
বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ লবণাক্ত জমিতে লবণ পানির চিংড়ি চাষ বদলে দিয়েছে ৫ লাখ মানুষের জীবনমান। বর্তমানে অত্র উপজেলায় ৩৪ হাজার ৯৫ হেক্টর জমিতে লবণ পানির চিংড়ি ও অন্যান্য মৎস্য চাষ হচ্ছে। ছোট-বড় ঘেরের সংখ্যা রয়েছে সাড়ে ১৫ হাজার। প্রতিবছর অত্র উপজেলা থেকে প্রায় ৬০ হাজার মেট্রিকটন চিংড়িসহ অন্যান্য মৎস্য উৎপাদন হয়ে থাকে। যার আনুমানিক আর্থিক মূল্য প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা। উৎপাদিত মৎস্য স্থানীয় চাহিদা পূরণ করার পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানি করা হয়। এখানকার মৎস্য সম্পদ স্থানীয় ও জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। ব্যাপক কর্মসংস্থানের পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাড়িয়েছে এখানকার সাধারণ মানুষ। এখানকার চিংড়ি ও অন্যান্য মৎস্য সম্পদকে ঘিরে প্রসারিত হয়েছে বিভিন্ন ধরণের ব্যবসা বাণিজ্য।
সূত্র অনুযায়ী ৮০’র দশকে সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূলীয় এ জনপদে লবণ পানির চিংড়ি চাষ শুরু হয়। চিংড়ি চাষ লাভজনক হওয়ায় এ চাষ ব্যবস্থা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে গোটা উপজেলায়। শুরুর দিকে চিংড়ি ঘেরগুলো বৃহৎ আয়তনের ছিল। যা ধীরে ধীরে ছোট হয়ে এসেছে। এখন বেশিরভাগ জমির মালিকরা তাদের নিজেদের জমিতে বাঁধ দিয়ে নিজেরাই চিংড়িসহ অন্যান্য মৎস্য চাষ করছে। ফলে এলাকার প্রায় প্রতিটি মানুষ চিংড়ি চাষ ব্যবস্থার সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে। কেউ সরাসরি চাষের সাথে জড়িত রয়েছে, অনেকে আবার যৌথভাবে চাষ করছে, কেউ কেউ তাদের জমি লিজ দিয়ে হারির টাকা নিয়ে অন্যান্য কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রয়েছে। অনেকেই আবার পোনা এবং অন্যান্য মৎস্য ক্রয়-বিক্রয় ও সরবরাহ করে জীবিকা নির্বাহ করছে। ৫ দশক আগে শুরু হওয়া চিংড়ি চাষ ব্যবস্থায় মানুষের জীবনমান পরিবর্তন হলেও চাষ ব্যবস্থাপনায় তেমন কোন পরিবর্তন আসেনি। এখনও অধিকাংশ চিংড়ি চাষিরা সনাতন পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ করছে। ফলে উন্নত পদ্ধতি অনুসরণ ও চিংড়ি চাষের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা গেলে উৎপাদন কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেতো এমন ধারণা করছেন সংশ্লিষ্ট চাষি ও মৎস্য অধিদপ্তর কর্তৃপক্ষ। উপজেলা মৎস্য অফিসের তথ্য অনুযায়ী অত্র উপজেলায় বর্তমানে ৩৪ হাজার৯৫ হেক্টর জমিতে লবণ পানির চিংড়ি ও অন্যান্য মৎস্য চাষ হচ্ছে। ছোট-বড় ঘেরের সংখ্যা রয়েছে সাড়ে ১৫ হাজার। ৭৫ হেক্টরে ২২৫টি গলদা ঘের রয়েছে। পুকুর রয়েছে ৩৯১ হেক্টরের ২ হাজার ৫৫৮টি। বাগদা-গলদা, টেংরা, পারশে ও ভেটকিসহ এখানকার মূল্যবান মৎস্য সম্পদের মধ্যে কাঁকড়া অন্যতম। এসব মৎস্য সম্পদের মধ্যে বাগদা-গলদা, কাঁকড়া ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ চিংড়ি এবং সাদা মাছ স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করা হয়। বাগদা-গলদা ছাড়া অন্যান্য মৎস্য আলাদাভাবে চাষাবাদ হয় না। সচরাচর চিংড়ি ঘেরের সঙ্গে টেংরা, পারশে, ভেটকি ও কাঁকড়াসহ অন্যান্য মৎস্য উৎপাদন হয়ে থাকে। অত্র উপজেলা থেকে প্রতিবছর ৫ হাজার ৪৯০ টন বাগদা চিংড়ি উৎপাদিত হয়। যার বাজারমূল্য প্রতি কেজি ৬শ থেকে ১২শ টাকা। হরিণা, চালি, চাকাসহ অন্যান্য চিংড়ি উৎপাদিত হয় ৬৭০ টন। যার বাজার মূল্য প্রতি কেজি ৬শ থেকে ৮শ টাকা। গলদা উৎপাদন হয় ৪২ টন, যার বাজার মূল্য প্রতি কেজি ৮শ থেকে ১ হাজার টাকা। সাদা মাছ ১২ হাজার ২শ মেট্রিকটন, যার বাজার মূল্য প্রতি কেজি ১৫০ থেকে ৮শ টাকা। কাঁকড়া উৎপাদন হয় ৩ হাজার ৩৫০ মেট্রিকটন, যার বাজার মূল্য প্রতি কেজি ৩শ থেকে ২ হাজার টাকা। উন্মুক্ত নদী থেকে ৩৩০ মেট্রিকটন মৎস্য আহরণ হয়।
পোনা ব্যবসায়ী শহিদুল ইসলাম জানান, অত্র উপজেলায় ৫টি হ্যাচারি ৫০টি নার্সিং পয়েন্ট এবং শতাধিক পোনা বিক্রয়ের প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এখানে হাজারো মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। ক্ষুদ্র চিংড়ি চাষী আব্দুর রহমান বলেন, আমার নিজের ১০ বিঘা জমিতে চিংড়ি ঘের রয়েছে। যেখানে আমি ধান এবং চিংড়িসহ অন্যান্য মৎস্য চাষ করে থাকি। ধানের উৎপাদন একটু কম হলেও মাছের উৎপাদন ভালো হওয়ায় চিংড়ি ঘেরের আয় থেকে পরিবারসহ আমি সুন্দর জীবন যাপন করছি। উপজেলা চিংড়ি চাষি সমিতির সাধারণ সম্পাদক গোলাম কিবরিয়া রিপন জানান, ৮০’র দশকে অত্র এলাকায় চিংড়ি চাষ শুরু হয়। চিংড়ি চাষের কারণে এখানকার মানুষের জীবনমান উন্নত হয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাড়িয়েছে এখানকার প্রতিটি মানুষ। জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারণে চিংড়ি চাষ উপযোগী হলেও নানা সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতার কারণে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে চিংড়ি চাষিরা। বিশেষ করে মৌসুমের শুরুতেই পানি উত্তোলন করা নিয়ে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখিন হতে হয়। ফলে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে চাষ শুরু করা যায় না। চাষিদের উন্নত প্রশিক্ষণ প্রদান, সরকারি খাল খনন করার মাধ্যমে পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ এবং উন্নতমানের পোনা সরবরাহ করা গেলে চিংড়ির উৎপাদন কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেতো এবং চাষিরা লাভবান হতো। উপজেলা চিংড়ি চাষি সমিতির সভাপতি মোস্তফা কামাল জাহাঙ্গীর বলেন, এখানকার উৎপাদিত চিংড়ি ও অন্যান্য মৎস্য সম্পদ স্থানীয় ও জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। চিংড়ি ও মৎস্য খাত রক্ষা করার জন্য গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করার পাশাপাশি সরকারি সহযোগিতা প্রয়োজন।