ঢাকা মঙ্গলবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১ পৌষ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

চাটমোহর শাহি মসজিদ

মোস্তফা কামাল গাজী
চাটমোহর শাহি মসজিদ

পাবনা জেলার অন্যতম প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র চাটমোহর এক সময় মোঘল আর পাঠানদের অবাধ বিচরণভূমি ছিল। ১৫৮১ খ্রিষ্টাব্দে মাসুম খাঁ কাবলি নামের সম্রাট আকবরের এক সেনাপতি একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। এটিই আজকের চাটমোহর শাহী মসজিদ নামে পরিচিত। বইপত্রে যাকে এখনো মাসুম খাঁ কাবলির মসজিদ বলেই উল্লেখ করা হয়। মাসুম খাঁ কাবলি ১৫৫৫ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি খোরাসানের কাকশাল গোত্রের মানুষ ছিলেন। ১৫৭৫ সালে ২০ বছর বয়সে সম্রাট আকবরের সৈন্য দলে যোগ দেন।

যুবক মাসুম খাঁ কালা পাহাড় নামে শত্রু সেনাপতিকে যুদ্ধে পরাজিত করে স্বীকৃতি স্বরূপ পাঁচ হাজার সৈন্যের সেনাপতি পদে দায়িত্ব পান। সম্রাট আকবর দ্বীন-ই-ইলাহি নামে নতুন ধর্ম ঘোষণা করায় কাকশাল গোত্র ও বাংলার মুসলমান ভুঁইয়ারা বিদ্রোহ ঘোষণা করেন।

১৫৭৯ সালে মাসুম খাঁ বারো ভূঁইয়াদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে চাকরি ছেড়ে দিয়ে বার ভূঁইয়াদের সঙ্গে যোগ দেন। কিন্তু সম্রাট আকবরের প্রধান সেনাপতি ও গভর্নর শাহববাজ খাঁনের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে তিনি পালিয়ে যান। পরবর্তীতে ১৫৯৯ সালে ৪৪ বছর বয়সে সম্রাটের ফৌজি বাহিনীর হাতে মৃত্যুবরণ করেন। তার পুরো নাম ছিল সৈয়দ আবুল ফতে মোহাম্মদ মাসুম খাঁ। এই মসজিদটি সম্রাট আকবরের অধীনতা অস্বীকার করে চাটমোহরে স্বাধীন ক্ষমতা পরিচালনার সময় নির্মিত।

মসজিদের বাইরে রয়েছে ছোট্ট ব্লেসমেন্ট। ভেতরের দৈর্ঘ্য ৩৪ হাত, প্রস্থ ১৫ হাত, উচ্চতা প্রায় ৩০ হাত। ক্ষুদ্র পাতলা নকশা খচিত লাল জাফরী ইটে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। মসজিদের দেয়ালটি সাড়ে চার হাত প্রশস্থ। তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটির সামনের দেয়ালের গায়ে কালেমা তাইয়েবা লিখিত একটি কালো পাথর এখনও প্রোথিত রয়েছে।

মসজিদের উপরিভাগে রয়েছে তিনটি গম্বুজ। সম্মুখভাগে তিনটি খিলান আকৃতির একটি গেট রয়েছে। পশ্চিমপাশে এরকম খিলান আকৃতির আরও দুইটি গেট আছে। মসজিদের অভ্যন্তরে মেহরাবের চারদিকে রয়েছে ইটের সুন্দর কারুকার্য। অভ্যন্তরে আরও রয়েছে ছোট ছোট চারটি কুলুঙ্গী। মসজিদের বাইরে এবং ভেতরে দেয়ালের গায়ে জাফরী ইটের সুন্দর কারুকার্য দেখা যায়।

অনেকের মতে, এই খিলান পরিকল্পনার মূলে আছে প্রাচীন পারস্যের সাসনীয় স্থাপত্যের প্রভাব। সাসনীয় আমলে (২১২-৬৫১ খ্রি.) ইরানে এ রকম খিলান তৈরির কৌশল উদ্ভব হয়েছিল। মাসুম খাঁ কাবুলী নির্মিত মসজিদটির ভেতরে একটি কালো বর্ণের ফলক ছিল, যা এখন রাজশাহী বরেন্দ্র মিউজিয়ামে রক্ষিত আছে। ফলকে খোদাইকৃত ফার্সি অক্ষরে মসজিদ নির্মাণের ইতিহাস লিপিবদ্ধ আছে। এক সময়ে মসজিদটি ধবংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। ১৯৮০-এর দশকে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এটিকে পুনঃনির্মাণ করে।

যদিও এটি মুঘল আমলে নির্মিত, কিন্তু এগুলো বর্তমান রূপে এ অঞ্চলের সুলতানি স্থাপত্য রীতির সুস্পষ্ট প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এর মধ্যে রয়েছে বক্র কার্নিস, দ্বিকেন্দ্রীক সুঁচালো খিলান, অর্ধবৃত্তাকারের মেহরাব স্কন্ধ ও শীর্ষ চূঁড়াবিহীন গম্বুজ। ছাদ পর্যন্ত উঁচু পার্শ্ববুরজ, গম্বুজ নির্মাণে বাংলার পেন্ডেনটিতের ব্যবহার সবই সুলতানি স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য। তবে সুলতানি রীতির এসব বৈশিষ্ট্য থাকলেও অন্ততপক্ষে মসজিদের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনায় এ রীতি থেকে বেরিয়ে আসার প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। বাংলায় তিন গম্বুজ মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছিল এখানেই। পরবর্তীকালে এ পরিকল্পনার সম্প্রসারণ ও পরিবর্তিত রূপ দীর্ঘদিন ধরে এ অঞ্চলের স্থাপত্য প্রভাব বিসস্তার করেছিল।

মসজিদ স্থাপত্যের এ রীতিতে উত্তর ভারতের প্রভাব রয়েছে। এর উদাহরণ পাওয়া যায় প্রথম লোদি ও শুর আমলে। পরবর্তী সময়ে এই পরিকল্পনার আরও বিকাশ ঘটে এবং মুঘল আমলজুড়েই এর প্রয়োগ দেখা যায়। উত্তর ভারতীয় রীতিতে উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ এবং তাকে নিয়ে ঘিরে রিওয়াকবিশিষ্ট পরিকল্পনার পরিবর্তে তিন গম্বুজ বিশিষ্ট প্রার্থনাকক্ষ নির্মাণে মুগল রীতি মসজিদ নির্মাণ পরিকল্পনার একটি পরিপুর্ণ রূপ হিসেবেই বিবেচিত হয়। দিল্লির সুনহেরি মসজিদ কিংবা আগ্রার তাজমহলের পাশে নির্মিত মসজিদ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এ ধরনের ভারতীয় মসজিদ পরিকল্পনাকে বলা যেতে পারে পারস্যের মাহম্মাদিয়ায় অবস্থিত ইওয়ান-ই-কারখা অথবা মায়াদে অবস্থিত মুসাল্লা-এর পরিবর্তিত রূপ।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত