ঢাকা সোমবার, ০৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ঐতিহাসিক নয়াবাদ মসজিদ

মোস্তফা কামাল গাজী
ঐতিহাসিক নয়াবাদ মসজিদ

দিনাজপুরের নয়াবাদ মসজিদটি বেশ পুরোনো। এটি রংপুর বিভাগের দিনাজপুরে অবস্থিত। দিনাজপুর জেলাশহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে কাহারোল উপজেলার নয়াবাদ গ্রামে ১.১৫ বিঘা জমির ওপর নির্মিত এই মসজিদ কালের সাক্ষী হয়ে আজো দাঁড়িয়ে আছে।

আজ থেকে প্রায় ৩০০ বছর আগে (১৭২২ সাল) তৎকালীন দিনাজপুরের মহারাজা প্রাণনাথ বর্তমান কাহারোল উপজেলার কান্তনগর গ্রামে একটি মন্দির নির্মাণের জন্য মধ্যপ্রাচ্য (সম্ভবত মিসর) থেকে একদল কারিগর আনেন। কারিগরদের সবাই ছিলেন মুসলমান ও ধর্মপ্রিয়। মন্দির নির্মাণ করতে এসেও ভুলেনি নিজ ধর্ম পালন করতে। নির্মাণকালীন সময় মন্দিরের পাশেই খোলা আকাশের নিচে নামাজ আদায় করতেন তারা। এরমধ্যে কারিগরদের প্রধান নেয়াজ ওরফে কালুয়া মিস্ত্রি মহারাজার দরবারে গিয়ে সব মিস্ত্রিদের থাকা ও ধর্ম পালনের নিমিত্তে একটি মসজিদ নির্মাণের জায়গা চান। এ সময় মহারাজা মন্দির থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরত্বে ঢেপা নদীর পশ্চিম কোল ঘেঁষে অবস্থিত নয়াবাদ গ্রামে ১.১৫ বিঘা জমি মসজিদ নির্মাণের জন্য জায়গা দেন। এ ছাড়া মসজিদের পাশে থাকার জন্য একটা বাড়ি করার নির্দেশ দেন মহারাজা। তার নির্দেশ অনুযায়ী মিস্ত্রিরা মন্দিরের পাশাপাশি নয়াবাদ গ্রামে নিজেদের থাকার বাড়ি ও নামাজ আদায়ের জন্য মসজিদ নির্মাণ কাজ চালিয়ে যান। নয়াবাদ মসজিদ নির্মাণের পর তারা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতেন সেখানে।

মহারাজা প্রাণনাথের মৃত্যুর পর তারই দত্তক ছেলে মহারাজা রামনাথের আমলে (১৭১৫ সাল) মন্দিরের নির্মাণকাজ শেষ হয়। মন্দিরের পাশাপাশি মসজিদের কাজও শেষ করেন মিস্ত্রিরা। মন্দিরের নির্মাণকাজে কালুয়া মিস্ত্রির নেতৃত্বে আসা মিস্ত্রিরা মন্দির নির্মাণের কাজ শেষে ফিরে যায় নিজ দেশে। কিন্তু এদেশ ছেড়ে যাননি নেয়াজ ওরফে কালুয়া মিস্ত্রি ও তার ছোট ভাই।

নেয়াজ মিস্ত্রি মহারাজার দরবারে ফের হাজির হয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস ও জীবিকা নির্বাহের জন্য মহারাজার কাছে কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহের জন্য কিছু জমির আবদার করেন। তাৎক্ষণিক মহারাজা কিছু জমি তাদের দুই ভাইকে দান করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মিসরীয় এই দুই ভাই মহারাজার দানকৃত জমিতে ফসল আবাদ করে দিনাতিপাত করেন।

মৃত্যুর পর কালুয়া মিস্ত্রি ও তার ছোট ভাইকে নয়াবাদ মসজিদ সংলগ্ন দাফন করা হয়। এই মিস্ত্রিদের নামনুসারে ওই এলাকার নাম হয় নয়াবাদ মিস্ত্রিপাড়া। বর্তমানে মন্দির ও মসজিদ নির্মাণের হেড মিস্ত্রি ও তার ছোট ভাইয়ের বংশধররা নয়াবাদ মিস্ত্রিপাড়ায় বসবাস করছে।

দিনাজপুর জেলার কাহারোল উপজেলার রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের নয়াবাদ মিস্ত্রিপাড়া গ্রামে অবস্থিত ঐতিহাসিক এই নয়াবাদ মসজিদ। বর্তমানে মসজিদটি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধীনে চলছে উন্নয়ন ও সংস্কার কাজ।

মসজিদের উত্তর-দক্ষিণে একটি করে জানালা রয়েছে। দরজা-জানলার খিলান একাধিক খাঁজযুক্ত। যার ভেতরে পশ্চিমাংশে আছে তিনটি মেহরাব। মাঝের মেহরাবের তুলনায় দুপাশেরগুলো একটু ছোট। মাঝের মেহরাবের উচ্চতা ২.৩০ মিটার ও প্রস্থ ১.৮ মিটার। মসজিদজুড়ে আয়তাকার বহু পোড়ামাটির ফলক রয়েছে। পোড়ামাটির নকশাগুলো বহু জায়গায় খুলে পড়েছে। ফলকগুলোর আয়তন দশমিক ৪০ মিটার ও ৩০ মিটার। ফলকগুলোর মধ্যে লতাপাতা ও ফুলের নকশা রয়েছে। এরূপ মোট ১০৪টি আয়তাকার ফলক রয়েছে। তবে ফলকের মধ্যে অলংকরণের অনেকটাই প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত।

আয়তাকার মসজিদটি তিন গম্বুজবিশিষ্ট। এর চারকোণায় রয়েছে চারটি অষ্টভূজাকৃতির টাওয়ার। বাইরের দিক থেকে মসজিদটির দৈর্ঘ্য ১২.৪৫ মিটার ও প্রস্থ ৫.৫ মিটার। দেয়ালের প্রশস্ততা ১.১০ মিটার। মসজিদে প্রবেশের জন্য পূর্বদিকে রয়েছে তিনটি খিলান। মাঝের খিলানের উচ্চতা ১.৯৫ মিটার, প্রস্থ ১.১৫ মিটার। পাশের খিলানদ্বয় সমমাপের এবং অপেক্ষাকৃত ছোট।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর নয়াবাদ মসজিদের অনেক অংশ সংস্কার করে চারপাশ ঘিরে দেয়াল দিয়েছে। মসজিদ এলাকায় পর্যটকদের জন্য করা হয়েছে চলাচল ও বসার ব্যবস্থা। সংযোগ দেওয়া হয়েছে বিদ্যুৎ লাইন, স্থাপন করা হয়েছে সোলারও।

মসজিদটির এখন প্রায় ভগ্নদশা। বৃষ্টি হলে ছাদ চুঁয়ে জল পড়ে। মসজিদের গায়ে পোড়ামাটির যে ১০৪টি আয়তাকার ভাস্কর কারুকার্য রয়েছে, তা সংস্কারের অভাবে খুলে খুলে পড়ছে। দেয়ালে শ্যাওলা জমে ধারণ করেছে বিবর্ণরূপ। মসজিদ প্রাঙ্গণে কোন সীমানা প্রচীর না থাকায় অবাধে প্রবেশ করছে হাঁস, মুরগি ও গরু-ছাগল। এতে নষ্ট হচ্ছে মসজিদের পবিত্রতা।

নেয়াজ ওরফে কালুয়া মিস্ত্রির বংশধর ও নয়াবাদ মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি মাওলানা আবদুল মান্নান জানান, নয়াবাদ মসজিদ অত্র এলাকা ও আশপাশের সবচেয়ে প্রাচীনতম স্থাপনা। প্রাচীন সব ইতিহাসের স্মৃতি বহনকারী নয়াবাদ মসজিদ এখন পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে দেশজুড়ে বেশ পরিচিতি পেয়েছে। বছরজুড়ে দেশ-বিদেশের হাজার হাজার পর্যটক দেখতে ও জানতে আসেন মসজিদের প্রাচীন ইতিহাস। তিনি আরও বলেন, মসজিদটি যে কোন সময় ভেঙ্গে যাওয়ার ভয়ে ভেতরে নামাজ আদায় করা যাচ্ছে না। তাই আবহাওয়া খারাপ হলে আমরা বাইরে বারান্দায় নামাজ আদায় করি। এটা যেকোনো সময় ভেঙে পড়ে ঘটতে পারে দুর্ঘটনা।

মসজিদটি সরাসরি প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ থেকে নিয়ন্ত্রণ হয়ে থাকে। তাই স্থানীয়ভাবে মেরামত করার কোন সুযোগ নেই। ঐতিহাসিক মুঘল আমলের স্থাপাত্য কৃর্তি নয়াবাদ মসজিদ সংস্কার করা হলে প্রাচীনতম মসজিদটি দেখতে পর্যটকদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারবে। বর্তমানে পর্যটকদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোড়দার করা হয়েছে। সার্বক্ষণিক রয়েছে পুলিশের টহল দল।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত