ঢাকা সোমবার, ০৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

নুরুল রশীদ আখতার (রহ.)-এর ফারসি প্রতিভা ও চিন্তাদর্শন

প্রফেসর ড. মো. নূরে আলম
নুরুল রশীদ আখতার (রহ.)-এর ফারসি প্রতিভা ও চিন্তাদর্শন

প্রাচীনকাল থেকে অসংখ্য সুফিসাধক ইসলামের বাণী নিয়ে বঙ্গদেশে এসেছেন। বাংলাদেশের মানুষ যখন সূফিতত্ত্বের শিক্ষা ভুলে গিয়ে দুনিয়ামুখী হয়ে পড়েছিলেন, তখনই আবির্ভাব হয়েছিলেন এ শতাব্দীর মহান সাধক, শ্রেষ্ঠ অলি, আধ্যাত্মিক নেতা, সুফি গবেষক ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার কিংবদন্তি মনীষী শাহ সুফি হজরত নুরুল রশীদ আখতার (রহ.)। বিস্ময়কর ধীশক্তি সম্পন্ন প্রতিভাবান এ মনীষী অপূর্ব দক্ষতা, নিজস্ব যোগ্যতা, বস্তুনিষ্ঠ গবেষণা ও সাহিত্য সম্ভারের মাধ্যমে সুফিবাদী ভক্ত, অনুরক্ত ও গবেষকদের জন্য এক বিশাল ভূবন সৃষ্টি করেছেন। এ জ্ঞান তাপস এমনই এক প্রতীকী নাম যিনি আধ্যাত্মিক চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিত্বে উন্নীত হয়েছিলেন। তিনি যেন জ্ঞান সাধনা ও অনুশীলনের পথে এক প্রবহমান নদী ও ঝরনাধারা। একইসঙ্গে ধর্মশাস্ত্র, দর্শনশাস্ত্র, সুফিবাদ ও কাব্য সাহিত্যে অসাধারণ পাণ্ডিত্য তাকে দিয়েছে প্রকৃত জীবনের সন্ধান। আমৃত্যু জ্ঞান তাকে দিয়েছে দিশা, আমল দিয়েছে ভরসা এবং আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে করেছে পারদর্শী। দূরদৃষ্টি, দূরদর্শিতা ও প্রজ্ঞা তাকে করেছে আপসহীন। সুফিবাদ এক উদার, সহনসীল প্রেমময় ও অসাম্প্রদায়িক আদর্শ। তিনি এ আদর্শকে উজ্জীবিত করতে গিয়ে আল্লাহর পথে উৎসর্গিত হয়েছিলেন। নুরুল রশীদ আখতার (রহ.) ছিলেন ফারসি ও আরবি ভাষা-সাহিত্যে গভীর পাণ্ডিত্যের অধিকারী। গভীর ও দৃঢ় আত্মবিশ্বাসে অনুপ্রাণিত এ শতাব্দীর সুফিতত্ত্বের ইতিহাসের এ বিরল ব্যক্তিত্বের ব্যক্তি চরিত্র, সমাজবদলের রূপরেখা, বর্তমান রাজনৈতিক সমস্যা ও ধর্মীয় গোড়ামিমূলক জঙ্গিবাদের মুলোৎপাটনের চিন্তাদর্শনসহ তার রেখে যাওয়া কর্মময় বর্ণাঢ্য জীবন সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিজ্ঞ জনগোষ্ঠী ও গবেষকদের ভাবিয়ে তুলছে। নুরুল রশীদ আখতার (রহ.) ১৬ ডিসেম্বর ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রামের ওষখাইন আলী নগর দরবার শরিফে আলি রজা কানু শাহ (র.)-এর বংশে আবির্ভাব হয়। তার চিন্তাদর্শন মূলত মানবপ্রেম, আধ্যাত্মিক জাগরণ, সাম্যবাদী চেতনা ও ধর্মীয় সহাবস্থানের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রখ্যাত সুফি সাধক শাহ সুফি আলি রজা কানু শাহ (রহ.)-এর পঞ্চমতম বংশধর নুরুল রশিদ আখতার শাহ নূর সিদ্দীকি দরবেশ মাওলা (রহ.)। তার আশেক ও ভক্তগণ প্রায় ৩৭টি নামে তাকে ভূষিত করেছিলেন। তারই বংশের পূর্ব পুরুষ আবু বকর সিদ্দিক (রা.)। তিনি নকশবন্দিয়া তরিকার অনুসারী ছিলেন। এ মহান সাধক তার অদম্য সাহস, বুদ্ধি, ঈমানি শক্তি ও দেশপ্রেমের আলোকে অসংখ্য সমাজসেবামূলক কাজে অবদান রেখে গেছেন। তার দর্শন সুফি আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ, শিষ্য-পীর সম্পর্ক, ভক্তি ও অন্তরজাগরণমূলক। তার দরবার স্বাস্থ্যশিবির ও সমাজসেবামূলক কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ধর্মীয় কাজের সঙ্গে সমাজসেবা ও মানবসেবাকে যুক্ত করার জন্য তিনি আজীবন চেষ্টা করেছেন। তাঁর মূল দর্শন মানবকেন্দ্রিক। তিনি বিশ্বাস করতেন ‘মানুষের সেবাই মহান আল্লাহর সেবা’। তার মতে, পরম সত্য আল্লাহকে খুঁজে পাওয়া যায় মানুষের মধ্যেই। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র-সব বিভাজনের উধ্বে উঠে মানবপ্রেমকে তিনি সত্য ধর্ম বলে মনে করতেন। নুরুল রশীদ আখতার (রহ.) একজন বিখ্যাত সুফিসাধক, আধ্যাত্মিক ব্যক্তি ও অসাধারণ জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। তিনি আত্মশুদ্ধি, ধ্যান ও প্রেমের আলোকে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করেছেন। তিনি শুধু ধর্মীয় আচারের অনুশীলনকারী ছিলেন না, বরং এক আধ্যাত্মিক দার্শনিক, যিনি ভালোবাসা, সত্য ও মানবকল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। ‘নিজেকে চিনলে আল্লাহকে চিনবে’ এ দর্শনে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি সামাজিক বৈষম্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রাম করেছেন। তার মতে, মানুষের মধ্যে ধনী-গরিব, উঁচু-নিচু কোনো ভোদাভেদ নেই-সবাই আদম সন্তান, সবাই আল্লাহর সৃষ্টি।

