিতে রূপান্তরিত হয়েছিল। ফলে অত্র অঞ্চলে ইসলামি ক্যালিগ্রাফির উন্নয়ন সহজ হয়েছিল। ভাষা ও লিপির রূপান্তরের ক্ষেত্রে ইসলামণ্ডপূর্ব স্থানীয় উপকরণ ও ইসলামি উপকরণের সমন্বয় ঘটেছিল। জাভা উপকূলের মসজিদগুলোতে এই সমন্বয় ও রূপান্তরের নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যায়। অনেকে বিস্মিত হবেন যে জাভার প্রাচীন মসজিদগুলোর মিম্বারে এমন কিছু পত্র-পল্লবের কাঠের নকশা রয়েছে, যার উদ্ভব হয়েছিল ইসলামণ্ডপূর্ব কালা দেবতার মাথা থেকে। ইসলাম তার নিজস্ব নীতিমালার আলোকে স্থানীয় সংস্কৃতি ও শিল্প উপকরণগুলোকে আত্মস্থ করেছে এবং তা ঢেলে সাজিয়েছে। পাশাপাশি ইসলমি সংস্কৃতির প্রচার-প্রসারেও মনোযোগ ছিল ধর্ম প্রচারকদের।

মালয় অঞ্চলে ইসলাম আগমনের সময় থেকেই লিখিত উপকরণের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ফলে মালয় অঞ্চলে ইসলামি ক্যালিগ্রাফি চর্চার ইতিহাস বেশ পুরনো। কাপড় থেকে কাঠ- বহু কিছুর ওপর ক্যালিগ্রাফি চর্চা হয়েছিল। ক্যালিগ্রাফিশিল্পের বড় একটি উপলক্ষ ছিল পবিত্র কোরআনের অনুলিপি। মালয় অঞ্চলে কোরআনের শৈল্পিক অনুলিপি তৈরিতে বিশেষ উৎসাহ দেওয়া হতো। এ ছাড়া চিরায়ত ইসলামি সাহিত্যের বইগুলোর অনুলিপিও শৈল্পিকভাবে তৈরি করা হতো। উনিশ শতকে মক্কা-মদিনার সঙ্গে নৌ যোগাযোগ সহজ হলে শিল্পের উপাদান হিসেবে কাবা ও মসজিদে নববীর ছবি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

মালয় অঞ্চলে ইসলাম শুধু প্রভাবশালী ধর্ম হিসেবেই আবির্ভূত হয়নি, বরং তা এই অঞ্চলের মানুষের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের রক্ষকও বটে। ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার অনুপ্রেরণা ইসলামই দিয়েছিল। মুসলিম পণ্ডিতরাই সামনে থেকে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। যে বাণিজ্যের পথ ধরে মালয় অঞ্চলে সুদূর আরব ইসলামের আগমন হয়েছিল, আরবের সঙ্গে সেই ব্যাবসায়িক সম্পর্ক জোরাল করতেআগ্রহী মালয় মুসলিমরা। এই লক্ষ্যে তারা নানামুখী উদ্যোগও গ্রহণ করেছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত