ঢাকা মঙ্গলবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১ পৌষ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ড. সাআদ মসলুহ

আরবি ভাষার কণ্ঠ ও বাগ্মিতার জাদুকর

রোকন এনাম লোবান
আরবি ভাষার কণ্ঠ ও বাগ্মিতার জাদুকর

অধ্যাপক ড. সাআদ মসলুহ নামটি উচ্চারিত হলেই যেন ভেসে ওঠে এমন এক আলোকিত ব্যক্তিত্বের প্রতিচ্ছবি, যিনি ভাষাবিজ্ঞানের গভীরতা আর সাহিত্যের সূক্ষ্ম রসকে একীভূত করে তুলেছিলেন জ্ঞানের পরিপূর্ণ রূপে। তিনি একাধারে নিখুঁত ব্যাকরণবিদ, সূক্ষ্ম অনুভূতির অলঙ্কারতত্ত্ববিদ এবং এমন এক ভাষাশিল্পী যিনি কবিতা না লিখেও ভাষাকে কবিতায় রূপ দিয়েছিলেন।

সাঈদ মসলুহ ভাষাকে শুধু গবেষণার বিষয় হিসেবে দেখেননি; তিনি ভাষার ভেতর দিয়ে জীবনকে উপলব্ধি করেছেন, অনুভব করেছেন এর প্রাণ। তার কাছে আরবি ভাষা ছিল বিশ্বাসের মতোই নির্মল ও পবিত্র। তার কথায় সেই পবিত্রতা ঝরে পড়ে যেন ঝরনার স্রোতে সূর্যের আলো ঝিকমিক করে ওঠে, স্বচ্ছ, স্নিগ্ধ, তৃষ্ণাহর।

একাডেমিক জীবন ও জ্ঞানভাণ্ডার : ড. সাআদ মসলুহ আরব বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠগুলো থেকে শিক্ষা অর্জন করেন এবং ভাষাবিজ্ঞানে উচ্চতম ডিগ্রিতে সমৃদ্ধ হন। তার গবেষণায় তত্ত্বের বিশ্লেষণ আর প্রয়োগের বাস্তবতা মিলেমিশে এক আশ্চর্য সেতুবন্ধ তৈরি করেছে। তিনি আধুনিক ভাষাতত্ত্ব ও বাগভঙ্গি বিশ্লেষণে এমন এক স্বকীয় দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেছেন, যা আজও শিক্ষাবিদদের মধ্যে সম্মানের সঙ্গে উচ্চারিত হয়। বহু দশক ধরে তিনি শিক্ষকতার মাধ্যমে শত শত শিক্ষার্থীকে আলোকিত করেছেন। তার কাছে শিক্ষকতা ছিল শুধু পেশা নয়, এক নিবেদন, এক নীরব সাধনা। ভাষা তার জন্য ছিল আরাধনা, আর প্রতিটি ক্লাসরুম ছিল যেন এক প্রার্থনালয়, যেখানে তিনি শব্দের পবিত্রতা ও ভাবের মর্যাদা শিখিয়েছেন।

ভাষাচিন্তা ও দর্শনের বৈশিষ্ট্য : সাআদ মসলুহের ভাষা-ভাবনা ছিল গভীর, প্রাণবন্ত ও চিন্তাশীল। তিনি ভাষাকে শুধু ব্যকরণের খোলস হিসেবে দেখেননি; বরং দেখেছেন এক জীবন্ত সত্তা হিসেবে, যা মানুষের সংস্কৃতি, মনন ও আত্মার সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত।

তার চিন্তার কিছু প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল : তিনি ভাষাকে ভাব, রূপ ও প্রেক্ষাপটের সমন্বয়ে বিশ্লেষণ করতেন, যেন প্রতিটি শব্দের ভেতর দিয়ে মানবচিন্তার স্পন্দন ধরা পড়ে।

ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মেলবন্ধন : তিনি বিশ্বাস করতেন, ঐতিহ্য কোনো শৃঙ্খল নয়, বরং নতুন চিন্তার উর্বর মাটি। তাই তিনি প্রাচীন জ্ঞানের ভেতর ওপর আধুনিক গবেষণার মিনার গড়ে তুলেছেন। তার লেখনী ছিল যুক্তিসমৃদ্ধ, সংযত ও সত্যনিষ্ঠ। তিনি সমালোচনায় কখনো তীক্ষè হলেও তা ছিল ন্যায়সঙ্গত, নম্র অথচ দৃঢ়। তার কাছে আরবি শুধু যোগাযোগের উপকরণ নয়, এটি ছিল সভ্যতার আত্মা, চিন্তার প্রতিফলন ও বিশ্বাসের আলোকরেখা।

লেখনীর সৌন্দর্য ও ভাষার সুর : সাআদ মসলুহের লেখায় যুক্তির দৃঢ়তা যেমন আছে, তেমনি আছে ভাষার সুরেলা লাবণ্য। তিনি একদিকে বিজ্ঞানের নির্ভুলতা রক্ষা করেছেন, অন্যদিকে সাহিত্যের স্নিগ্ধতা অক্ষুণ্ণ রেখেছেন। তার রচনাগুলো পড়লে মনে হয়, চিন্তা ও ছন্দ যেন একে অপরের হাত ধরে নৃত্য করছে বুদ্ধি ও সৌন্দর্য এক হয়ে উঠেছে এক অবিচ্ছেদ্য সুরে।

সম্মান ও স্বীকৃতি : ২০২৫ সালে সৌদি আরবের মজমা আল-মালিক সালমান আল-আলামি লিলুগাহ আল-আরাবিয়া তাকে আরবি ভাষা ও তার গবেষণায় আজীবন অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সম্মানিত করে। তিনি এই মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার অর্জন করেন লেবাননের বিশিষ্ট ভাষাবিদ অধ্যাপক রমজি মুনির বালাবাক্কির সঙ্গে যৌথভাবে। এই পুরস্কার শুধু একটি পদক নয়, এটি অর্ধশতাব্দীর নিবেদিত পরিশ্রম, সততা ও অধ্যবসায়ের পরম স্বীকৃতি।

আরবি ভাষা যেন এই পুরস্কারের মাধ্যমে নিজেরই এক অনন্ত সাধকের কপালে চুম্বন এঁকে দিয়েছে।

প্রভাব, উত্তরাধিকার ও অনুপ্রেরণা : ড. সাআদ মসলুহ শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে সীমাবদ্ধ নন; তিনি তার ছাত্র, পাঠক ও অনুরাগীদের হৃদয়ে জীবন্ত অনুপ্রেরণা হয়ে আছেন। তার শেখানো ভাষাপ্রীতি আজও অসংখ্য মানুষের চিন্তায় আলো জ্বালায়। তিনি বিশ্বাস করতেন, ভাষা কোনো বিলাসিতা নয় এটি জাতির আত্মা, সংস্কৃতির পরিচয় এবং সভ্যতার শিকড়। তার নাম আজও আরবি ভাষাতত্ত্বের আধুনিক ধারায় উজ্জ্বল বাতিঘর হয়ে জ্বলজ্বল করছে, যেখানে আলো মিশেছে প্রজ্ঞায়, আর প্রজ্ঞা মিশেছে সৌন্দর্যে।

ভাষার মাথায় এক গর্বের মুকুট : গ্লোবাল আরবি ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যাওয়ার্ডে জয় তার সাফল্যের বাহ্যিক প্রতীক হলেও, প্রকৃত বিজয় নিহিত আছে মানুষের হৃদয়ে। ভাষা তাকে ভালোবেসে মুকুট পরিয়েছে; আরবি তাকে নিজের সন্তান বলে গর্ব করেছে। তিনি তাদের একজন, যারা চলে যান না, যাদের চিন্তা, শব্দ, শিক্ষণ ও মানবিকতা প্রজন্মের পর প্রজন্মে আলো হয়ে বেঁচে থাকে। তার জীবন যেন এক মহাকাব্য, যেখানে প্রতিটি শব্দ দীপ্তি ছড়ায়, প্রতিটি বাক্য হয়ে ওঠে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও প্রেরণার প্রতীক।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত