ঢাকা রোববার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ২২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ইসলামে পাঠের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

আবদুল্লাহিল বাকি
ইসলামে পাঠের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

মানব ইতিহাসে পাঠের ধারা বেশ পুরোনো। কাগজ আবিষ্কারের আগে মানুষ পাথর, গুহার দেয়াল, চিত্রলিপি, মাটির ট্যাবলেট বা কোডেক্সে লিখত এবং পড়ত। তবে লিখিত পাঠের পাশাপাশি মৌখিক পাঠও ছিল বহুল প্রচলিত। গল্প, ছন্দ, ইতিহাস কিংবা আইনকানুন মানুষ মুখে মুখে শুনে মনে রাখত। এভাবেই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে জ্ঞান ছড়িয়ে পড়ত। আল্লাহ মানুষের সঙ্গে সরাসরি কথা বলার রীতি বেছে নেননি; বরং বেছে নিয়েছেন মৌখিক ও গ্রন্থভিত্তিক পাঠের মাধ্যম। নিজ বার্তা পৌঁছানোর জন্য তিনি নবী ও রাসুল পাঠিয়েছেন এবং তাদের কাছে অবতীর্ণ করেছেন বিভিন্ন আসমানি কিতাব। এর মধ্যে চারটি প্রধান, বাকিগুলো সহিফা। এসব কিতাব পাঠের মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর বার্তা বুঝতে ও মেনে চলতে পারে। তাই মুসলমানদের জন্য সব আসমানি কিতাবের প্রতি বিশ্বাস রাখা ঈমানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

শেষ নবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর কাছে প্রথম অবতীর্ণ বাণীও ছিল পাঠের নির্দেশ। আল্লাহ বলেন, ‘পাঠ করো তোমার পালনকর্তার নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে। পাঠ করো, আর তোমার পালনকর্তা মহাদয়ালু। তিনি কলমের মাধ্যমে শিক্ষা দিয়েছেন।’ (সুরা আলাক : ১-৪)। এই বাণীর মাধ্যমে আল্লাহ মানুষকে পাঠের গুরুত্ব বুঝিয়েছেন। এটি ইহজাগতিক ও পারলৌকিক- উভয় ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। পালনকর্তার নামে পাঠ মানুষকে আল্লাহর অসীম সত্তা সম্পর্কে সচেতন করে। একই সঙ্গে তাঁর সৃষ্টির কথা উল্লেখ করে জাগতিক বিষয়ে পাঠে উদ্বুদ্ধ করে। অর্থাৎ পৃথিবীতে মানুষের অবস্থান, প্রাকৃতিক জগৎকে বোঝা এবং জীবনের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হওয়া। গ্রন্থভিত্তিক পাঠ শুধু লিখিত উপায়েই সম্ভব; এজন্য কলমের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। কলমের মাধ্যমেই লেখা ও পাঠের অস্তিত্ব নিশ্চিত হয়। একইভাবে, ‘কোরআন’ শব্দটিও পাঠের ধারণা প্রকাশ করে। এর শব্দমূল ‘কারাআ’, যার অর্থ পাঠ করা বা একত্র করা। তাই কোরআনের শাব্দিক অর্থ হলো ‘পাঠ্যগ্রন্থ’। ‘হে আল্লাহ, আমাকে যা শিখিয়েছেন, তা আমার জন্য উপকারী করুন এবং আমাকে এমন জ্ঞান দান করুন যা আমার উপকারে আসবে, আর আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করে দিন।’ (তিরমিজি : ৩৫৯৯)।

যারা পাঠ করে না, জ্ঞান আহরণ করে না, শুধু অমূলক ধ্যানধারণা নিয়ে চলে, কোরআনে তাদের নিন্দা করা হয়েছে। বনি ইসরায়েল সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘তাদের মধ্যে কিছু লোক আছে নিরক্ষর, যারা কিতাবের কোনো জ্ঞান রাখে না। ভিত্তিহীন আশাই তাদের একমাত্র অবলম্বন এবং তারা নিছক ধারণা ছাড়া আর কিছুই অনুসরণ করে না।’ (সুরা বাকারা : ৭৮)। রাসুল (সা.) বারবার জ্ঞান অর্জনে উৎসাহিত করেছেন; পাঠ করতে ও শিখতে বলেছেন। পাঠের মৌলিক উদ্দেশ্যই হলো- জ্ঞান অর্জন করা। মুসলিম ইতিহাসে দুই ধরনের পাঠচর্চাই দেখা যায়- মৌখিক পাঠ, অর্থাৎ শিক্ষকের কাছ থেকে শুনে ছাত্রের জ্ঞান অর্জন এবং গ্রন্থভিত্তিক পাঠ, যা পরবর্তীকালে অধিক প্রচলিত হয়। ইসলামের ইতিহাসের শুরুর দিকে মৌখিক পাঠের প্রচলন বেশি ছিল। মানুষ শুনে শুনে সবকিছু মুখস্থ করে রাখত। তবে লিখিত পাঠের যে একদমই প্রচলন ছিল না, এমনটা দাবি করা যায় না। বিভিন্ন কবিতা লিখে কাবার দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা হতো। সাহাবিগণও কোরআনের বিভিন্ন বাণী গাছের বাকল, পাতা, পাথর ও কোডেক্সে লিখে রাখতেন।

পাঠের ক্ষেত্রে ইসলামে কোনো সীমারেখা টানা হয়নি। এজন্যই রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘জ্ঞান হলো মুমিনের হারানো সম্পদ। যেখানেই তা পাবে, সে-ই তার প্রকৃত অধিকারী।’ (তিরমিজি : ২৬৮৭)। তবে ইসলামি বোঝাপড়ায় কী পাঠ করা হবে, তা নিয়ে কোনো বিভাজন আছে কি? আছে। তবে সেটা ‘ধর্মীয়’ ও ‘জাগতিক’ বিভাজন নয়, বরং উপকারী ও অপকারী জ্ঞানের বিভাজন। এজন্যই রাসুল (সা.) উপকারী জ্ঞানের জন্য প্রার্থনা করে বলেছেন, ‘হে আল্লাহ, আমাকে যা শিখিয়েছেন, তা আমার জন্য উপকারী করুন এবং আমাকে এমন জ্ঞান দান করুন যা আমার উপকারে আসবে, আর আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করে দিন।’ (তিরমিজি : ৩৫৯৯)।

কোরআনে তুলে ধরা হয়েছে পূর্ববর্তী ধর্মগ্রন্থগুলোতে অনুসারীদের করা বিকৃতি। সমালোচনা করা হয়েছে কবিদের কল্পনার উপত্যকায় উ™£ান্ত বিচরণের। কিন্তু ইসলামি ইতিহাসে এমন কোনো বর্ণনা পাওয়া যায় না, যেখানে রাসুল (সা.) কোনো ধর্মগ্রন্থ বা কবিতার বই- যা আরবদের সাহিত্যচর্চার অন্যতম মাধ্যম ছিল- নিষিদ্ধ বা বাজেয়াপ্ত করেছেন। পাঠ নিষিদ্ধ করার পক্ষে কেউ কেউ একটি ঘটনাকে যুক্তি হিসেবে উপস্থাপন করেন। ওমর (রা.) একবার আল্লাহর রাসুলের কাছে তাওরাতের একটি পাণ্ডুলিপি এনে বললেন, এটি তাওরাতের একটি কপি। আল্লাহর রাসুল (সা.) তখন বিবর্ণ মুখে বলেছিলেন, ‘(তাওরাতের নবী) মুসা (আ.) যদি এখন জীবিত থাকতেন এবং আমার নবুয়তের যুগ পেতেন, তাহলে তিনিও নিশ্চয়ই আমার অনুসরণ করতেন।’ (দারিমি : ৪৩৫)।

তবে এই বর্ণনাটিকে বই পাঠ নিষিদ্ধ করার প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা যায় না। এ সম্পর্কে শায়েখ উমর বিন মাহমুদ বলেছেন, এই বর্ণনা প্রকৃতপক্ষে তাওরাত অনুসরণ না করার পক্ষে; নিছক পাঠ নিষিদ্ধ করার পক্ষে নয়। এখান থেকে বোঝা যায়, জানা, গবেষণা ও চিন্তা করার জন্য তা পড়ায় কোনো অসুবিধা নেই। বরং অনুসরণ করা বা মান্য করাই নিষিদ্ধ। ইমাম আহমাদ বিন হাম্বলকে এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করেছিল, আপনি কি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হাদিসচর্চা করেন? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ওটা তো অনেক মহান উদ্দেশ্য। আমি তো হাদিসচর্চা করি ভালোবাসা থেকে। অনুসরণ না করার শর্তে পাঠ করা যে অনুমোদিত, তা অন্য একটি বর্ণনা থেকেও বোঝা যায়। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘বনি ইসরায়েল থেকে তোমরা বর্ণনা গ্রহণ করতে পারো, এতে কোনো অসুবিধা নেই।’ (বোখারি : ৩৪৬১)। এজন্যই সাহাবিদের জীবনে দেখা যায়, তারা বনি ইসরায়েলের অনেক ঘটনা ও উক্তি বর্ণনা করেছেন। আবদুল্লাহ বিন আমর বিন আস (রা.) ইসরায়েলি অনেক কিতাব ও সহিফা সংগ্রহ করেছিলেন। (ফান্নুল কিরাআহ, পৃষ্ঠা : ১১)।

পাঠের ক্ষেত্রে ইসলাম যে কতটা গুরুত্বারোপ করেছে, তাই মুসলমানদের জীবনে প্রতিফলিত হয়েছে। ইসলামি ইতিহাস পাঠচর্চার উদাহরণে পরিপূর্ণ। ইমাম আহমাদ বিন হাম্বলকে এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করেছিল, আপনি কি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হাদিসচর্চা করেন? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ওটা তো অনেক মহান উদ্দেশ্য। আমি তো হাদিসচর্চা করি ভালোবাসা থেকে। (ফান্নুল কিরাআহ, পৃষ্ঠা : ৪৫)।

ইসলামে পাঠের গুরুত্ব শুধু ইবাদতের গণ্ডিতে আবদ্ধ নয়, বরং তা মানুষের চিন্তা, সংস্কৃতি ও সভ্যতার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। প্রথম ওহির নির্দেশনা থেকে শুরু করে মুসলিম সমাজের দীর্ঘ ইতিহাস- সর্বত্রই পাঠ হয়ে উঠেছে জীবনচর্চার এক মৌলিক অংশ। মৌখিক হোক বা লিখিত, পাঠের মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর বার্তার সঙ্গে সংযুক্ত হয় এবং পৃথিবীর বাস্তবতাকেও নতুন চোখে আবিষ্কার করে। তাই ইসলামি ঐতিহ্যে পাঠ শুধু জ্ঞান আহরণের প্রক্রিয়া নয়, বরং এক ধারাবাহিক বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক অভিযাত্রা- যা মানুষকে সত্য, সৌন্দর্য ও প্রজ্ঞার পথে এগিয়ে দেয়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত