
ফেনীতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আওয়ামী লীগের অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের প্রথম শহিদ ইশতিয়াক আহমেদ শ্রাবণ। মায়ের একটা ওড়না মাথায় পেছিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়ে লাশ হয়ে ঘরে ফিরে আসে। তিন ভাই বোনের মধ্যে শ্রাবণ ছিল সবার বড়। সে ২০২৩ সালে ফেনী সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। উচ্চ শিক্ষায় বিশ্ব বিদ্যালয়ে ভর্তির অপেক্ষায় ছিলেন। উত্তাল জুলাইতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ ফেনীতেও তীব্র উত্তাপ ছড়ায়। বুলেটের গর্জনে মুহূর্তে ফেনীর মহিপালে হয়ে উঠে রক্তের হোলি। ৪ আগস্ট ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে সারাদেশে অসহযোগের প্রথমদিন। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ফেনীর মহিপালে শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান নিয়ে আন্দোলন করছিল ছাত্র-জনতা। আওয়ামী দুর্বৃত্তদের গুলিতে তপ্ত দুপুরে রক্তরাঙা সড়কে পড়ে ছিল ইশতিয়াক আহমেদ শ্রাবণের নিথর দেহ। সেখান থেকে বন্ধুরা তাকে উদ্ধার করে ঘরে নিয়ে যায়। এরপর তাকে ফেনী জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে। প্রাথমিক চিকিৎসা ও লাশ দাফনেও বাধা দিয়েছিল ফ্যাসিবাদীরা।
জানা যায়, আন্দোলনের শুরু থেকেই শ্রাবণ সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। ঘটনার দিন ৪ আগস্টও সকাল থেকে তারা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ফেনীর মহিপাল ফ্লাইওভারের নিচে অবস্থান নেন। দুপুর আনুমানিক ২টার দিকে আওয়ামীলীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা অতর্কিতভাবে চারদিক ঘেরাও করে নিরস্ত্র ছাত্রদের ওপর গুলি করতে থাকে। আটটি গুলি এসে বিঁধে শ্রাবণের বুকে-পিঠে, কানে ও একটি হাতে। পরে কয়েকজন মিলে তাৎক্ষণিক শ্রাবণকে উদ্ধার করে ফেনী জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যান। হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে শ্রাবনের বাবা নেছার আহমেদ বলেন, সেদিন আমার শ্রাবণের বন্ধু মাহফুজ তার লাশ নিয়ে এসেছিল। স্থানীয় কিছু মানুষরূপী শয়তান তাড়াহুড়ো করে আমার ছেলেকে দাফন করেছিল। আমি আমার শ্রাবণকে একটু আদর করতে চেয়েছি, তার মুখটা আরও কিছু সময় দেখতে চেয়েছি। তারা সেই সুযোগ আমাকে দেয়নি। হাসপাতাল থেকে লাশ নিয়ে ফেনী পৌর শহরের ৭নং ওয়ার্ডে বাসায় ফিরে এলে দ্রুত সময়ের মধ্যে লাশ দাফন করতে বারবার চাপ প্রয়োগ করা হয়। পরে অল্প সময়ের মধ্যে স্থানীয় অচিন গাছতলায় তার নানা বাড়ির সামনে প্রথম জানাজা, পরে ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার দক্ষিণ আনন্দপুর গ্রামে তার দাদা বাড়ির নিকটবর্তী পারিবারিক কবরস্থানে লাশ দাফন করা হয়। তিনি আরও বলেন, ঢাকার রাজপথে অগণিত শিক্ষার্থীর রক্তস্রোত প্রতিবাদের ঢেউ তুলেছিল ফেনীর ইশতিয়াক আহমেদ শ্রাবণের হৃদয়ে। বিবেকের তাগিদে মায়ের ওড়না মাথায় বেঁধে প্রতিদিন আন্দোলনে চলে যেত সে। পরিবারের কেউ বাধা দিলে বলতো অন্যায়ের প্রতিবাদ না করলে আল্লাহ ক্ষমা করবেন না। নিহত শ্রাবণের মা ফাতেমা আক্তার শিউলি বলেন, আমার ছেলে বলতো,আম্মু এখনি সময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার। আমি বারণ করার পরও সে বৈষম্যমুক্ত দেশ গড়ার চেতনায় প্রতিদিন চলে যেত। আন্দোলনে যাওয়ার সময় আমার একটি ওড়না মাথায় বেঁধে রাখত এবং তার নিজের নাম লেখা একটি জার্সি পরে যেত। তার মামা, বাবা সবাই তাকে বোঝাত কিন্তু সে সবাইকে বলতো, অন্যায়ের প্রতিবাদ না করলে আল্লাহর দরবারে জবাব দিতে হবে। তিনি আরও জানান, মারা যাওয়ার আগের দিন-রাতে (৩ আগস্ট) সে একটু অস্থির আচরণ করছিল। রাত তিনটায় উঠে আমার কক্ষে এসে আমাকে ডাকে, কিছু কথা বলে আবার চলে যায়। সে বলে, তার মায়ের হাতে ভাত খেতে ইচ্ছা করছিল। কিন্তু সে খায়নি। তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে এবং পরবর্তীতে ফজরের নামাজ পড়ে সে ঘুমায়। সেটিই আমার সঙ্গে শেষ কথা ছিল। শহিদ ইফতিয়াক আহমদ শ্রাবনের মা ফাতেমা আক্তার শিউলি বলেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থানে আমার একমাত্র ছেলে শ্রাবনকে আমি হারিয়েছি। আজ এক বছর হতে চলল এখনও আমার ছেলে হত্যার বিচার শুরু হয়নি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখনও জুলাই সনদ ঘোষণা করেনি। ছেলেকে তো আর ফিরে পাবো না প্রয়োজনে আমি রক্ত দেবো তবু জুলাই সনদ ঘোষণা এবং খুনিদের দ্রুত বিচার চাই।
শ্রাবণের এক বাল্যবন্ধু ইফরাদ জানান, জীবনে অনেক বন্ধু পাব কিন্তু শ্রাবনের মতো কেউ আমার জীবনে আসবে না। সে ন্যাশনাল চিলড্রেন’স টাস্ক ফোর্স (এনসিটিএফ) ফেনী জেলার ২০২১-২২ সালের কমিটির সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ফেনী ক্রিকেট একাডেমির সদস্য ছিলেন শ্রাবণ। একাডেমির প্রধান এবং কোচ রিয়াজ উদ্দিন রবিন জানান, ফেনীতে ক্রিকেট প্রশিক্ষণ একাডেমিগুলোর অংশগ্রহণে আয়োজিত দুইটি টুর্নামেন্টে খেলেছিলো শ্রাবণ। চারিত্রিক দিক থেকে সেছিল উদাহরণ যোগ্য।
উল্লেখ্য, শ্রাবণ ২০০৪ সালের ১২ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মায়ের সঙ্গে শহরের বারাহীপুরে বসবাস করতেন, পৈত্রিক বাড়ি ফুলগাজী উপজেলার আনন্দপুর ইউনিয়নে। তিন ভাইবোনের মধ্যে শ্রাবণ সবার বড় এবং পরিবারের একমাত্র ছেলে।
মেজ বোন উসাইমা ইয়াকিন (১৪) অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে ও ছোট বোন আকসা ইয়াকিন (২)। এঘটনায় শ্রাবনের মা ফাতেমা আক্তার বাদী হয়ে ফেনী-২ সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারীকে প্রধান আসামি করে ১০৫ জনের নাম উল্লেখ করে ফেনী মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা করেন।