প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫
‘কোনো এক রাতের আঁধারে এখানে নেমে এসেছিল জিন-পরীরা। পুরু দেয়াল আর নানা অলংকরণে তারা তৈরি করতে লাগলো একটি মসজিদ। সবই হলো, কিন্তু গম্বুজ তৈরির আগেই ভোর হয়ে গেল। আজও তাই গম্বুজ ছাড়া দাঁড়িয়ে আছে অসাধারণ কারুকার্যময় মসজিদটি।’
ঠাকুরগাঁও জেলা সদর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরের বালিয়া গ্রামের মসজিদটি সম্পর্কে স্থানীয় কিংবদন্তি এমনই। কিংবদন্তি যেমনই হোক, মসজিদটির সৌন্দর্য নিয়ে প্রশ্ন নেই। কিন্তু কালের থাবায় আর অযত্নে নষ্ট হতে বসেছিল মসজিদটি।
আমাদের দেশে ঐতিহ্যবাহী ভবন সংরক্ষণের জন্য যেসব পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়, তা নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। কোথাও কোথাও সংরক্ষণের নামে বিকৃতি ঘটানোরও অভিযোগ আছে। সোনারগাঁর পানাম সিটি, বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ এবং পাহাড়পুরের সোমপুর বিহার সংরক্ষণের প্রক্রিয়া নিয়ে কম বিতর্ক হয়নি। আর এসব দিক থেকেই অনন্য উদাহরণ হতে যাচ্ছে এই বালিয়া মসজিদটির সংস্কারকাজ। আধুনিক ও বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত পদ্ধতিতে এই মসজিদের সংস্কার করছে প্রত্নতত্ত্ব ইনস্টিটিউট।
ইতিহাস বলছে, স্থানীয় জমিদার গুলমতি চৌধুরী এই মসজিদের নির্মাতা। যদিও বিবি গুলমতি চৌধুরীর নামেই ছিল জমিদারি, কিন্তু কার্যত এলাকা শাসন করতেন তার স্বামী মেহের বকশ। ফলে মসজিদটি তিনিই নির্মাণ করেছিলেন বলে মনে করেন অনেকে।
মসজিদের গায়ে খোদাই করা তারিখ অনুসারে এটি তৈরি হয় বাংলা ১৩১৭ সনে। মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা মেহের বকেশর কবরেও তার মৃত্যুর তারিখ খোদাই করা আছে ১৩১৭ সন।
পরিজনেরা জানান, মসজিদটি নির্মাণ করার জন্য মেহের বকশ বাইরে থেকে স্থপতি নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু কাজ শেষ হওয়ার আগেই স্থপতি মারা গেলে মসজিদের কাজ থেমে যায়। বেশ কয়েক বছর স্থগিত থাকার পর মেহের বকশ স্থানীয় নির্মাতাদের নিয়ে মসজিদের কাজ আবার শুরু করেন। কিন্তু শেষ করার আগেই তিনিও মৃত্যুবরণ করেন।
মেহের বকেশর মৃত্যুর আরও কয়েক বছর পর মসজিদটি আবারও নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেবারও কেন যেন কাজ শেষ হয়নি। স্থানীয় মানুষের তাই বিশ্বাস জন্মে গিয়েছিল, এই মসজিদের কাজ সম্পন্ন হওয়ার নয়।
কাজেই শতাধিক বছর ধরে পরিত্যক্ত থেকে মসজিদটি জঙ্গলের প্রশ্রয়ে পরিণত হয়। এতদিন পর সংরক্ষণের প্রয়োজনে দেয়ালের কিছু অংশ খোলা হয়েছে। সেখানে দেখা গিয়েছে, বর্তমান দেয়ালের ১১ ইঞ্চি ভেতরে একই নকশার আরো একটি দেয়াল। এই ভেতরের দেয়ালটির ইট ও মর্টারের সঙ্গে পরে নির্মিত ইট ও মর্টারের কিছু পার্থক্য রয়েছে।
বিভিন্ন তথ্য মিলিয়ে মসজিদটির সম্ভাব্য বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে ১২০ বছর। উল্লেখ্য, ব্যয়বহুল বলে বয়স নির্ধারণে কার্বন-১৪ বা থার্মালুমেনিসেন্স ধরনের কোনো বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা করা হয়নি।
মসজিদটির আয়তন পূর্ব-পশ্চিমে ৬২ ফুট ৬ ইঞ্চি এবং উত্তর-দক্ষিণে ৬৯ ফুট ২ ইঞ্চি। আয়তাকার এই কমপ্লেক্সটিকে ‘সিঁড়িসহ প্রবেশপথ’, ‘খোলা চত্বর’ ও ‘মূল ভবন বা নামাজঘর’, এই তিনটি অংশে বিভক্ত করা যায়।
দুই গম্বুজবিশিষ্ট প্রবেশপথটি একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ স্থাপত্য । মূল ভবনটি পূর্ব-পশ্চিমে ২৫ ফুট ১১ ইঞ্চি প্রশস্ত। প্রবেশপথ, খোলা চত্বর ও মূল ভবন একই প্লাটফর্মের ওপর অবস্থিত। স্থানভেদে সাড়ে ৩ ফুট থেকে সাড়ে ৪ ফুট গভীর ভিত্তির ওপর ৫ ফুট সাড়ে ৩ ইঞ্চি উঁচু প্লাটফর্মের ওপর মসজিদটি স্থাপিত। প্লাটফর্ম থেকে ছাদের উচ্চতা ১৭ ফুট।
ভিত্তিসহ পুরো মসজিদটিই চুন-সুরকির মর্টার এবং হাতে পোড়ানো ইট দিয়ে নির্মিত। ইটের আকৃতি বর্তমান কালের ইটের মতোই। ইটের রং লাল। ইটে কোনো অলংকরণ না থাকলেও মসজিদের দেয়ালের বিভিন্ন জায়গায় ইট কেটে নকশা তৈরি করা হয়েছে। তাতে কলস, ঘণ্টা, ডিশ, বাটি, আমলকি, পদ্ম প্রভৃতির আকৃতি দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু সেসব অলংকরণ এখন ধ্বংসের মুখে। অনেক জায়গায় ইট ক্ষয়ে গেছে, কোণা ভেঙে গেছে অথবা ফেটে গেছে। ছাদের কয়েক স্তর ইট খুলে পড়ে গেছে। অনেক জায়গায় মর্টার ক্ষয় হয়ে ইট খুলে পড়েছে। গাছের শিকড়ের কারণে প্রায় সব অলংকরণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যেগুলো টিকে আছে, সেগুলোও দেয়াল থেকে আলাদা হয়ে আছে। অলংকৃত স্তম্ভগুলোতেও ফাটল ধরেছে। দক্ষিণ-পূর্ব কোণে স্তম্ভসহ দেয়ালের ওপর থেকে নিচ বরাবর ফেটে গেছে।
দেয়ালের ফাটলে এবং ভবনের বিভিন্ন অংশে এখন সাপ, চিকা, শেয়াল, খাটাশ, খরগোশ, কাঠবিড়ালী, টিকটিকি, বিছা, মাকড়সা, পিঁপড়া, শামুক ও নানা ধরনের পোকামাকড়ের বসতি। এই রকম একটি অবস্থাতেই কেন্দ্র প্রত্নতত্ত্ব ইনস্টিটিউট বৈজ্ঞানিক সংরক্ষণ পদ্ধতিতে পুনর্নির্মিত করছে মসজিদটি। তবে মূল উদ্যোগ এলাকাবাসীর।
সংরক্ষণ প্রক্রিয়ার শুরুতেই স্থাপনাটির ‘বিশদ নথিভুক্তকরণ’ (ডকুমেনটেশন) করা হয়েছে। অর্থাৎ, প্রতিটি অংশের আলোকচিত্র নেওয়া হয়েছে এবং দ্বিমাত্রিক ও ত্রিমাত্রিক ছবি আঁকা হয়েছে। ছোট ছোট অংশের নির্মাণ-উপকরণ ও শৈলী চিহ্নিত করা হয়েছে। সেই সঙ্গে পরীক্ষা করা হয়েছে যে স্থাপনাটির কোন অংশ কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত এবং তা নিরাময়ের জন্য উপযুক্ত পদ্ধতি কী হতে পারে, তার বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।
গাছ, শৈবাল, ছত্রাক, ধুলোয় ঢাকা ভবনটির বিভিন্ন অংশের যথাযথ নথিভুক্তির জন্য আংশিকভাবে ‘শুষ্ক পরিষ্করণ’ (ড্রাই ক্লিনিং) করা হয়।
যেকোনো ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা সংরক্ষণের জন্য নৈতিকতা হলো, প্রতিটি পর্যায়ের প্রতিটি খুঁটিনাটি কাজের বিবরণ রেকর্ড করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, পদ্ধতিটি হতে হবে এমন যে ভবিষ্যতে যদি সংরক্ষণের কোনো আধুনিক পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়, অথবা ভবিষ্যতের সংরক্ষক যদি মনে করেন, আগের সংরক্ষক সঠিক পদ্ধতি ব্যবহার করেননি, তাহলে তিনি যাতে স্থাপনাটি আগের অবস্থায় ফিরে পেতে পারেন।
সংরক্ষণের দ্বিতীয় পর্যায়ে ভবনটিতে সৃষ্ট ফাটল ও গর্তগুলো পূর্ণ করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে ফ্লুরো সিলিকেট-জাতীয় অজৈব লবণ। এটি ভবনটিকে ভেতর থেকে দৃঢ়তা দেয়। উল্লেখ্য, এই পদ্ধতি প্রয়োগের আগে দেয়াল ও ভিত্তিতে ঢুকে যাওয়া শিকড় সরানোর জন্য সালফিউরিক এসিড ইনজেকশন দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে ভবনের দেয়ালে জমে থাকা ধুলো, শ্যাওলা, ছত্রাক, লবণ অপসারণের জন্য যথাক্রমে সাধারণ পানি, ফুটন্ত পানি, হাইড্রোক্লোরিক এসিড ও পেন্টা ক্লোরো ফেনল ব্যবহার করা হয়।
সংরক্ষণের তৃতীয় ধাপে ভবনটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আগের পর্যায়ে যে অবস্থায় ছিল, সে অবস্থায় ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চলছে। অর্থাৎ, যেসব দেয়াল ভেঙে খুলে পড়ে গিয়েছে, তা নতুন করে স্থাপন করা হচ্ছে। প্রথম তৈরির সময় যে আকৃতির ইট ব্যবহৃত হয়েছে, ঠিক একই ধরনের নতুন ইট ব্যবহার করা হচ্ছে।
তবে মসজিদটির গম্বুজ নির্মাণের ক্ষেত্রে আগের শৈলী আর ব্যবহার করা যায়নি। কারণ, মসজিদটির গম্বুজ কখনো তৈরিই হয়নি। ফলে গম্বুজগুলো কেমন হতে পারত, তা এখন আর বলা সম্ভব নয়।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, ফল্স আর্চ পদ্ধতিতেই হয়তো গম্বুজগুলো তৈরির পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু ভবনটিতে যেহেতু কোনো সাপোর্টিং পিলার বা বিম নেই, তাই গম্বুজের ভার দেয়ালগুলো এখন আর দীর্ঘমেয়াদে বহন করতে পারবে না।
এ জন্যই গবেষকেরা মসজিদটির তিনটি গম্বুজ আধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরি করার পরিকল্পনা করছেন।
আধুনিক স্থাপনাশৈলীর সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাশৈলীর পার্থক্য বোঝানোর জন্য আজকাল বিশ্বব্যাপী সংযোজিত অংশটুকু সমসাময়িক প্রযুক্তিতে তৈরি করা হয়।
মসজিদটির প্রাচীন ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য এবং খোলা ইটের স্থায়িত্ব বৃদ্ধির জন্য বর্ণহীন ফ্লুরো সিলিকেটজাতীয় প্রলেপ লাগিয়ে দেওয়া হবে।
কেবল ভবন নয়, গবেষকরা মসজিদ চত্বরটিও বৈজ্ঞানিকভাবে সাজাতে চান। চত্বরে যে ইউক্যালিপটাস লাগানো আছে, তা ভবনের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। কারণ, এই গাছ প্রচুর পরিমাণ পানি শোষণ করে। এ ধরনের গাছ ভিত্তি ও দেয়ালের আর্দ্রতা শোষণ করে ভবনের দৃঢ়তা নষ্ট করে দেয়। তাই ভবনের চারদিকে ইউক্যালিপটাস কেটে সেখানে চন্দন ও শাল গাছ লাগানো হবে। সব মিলিয়ে চলছে মহাযজ্ঞ। উদ্দেশ্য, ঐতিহ্য অবিকৃত রেখে সংরক্ষণ।