নুরুল রশীদ আখতার (র.) শুধু একজন মরমি সাধক বা লোকদার্শনিকই ছিলেন না, তিনি ফারসি ভাষা ও সাহিত্যে দক্ষতা, পারদর্শিতা, গভীর জ্ঞান ও নৈপুণ্যের অধিকারী ছিলেন। তার ফারসি ভাষাদক্ষতা ও সাহিত্যপ্রতিভা তার দর্শন ও গানের মূল ভিতকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। তিনি ফারসি ভাষার সূক্ষ্ম রূপক, প্রতীক ও আধ্যাত্মিক ভাব প্রকাশে বিশেষ পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। তিনি ফারসি শব্দ, প্রবাদ, মানজেল, ইশ্ক, মাশুক, সাকি, সালেক, খাল, ফানা, বাকাবিল্লাহ, তাওহিদ প্রভৃতি সুফি টার্ম অত্যন্ত সাবলীলভাবে ব্যবহার করতেন। তার রচনায় ফারসি ভাবধারার প্রভাব যেমন রয়েছে, তেমনি বাংলার লোকভাষার সঙ্গে তার মেলবন্ধন ঘটেছে, যা এক অনন্য সাহিত্যধারা তৈরি করেছে। ফারসি সাহিত্যের হাফিজ শিরাজী, শেখ সাদি, উমর খৈয়াম, জালাল উদ্দিন রুমি ও ফরিদ উদ্দিন আত্তার প্রমূখ বিখ্যাত কবি ও লেখক এর রচনাগুলো থেকে হযরত নুরুল রশীদ আখতার (রহ.) গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। হাফিজ-এর রূপকধর্মী ইশ্ক চেতনা, রুমির প্রেমভিত্তিক ‘দিব্য প্রেম’ ধারণা, সাদির মানবতাবাদী বাণী, খৈয়ামণ্ডএর বিশ্বভ্রমা- সৃষ্টির দর্শন এবং আত্তার-এর আত্মজাগরণ ও ত্যাগের আহ্বান ইত্যাদি বিষয়গুলো তার লেখনী ও গানে ফুটে উঠেছে। পারস্যের সুফি ঐতিহ্যকে তিনি বাংলার মাটিতে স্থানীয় রীতিতে প্রকাশ করেছেন। এ সুফি সাধকের বাংলায় হামদ নাত ও বিভিন্ন কালামের সংখ্যা প্রায় ২৫০টি এবং উর্দু ও ফারসি হামদ নাত ও বিভিন্ন কালামের সংখ্যা প্রায় ২০০টি। তিনি ফারসি ও বাংলা ভাষার সংমিশ্রণে এক নতুন সাহিত্যভাষা তৈরি করেছিলেন।

তাঁর হামদ, নাত ও গানে ফারসি ও আরবি শব্দের ব্যবহার বিদ্যমান। তিনি এগুলো এমন সহজ, সরল ও প্রাঞ্জল ভাষায় ব্যবহার করেছেন যে, সেগুলো গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছেও বোধগম্য হয়েছে। এভাবে তিনি বাংলা সুফি সাহিত্যের ভাষাগত ঐক্যের সেতুবন্ধন ঘটিয়েছেন। তিনি ১৯৫৮ সাল থেকে তার পূর্বপুরুষদের রচিত সাহিত্যকর্ম সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও অনুলিপি করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৯৫ সালে এ কাজ সমাপ্ত করেন। আলি রজা কানু শাহ্ (রহ.)-এর বাংলা সাহিত্য পাণ্ডুলিপিগুলো মধুরামী ও দেবনাগরী অক্ষরে রচিত। খাজা শাহ্নূর দরবেশ মাওলা (র.) এসব পাণ্ডুলিপি আধুনিক বাংলা অক্ষরে অনুলিপি করেছেন। সুফি কবি আলি রজা কানু শাহ্ (রহ.)-এর অন্যান্য আওলাদের কাছে সংরক্ষিত গ্রন্থগুলোও ১৯৬০-১৯৯০ সালের দিকে অনুলিপি তৈরি করেছেন। সুফি সাধক আলি রজা (র.), তার পূর্বপুরুষ, খলিফা ও বংশধরদের রচিত গ্রন্থাবলি, দেহতাত্ত্বিক ও ভাবগীতিসমূহ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করেছেন।

তিনি ১৯৮৪ সালের দিকে বিভিন্ন বিষয়ে বেশ কয়েকটি অজিফাও রচনা করেন। ১৯৬০ সালে তিনি একটি অজিফা লিখেন- যা তার নির্জনবাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তিনি তাসাউফ ও মারেফাতের গভীর জ্ঞান অর্জন করেছেন। এ সুফি সাধক কর্মজীবনের পাশাপাশি কঠিন পরিশ্রম ও অর্থের বিনিময়ে তার পূর্বপুরুষদের রচিত প্রায় ১২৫টি গ্রন্থ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করেন যা মূলত ফারসি, আরবি এবং বাংলা (মধুরামী ও দেবনাগরী) ভাষায় রচিত। মধুরামী ও দেবনাগরী অক্ষরে রচিত গ্রন্থগুলোকে তিনি আধুনিক সরল বাংলায় রূপান্তর করেছেন। প্রতি বছর ১৩ অক্টোবর নূরীয়া বিষু দরবার শরীফে এসব অমূল্য প্রাচীন গ্রন্থ ও আসবাবপত্রগুলো প্রদর্শন করা হয়। মরমি গান, দার্শনিক কবিতা ও ভাবগান-এর মাধ্যমে মূলত তার সাহিত্য প্রতিভা প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর গানে শুধু ধর্মীয় চেতনা নয়, ভাষার সৌন্দর্য, উন্নতমানের শব্দ চয়ন, ফাসাহাত ও বালাগাত, ছন্দ, অলংকার ও উচ্চমানের প্রতীক ব্যবহৃত হয়েছে। তিনি কখনও রূপকভাবে প্রেমিক-প্রেমিকার সম্পর্কের মাধ্যমে মাওলানা রুমির বাশির সুরের আলোকে শ্রষ্টা ও আত্মার মিলন ব্যাখ্যা করেছেন যা ফারসি সুফি কাব্যের একটি ঐতিহ্যবাহী রীতি। ফারসি জ্ঞান তাকে সুফি তত্ত্বের মূল উৎসে পৌঁছে দিয়েছে। ফলে তাঁর দর্শন শুধু লোকজ নয়, বরং গভীর আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক ভিত্তিসম্পন্ন। তিনি ফারসি ভাষার মাধ্যমে যে ‘অন্তর্জাগরণের পথ’ দেখিয়েছেন, তা তাকে শুধু একজন কবি নয়, একজন দার্শনিক, সাহিত্যিক ও সফি সাধক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তার ফারসি প্রভাবিত ভাবগানগুলোর সাহিত্য বিশ্লেষণ করলে তাঁর চিন্তা, ভাষা ও কাব্যরীতি-সব মিলিয়ে এক অনন্য মরমি ধারার চিত্র ফুটে ওঠে।

মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁছার জন্য সুফিগণ ‘সামা-সঙ্গীত’কে অবলম্বন বলে মনে করেন। এটা ধর্মীয় সঙ্গীত। যা মানব হৃদয়কে কোমল করে এবং মানুষের চিত্ত ও মননকে খোদাপ্রেমে আপ্লুত করে। মাওলানা রুমি কর্তৃক প্রবর্তিত মৌলাভিয়া তরিকার অনুসারীরা ইউরোপ-আমেরিকায় ‘নৃত্যপর দরবেশ’ নামে পরিচিত। কারণ, তারা বাদ্য সহকারে গান গেয়ে ঘুরে ঘুরে বৃত্তাকারে নাচেন। হযরত নুরুল রশীদ আখতার (রহ.) তার নিজ বাসভবনে নিয়মিতই সূফিতাত্ত্বিক আলোচনার পর সামার আয়োজন করতেন। তার ভক্তদের সঙ্গে নিয়ে তিনি সামার মাধ্যমে মহাপ্রভুর প্রেমে-আত্মহারা হয়ে হৃদয়ে আনন্দ অনুভব করতেন। এখনও তার সুযোগ্য সন্তান শাহ সুফি হযরত মাওলানা মঈনুদ্দীন নূরী আল কুরাইশী সাহেব এ রীতি ও ধারাবাহিকতা বহাল রেখেছেন। বিখ্যাত সুফি যুন্নুন মিসরির মতে, সামা সত্যকে আনয়ন করে; হৃদয়কে আন্দোলিত করে সত্যের দিকে ধাবমান করে। হযরত নুরুল রশীদ আখতার (র.) তাঁর পূর্ববর্তী সুফিগণ কর্তৃক প্রবর্তিত সামার মাধ্যমে মহান আল্লাহর প্রেমে বিভোর হওয়ার প্রথারও বিকাশ ঘটিয়েছেন। নুরুল রশীদ আখতার (রহ.)-এর ফারসি ভাষা দক্ষতা ছিল তার সুফি দর্শনের প্রাণ। তার সাহিত্য প্রতিভা সে ভাষাজ্ঞানকে ব্যবহার করে বাংলা ভাষায় এক অনন্য লোক সুফি সাহিত্য সৃষ্টি করেছে। ‘মানুষের মধ্যে আল্লাহকে দেখা, প্রেমের মাধ্যমে আত্মাকে জাগ্রত করা এবং সমাজে সাম্য ও সহাবস্থানের চেতনা প্রতিষ্ঠা করা হযরত নুরুল রশীদ আখতার (রহ.)-এর চিন্তাদর্শনের মূল বিষয়। এ মহান মহান মনীষী, ধর্মীয় শিক্ষাগুরু ও সুফি সাধক ১৩ অক্টোবর ২০১১ খ্রিষ্টব্দে ইন্তেকাল করেন।

লেখক : অধ্যাপক, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত