
দেশের অর্থনীতি স্বনির্ভর করতে এবং উন্নয়ন কার্যক্রমে অবদান রাখতে সবাইকে রাষ্ট্রের প্রাপ্য রাজস্ব প্রদানের আহ্বান জানিয়েছেন চট্টগ্রাম সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন।
গতকাল বুধবার নগরীর রেডিসন ব্লু হোটেলে ভ্যাট দিবস ও ভ্যাট সপ্তাহ উপলক্ষে কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট, চট্টগ্রাম এর উদ্যোগে আয়োজিত সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ আহবান জানান মেয়র।
কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট কমিশনার শওকত আলী সাদীর সভাপতিত্বে এতে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কাস্টমস, এক্সাইজ ও মূল্য সংযোজন কর আপিল ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ লুৎফর রহমান, কর অঞ্চল-১ এর কমিশনার আবুল কালাম আজাদ, কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট (আপিল) কমিশনারেট কমিশনার মোঃ ফজলুল হক, কাস্টমস হাউস কমিশনার মোহাম্মদ শফি উদ্দিন। প্রধান অতিথির বক্তব্যে মেয়র বলেন, বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে প্রয়াত অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৯১ সালে ভ্যাট চালু হয়। আজ তিন দশক পর দেখা যায়, সেই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের রাজস্ব খাতকে যে শক্ত ভিত্তি দিয়েছে, তা এখন জাতীয় অর্থনীতির অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। বর্তমানে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট কর আদায়ের প্রায় ৩৮ শতাংশই আসে ভ্যাট থেকে, যা একক সূত্র হিসেবে সর্বোচ্চ রাজস্ব অবদান। শুধু তাই নয়, অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে ভ্যাটই এখন সরকারের উন্নয়ন বাজেট বাস্তবায়নের অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক হাতিয়ার। ভ্যাটের এই শক্তিশালী অবদান প্রমাণ করে যে ১৯৯১ সালে নেওয়া নীতিগত সিদ্ধান্ত ছিল সময়োপযোগী ও দূরদর্শী। রাজনৈতিক মতভেদ থাকতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্রের কল্যাণে যেসব পদক্ষেপ ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে উপকৃত করে, সেগুলোকে মূল্যায়ন করা আমাদের দায়িত্ব। ভ্যাটের মাধ্যমে রাজস্ব আহরণের স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও ডিজিটালাইজেশন আজ দেশকে এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বিএনপি সরকারের আমলে প্রবর্তিত ভ্যাট ব্যবস্থা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে টেকসই করেছে, রাজস্ব প্রশাসনকে আধুনিক করেছে এবং উন্নয়ন কার্যক্রমকে দীর্ঘমেয়াদে স্থায়িত্ব দিয়েছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে দল-মত নির্বিশেষে এই ধরনের ইতিবাচক উদ্যোগগুলোকে স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন। সবাইকে রাষ্ট্রের প্রাপ্য রাজস্ব প্রদানের আহ্বান জানিয়ে মেয়র বলেন, ভ্যাট হতে প্রাপ্ত রাজস্ব সরকারের আয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস, যা স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, সমাজকল্যাণ, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং জাতীয় ঋণ পরিশোধের মতো বিভিন্ন সরকারি পরিষেবা ও বিনিয়োগে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে রাজস্ব অবদান রাখে। ব্যবসায়ী সমাজকে উদ্দেশ্য করে মেয়র যথাযথ ভ্যাট প্রদানের মাধ্যমে স্বচ্ছভাবে ব্যবসা পরিচালনার আহ্বান জানান। একই সঙ্গে নাগরিকদের প্রতি পণ্য ও সেবা গ্রহণের সময় ভ্যাট চালান নেওয়ার অনুরোধ করেন। ভ্যাট আহরণের ক্ষেত্রে তিনি ভ্যাট কর্মকর্তাদের দেশপ্রেমিক হিসেবে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানান। তিনি আরো বলেন, স্বচ্ছতা নিশ্চিত হলে উন্নয়ন দ্রুত দৃশ্যমান হয়, আর সেই উন্নয়ন ভোগ করে নাগরিকগণ। তিনি ভ্যাট দিবসের সকল স্তরের করদাতাদের ভ্যাট প্রদানে উৎসাহিত করার মাধ্যমে একটি বৈষম্যহীন, দুর্নীতিমুক্ত, আধুনিক ও সুশৃঙ্খল দেশ গড়ে তোলার আহ্বান জানান।
এবারের ভ্যাট দিবসের স্লোগান ‘সময়মত নিবন্ধন নিব, সঠিকভাবে ভ্যাট দিব’। সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট ট্রেনিং একাডেমি, চট্টগ্রামের মহাপরিচালক ড. আবু নূর রাশেদ আহম্মেদ।
সভায় স্বাগত বক্তব্যে চট্টগ্রাম কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের কমিশনার মো. মাহফুজুল হক ভূঁঞা ভ্যাট ব্যবস্থার আধুনিকায়নের বিভিন্ন দিক উল্লেখ করেন। কর জিডিপির অনুপাত প্রসঙ্গে তিনি বলেন ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে কর জিডিপির অনুপাত ৬.৬৭%, যা সন্তোষজনক নয়। এখান থেকে উত্তোরণের উপায় সম্পর্কে আলোচনা করেন তিনি। রাজস্ব সংগ্রহ ও রাজস্ব প্রদানে কোনো সমস্যা থাকলে সংশ্লিষ্ট অংশীজনের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
ভ্যাট দিবসের আলোচনা অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথিরা তাদের বক্তব্যে বলেন, ভ্যাট হলো বাংলাদেশের আর্থিক চালিকা শক্তি। দেশের মোট রাজস্বের ৮০ (আশি) শতাংশ আদায় হয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে, যার মধ্যে ভ্যাটের অবদান এক-তৃতীয়াংশের বেশি। করদাতা, ব্যবসায়ী এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় রাজস্ব ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে নতুন মাইলফলক অর্জন এবং দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে তরান্বিত করার কথা অতিথিরা উল্লেখ করেন। এ বছরের ভ্যাট দিবসের প্রতিপাদ্যের কথা উল্লেখপূর্বক তারা বলেন, সময়মতো নিবন্ধন গ্রহণ করলে ব্যবসা হয় স্বচ্ছ, গ্রাহকের আস্থা বাড়ে এবং ভবিষ্যতে কোনো আইনি জটিলতায় পড়তে হয় না। ভ্যাট নিবন্ধন করা শুধু আইনগত বাধ্যবাধকতা নয়, বরং এটি আমাদের সততা ও দায়িত্ববোধের প্রতীক। অতিথিবৃন্দ তাদের বক্তব্যে বলেন আজকের দিনটি উদযাপনের দিন নয়, বরং এটি অঙ্গীকারের দিন। সকল স্তরের জনগণকে আজ থেকে পণ্য ও সেবা গ্রহণের সময় ভ্যাট চালান নেওয়ার জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ হতে আহ্বান জানান এবং স্বচ্ছ ভ্যাট ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আধুনিক বাংলাদেশ গড়ার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন।
অনুষ্ঠানের সভাপতি ভ্যাট দিবস উপলক্ষে সকল করদাতা ও ব্যবসায়ীদের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, ভ্যাট একটি পরোক্ষ কর ব্যবস্থা। একটি আধুনিক, স্বচ্ছ ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠন করতে হলে ভ্যাট প্রদানের বিকল্প নেই। সভাপতি তাঁর বক্তব্যে বলেন বাংলাদেশে ১৯৯১ সালে ভ্যাট ব্যবস্থার প্রবর্তন হলেও ২০১১ সাল থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড নিয়মিত ভ্যাট দিবস পালন করে আসছে। তারই ধারাবাহিকতায় কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট, চট্টগ্রাম প্রতি বছরের ন্যায় এবছর ভ্যাট দিবস ও ভ্যাট সপ্তাহ পালন করছে।
তিনি ভ্যাট দিবস ও ভ্যাট সপ্তাহ পালনের উদ্দেশ্যে যে সকল জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি আয়োজন করা হয়েছে তা বর্ণনা করেন। অনলাইনে ভ্যাট নিবন্ধন, অনলাইনে দাখিলপত্র প্রদান, অনলাইনে কর পরিশোধসহ বিভিন্ন সহযোগিতামূলক কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্যে সপ্তাহব্যাপী শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মার্কেটে বুথ স্থাপন করা হয়েছে। বিভিন্ন পোস্টার, ব্যানার, মোবাইল এসএমএস ইত্যাদির মাধ্যমে করদাতাদের অধিকতর সচেতন করা হচ্ছে। বিভিন্ন সার্কেল অফিসে করদাতাদের সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সেমিনার আয়োজন করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, গত ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ‘মান্থ অব রেজিস্ট্রেশন’ ঘোষণা করে। এ ঘোষণার প্রেক্ষিতে ভ্যাট নিবন্ধন প্রদানে চট্টগ্রাম ভ্যাট কমিশনারেট প্রথম স্থান অর্জন করে। এ সময় মোট ৭০০০ অনিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানকে নিবন্ধন প্রদান করা হয়।