
নাটোরের চলনবিল অঞ্চলে কাঁদায় চাষ হওয়া রসুন যা স্থানীয়ভাবে ‘সাদা সোনা’ নামে পরিচিত পেয়েছে নতুন অর্থনৈতিক প্রাণ। অত্যন্ত পুষ্টিগুণ ও ঔষধিগুণসম্পন্ন এই রসুনের জন্য জিওগ্রাফিক্যাল ইনডিকেশন (জিআই) পণ্যের স্বীকৃতি দাবি করেছেন কৃষকরা। চলনবিলের কৃষকরা জানান, বিনাহালে (হাল চাষ ছাড়াই) কাঁদায় রসুন চাষ করায় উৎপাদনে ব্যয় ও শ্রম কমেছে। একদিকে যেমন উৎপাদন ব্যপক বেড়েছে, অন্যদিকে ভালো বাজারদরে লাভবান হচ্ছেন কৃষকরা। এতে করে এ অঞ্চলের রসুন প্রধান অর্থকরী ফসলে রূপ নিয়েছে।
ধান কাটার পর জমিতে জমে থাকা কাঁদার ওপর সরাসরি রসুনের কোয়া পুঁতে দেওয়া হয়। এরপর তা ঢেকে দেওয়া হয় ধানের খড় বা কচুড়িপানায়। এক সপ্তাহের মধ্যে গজিয়ে ওঠে চারা। এই পদ্ধতিতে জমি প্রস্তুতের আলাদা খরচ নাই, সেচ ও সার ব্যবহারের প্রয়োজনও অনেক কম। ফলে প্রাকৃতিক উপায়ে উৎপাদিত রসুন হয় স্বাস্থ্যকর, সুস্বাদু ও দীর্ঘস্থায়ী। রাজশাহী ও বগুড়া আঞ্চলিক কৃষি অফিসের তথ্য মতে, গত মৌসুমে রাজশাহী বিভাগের নাটোর, রাজশাহী, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় রসুনের চাষ হয়েছিল প্রায় ২৮ হাজার ১৮৫ হেক্টর জমিতে। অন্যদিকে, বগুড়া, জয়পুরহাট, পাবনা ও সিরাজগঞ্জে চাষ হয় আরও ১১ হাজার ৪১৯ হেক্টর জমিতে।
২০২১ সালে রাজশাহী ও বগুড়া অঞ্চলে রসুনের চাষ হয়েছিল ৫১ হাজার ৪৩৩ হেক্টর জমিতে। ২০২২ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৪৪ হাজার ৪৬৯ হেক্টরে এবং ২০২৩ সালে আরও কমে ৩৭ হাজার ৫৭০ হেক্টর হয়। তবে কৃষি বিভাগ আশাবাদী, ২০২৫ সালের মৌসুমে আবাদ ও উৎপাদন আবারও বৃদ্ধি পাবে। গত তিন মৌসুমে মোট রসুন উৎপাদন হয়েছে প্রায় ১১ লাখ ৪৪ হাজার ৭০৭ মেট্রিক টন
গুরুদাসপুরের স্থানীয় কৃষক আলতাব আলী, আমির মিয়া জানান, শত বছর ধরে চলনবিল অঞ্চলে রসুন চাষ হয়ে আসছে। তবে বর্তমানে বিনাহালে চাষ পদ্ধতি জনপ্রিয় হওয়ায় প্রচলিত হালচাষ ভিত্তিক রসুনের আবাদ প্রায় বিলুপ্ত।
কৃষক ছুলাইমান মৃধা বলেন, চলনবিলের জমিতে পলি জমে উর্বরতা বাড়ে। কাঁদা জমিতে রোপণ করা রসুনের ফলন ভালো হয়, পাশাপাশি খরচও কম পড়ে। প্রতি বিঘায় ২২-২৫ মণ রসুন পাওয়া যায়, যার উৎপাদন ব্যয় ৪৫ হাজার টাকা হলেও লাভ হয় অনেক বেশি।
রসুনের পাশাপাশি অনেক কৃষক একই জমিতে তরমুজ, বাঙ্গির মতো সাথী ফসলও চাষ করে বাড়তি আয় করছেন। কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, বাংলাদেশের মোট রসুন উৎপাদনের প্রায় ৪০.৭৩ শতাংশই হয় নাটোর জেলায়। এখানকার মাটি, পানির স্থায়িত্ব ও প্রাকৃতিক পরিবেশের কারণে উৎপাদিত রসুন হয় বেশি ঝাঁঝালো, সাদা, রসালো এবং সহজে সংরক্ষণযোগ্য।
স্থানীয় প্রবীণ কৃষক মোত্তালেব সরদার বলেন, আমার বাবা, আমি এবং এখন আমার সন্তানরাও কাঁদায় রসুন চাষ করছি। এই পদ্ধতি বদলায়নি, শুধু ফলন বেড়েছে। চাই আমাদের এই রসুনকে সরকারিভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হোক। নাটোরের জেলা প্রশাসক আসমা শাহীন জানান, চলনবিলের রসুনকে জিআই পণ্যের স্বীকৃতি দিতে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। স্বীকৃতি পেলে দেশের বাজারে মূল্য বৃদ্ধি ছাড়াও রপ্তানিতে শুল্ক সুবিধা পাওয়া যাবে।
রাজশাহী বিভাগীয় কৃষি দপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক ড. মো. আজিজুর রহমান বলেন, চলনবিল অঞ্চলে রসুন চাষের পরিবেশ ও পদ্ধতি অন্য কোথাও নাই। এখানকার রসুন মানের দিক থেকে অনন্য। তাই এটিকে জিআই পণ্যের স্বীকৃতি দেওয়া উচিত।