
আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন আমার উড়ছে আজ ডানা মেলে, তোমায় নিয়ে হারিয়ে যাবো চেচুয়া সেই শাপলার বিলে। শাপলা আমাদের জাতীয় ফুল, যেখানে জল সেখানেই শাপলার রাজত্ব। খাল-বিল, পুকুর, কিংবা নদীর শান্ত জলে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে আমাদের এই জাতীয় ফুল।
শুধু সৌন্দর্যই নয়-শাপলা বাঙালির ইতিহাস, সংস্কৃতি আর অনুভবের এক নীরব সাক্ষী। বর্ষা এলেই গ্রামবাংলার জলাশয়ে লাল, সাদা ও বেগুনি রঙে এই ফুলের আধিপত্য চোখে পড়ে। সূর্যের আলোয় ঝলমলে জলে শাপলার পাপড়িগুলো হালকা হাওয়ায় দুলে উঠে, তখন প্রকৃতি যেন নিজেই কবিতা হয়ে যায়। স্থানীয়দের কাছে এই ফুল শুধুই চোখের আরাম নয়। এতে রয়েছে নানা রকম ঔষধিগুণ, বিশেষ করে ডায়রিয়া ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে লোকজ চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। শাপলার মূল (ঢেঁকি শাক) রান্না করে খাওয়া হয়, আবার বাজারে বিক্রি করে অর্থ উপার্জনও করা হয়।
আজ লিখছি আমার জন্মস্থান যেখানে আমার বেড়ে ওঠা শৈশব, কিশোর, যৌবনকাল যে বিলের শাপলা আর কচুরিপানার গন্ধ, বক, শালিকের কলকাকলি আজও আমাকে নিয়মিত নিয়ে যায় সেই প্রকৃতির কাছে, সেই চেচুয়া শাপলা বিলের কাছে। ময়মনসিংহ শহর থেকে ২৪ কিলোমিটার দূরে ত্রিশাল উপজেলার রামপুর ইউনিয়নে প্রায় ৫০ একর জমিজুড়ে চেচুয়া বিল যা এখন সবার মুখে মুখে শাপলা বিল নামে পরিচিত। কালচে পানির ওপর সবুজের ফাঁকে ফাঁকে কোথাও সারি সারি, কোথাও দলবেঁধে লাল-সাদা রঙে ফুল ফুটে পর্যটকদের বিনোদনের খোরাক যোগাচ্ছে এই শাপলা। ডুবুরি পাখি পানকৌড়ির লুকোচুরি, সাদা বকের মুক্ত আকাশে ডানা মেল উড়া, নৌকার পালে বাতাসের ধাক্কা সব মিলিয়ে মনোরম এক অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি আমাদের এই চেচুয়া বিল। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পর্যটকদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠছে বিস্তীর্ণ এই এলাকা।
কথা বলেছিলাম ময়মনসিংহ থেকে পরিবার নিয়ে বেড়াতে আসা বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ‘টিজেড’ শপরকম বাজারের কর্ণধার তায়েজুল ইসলাম তারার সঙ্গে। তিনি বলেন শাপলার অপরুপ সৌন্দর্য দেখে আমি আর আমার পরিবারের সবাই বিমোহিত হয়েছি। এখানে না আসলে প্রকৃতির এই দৃশ্য উপভোগ করতে পারতাম না। তবে এখানে কিছু বিষয়ে প্রশাসনকে বলব যদি সম্ভব হয়। পর্যটকদের জন্য শৌচাগার, উঠা নামা করার জন্য একটি সিঁড়িপথ, নৌকার ভাড়া নির্ধারণ, মেয়েদের নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় নিবেন।
মুকুল নিকেতনের শিক্ষীকা সোহানা পারভীন বলেন- শাপলার বিলে ঘুরে চিরচেনা বাংলার অপরূপের দেখা পেয়েছি। যদি আর আগে আসতে পারতাম তাহলে এর সৌন্দর্য আর উপভোগ করতে পারতাম। যারা এখানে আসতে চান তারা অবশ্যই ভোরের সূর্য ওঠার আগে এখানে আসবেন। কারণ ভোরে প্রকৃতি যেভাবে তার রূপ মেলে ধরে সেটি আর গোটা দিনেও উপভোগ করা যায় না। সব চেয়ে বেশি ফুল দেখতে চাইলে আসতে হবে জুলাই মাসের ২০ তারিখের পর থেকে নভেম্বরের ১০ তারিখের মধ্যে। নৌকা ভাড়া জন প্রতি ১০০-২০০ টাকার মতো হয়ে থাকে। ফেসবুক, ইউটিউবে লাল শাপলার ভাইরাল ভিডিও, ছবি দেখে শতশত লোক ঘুরতে আসছে এই চেচুয়া বিলে। নৌকা মাঝি দুলাল মিয়া বলেন, এখানে পর্যটক পুলিশের কোনো তদারকি নাই। তাই প্রতিদিন কমে যাচ্ছে আমাদের বিলের শাপলা। কারণ এখানে যারা বেড়াতে আসে তারা অনেক শাপলা তুলে ফেলে তাতে প্রায় প্রতিদিন শতশত শাপলা গাছ কমে যাচ্ছে। আমরা বাধা দিলে আমাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল বাকিউল বারী আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, চেচুয়ার বিলটি ব্যক্তি মালিকানা সম্পত্তি হওয়ায়। প্রশাসন ইচ্ছা করলেই কোনোরকম উন্নয়ন প্রকল্প করতে পারবে না। আর একটি বিষয় হচ্ছে এই বিলে কয়েক মাস পানি থাকে বাকি দিনগুলো ফসল আবাদ করে জমি মালিকরা।
তারপরেও আগামী বছরে যদি এই বিলে পানি হয় শাপলা ফুটে, তাহলে আমরা পর্যটকদের নিরাপত্তা স্বার্থে আনসার পুলিশ নিয়োগ করব নৌকা ভাড়া নির্ধারণ করে দিব পাবলিক শৌচাগার ও সিঁড়িপথ তৈরি করার চেষ্টা করব। এর সৌন্দর্য রক্ষা এবং পর্যটকদের শাপলা ছিঁড়া, রোধকল্পে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
পরিবেশবিদরা বলছেন, প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ, জলাশয়ের দূষণ, আর কচুরিপানার দাপট কমাতে না পারলে একদিন হয়ত ছবিতে কিংবা কবিতায়ই শাপলার দেখা মিলবে। বাস্তবে আর নতুন প্রজন্মের সঙ্গে পরিচিত হতে পারবে না এই জাতীয় ফুল।