কোনো একটি সভ্যতার প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রাণকেন্দ্রসমূহ ওই সভ্যতার উৎকৃষ্ট পরিচয় বহন করে। একটি প্রাচীন শহরের অবকাঠামোর ধ্বংসাবশেষ দেখেই পত্নতাত্ত্বিকরা বিচার করেন ওই ধ্বংসপ্রাপ্ত সভ্যতা কতটা সমৃদ্ধ ছিল। কালের পরিক্রমায় সভ্যতাসমূহ বিভিন্ন রাষ্ট্রে এবং প্রাণকেন্দ্রসমূহ গুরুত্বপূর্ণ শহর কিংবা রাজধানীতে প্রকাশ পাচ্ছে।
ঢাকার নামকরণ ও রাজধানীর ইতিহাস : বাংলাদেশের রাজধানী ‘ঢাকা’-র নামকরণের বিভিন্ন মতামত থাকলেও সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মতটি হল- সেন বংশের রাজা বল্লাল সেন বুড়িগঙ্গা নদীর তীরবর্তী এলাকার সন্নিহিত জঙ্গলে ভ্রমণকালে হিন্দু দেবী ‘দুর্গা’-র প্রতিমা খুঁজে পেলে দেবীর প্রতি শ্রদ্ধাস্বরূপ ঢাকেশ্বরী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। কালের বিবর্তনে ঢাকেশ্বরী নাম হতেই অঞ্চলটির নাম ঢাকা হিসেবে প্রচলিত হয়। সাম্প্রতিক পত্নতত্ত্ববিদগণের অনুমান মতে ঢাকার সভ্যতা প্রায় আড়াই হাজার বছরেরও অধিক পুরনো। খ্রিষ্টাব্দ ১৩শ’ শতাব্দীর শেষের দিকে মুসলমানরা ঢাকা দখলের অনেক পর ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ জুলাই সম্রাট জাহাঙ্গীর ঢাকাকে সর্বপ্রথম সুবা বাংলার রাজধানী ঘোষণা করেণ, যদিও তাঁর নামানুসারে এর নামকরণ করা হয়েছিল জাহাঙ্গীরনগর এবং তাঁর জীবিতকাল পর্যন্ত এ নাম বজায় ছিল। সময়ের পরিক্রমায় এই অঞ্চলের রাজধানী বার-বার পরিবর্তন হয়ে ১৬৫০ সালে ঢাকা হতে রাজমহল, ১৬৬০ সালে ঢাকা আবার রাজধানী, ১৭১৭ সালে মুর্শিদ কুলি খান কর্তৃক ঢাকা হতে মুর্শিদাবাদে রাজধানী স্থানান্তর হয়। ওই সময় হতে বৃটিশ শাসনের শুরু ১৭৯৩ পর্যন্ত ঢাকায় নায়েবে নাজিমদের শাসন চলতো। কিন্ত ঢাকার ঐতিহ্য ম্লান হতে থাকে যখন ব্রিটিশ সরকার ১৭৯৩ সালে কোলকাতাকে রাজধানী ঘোষণা করেন, যদিও ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পর ঢাকাকে পুনরায় রাজধানী করা হয়। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদের পর আবারও কলকাতায় রাজধানী স্থানান্তর হলেও ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান ভাগ হলে ঢাকা পুনরায় পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানীর মর্যাদা লাভ করে। তাছাড়া, ১৯৭১সালে মুজিবনগর সরকার ও ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানেও ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানীর মর্যাদা লাভ করে।
ভৌগোলিক অবস্থান ও গুরুত্ব : ভৌগোলিকভাবে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে সমতল অঞ্চলে অবস্থিত মেগাসিটি ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী, বৃহত্তম শহর ও বিশ্বের দ্রুততম ক্রমবর্ধমান নগরী। মোট প্রায় আড়াই কোটি জনসংখ্যার শহর ঢাকা জনসংখ্যার বিচারে দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৩ শতাংশ, দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম ও বিশ্বের ৭ম বৃহৎ। জনঘনত্বের বিচারে বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহর ঢাকা, যার প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ২৩০০০ অধিক লোক বাস করে। আধুনিক ঢাকাকে বাংলাদেশের আপামর জনতা রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক জীবনের প্রধান কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করে।
দক্ষিণ এশিয়ার মুম্বাইয়ের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শহর ঢাকা। ঢাকার জিডিপি (স্থ’ূল অভ্যন্তরীণ উৎপাদন) ও পিপিপি (ক্রয়-ক্ষমতা সমতা) যথাক্রমে ১৮৮$ বিলিয়ন ও ৩০৫$ বিলিয়ন।
রাজধানী স্থানান্তর : বর্তমান সরকারের বৈষম্যহীন টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্েয গঠিত ‘টাস্ক ফোর্স’ সঠিক ব্যাখ্যা না করে, কেবল অত্যধিক বায়ু দূষণ ও যানজটের শহর আখ্যায়িত করে রাজধানী স্থানান্তরের পরামর্শ দিয়েছেন। তাদের ভাষ্যমতে “রাজধানী ঢাকা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রতিবন্ধক।” বিশ্বের দ্রুততম ক্রমবর্ধমান নগরী, দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজধানী কিনা আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রতিবন্ধক! নিশ্চিত করেই বলছি- টাস্কফোর্সের সদস্যরা রাজধানী স্থানান্তরের সুদূরপ্রসারী প্রভাব অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছেন, ব্যর্থ হয়েছেন বর্তমান ঢাকার অর্থনৈতিক গুরুত্ব ও ভবিষ্য সম্ভাবনা অনুধাবন করতে। বর্তমানে রাজধানী ঢাকা এর স্বর্ণযুগ পার করছে। তার প্রমাণ ২০২০ সালে দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতি রাজধানীর মধ্যে ঢাকার অবস্থান ছিল ৪র্থ, সেখানে ২০২৩ এ ঢাকার অবস্থান ২য়। এছাড়া, ২০২৪ সালে ‘অক্সফোর্ড ইকোনমিকস’ কর্তৃক জরিপে অর্থনৈতিক তালিকায় ঢাকার অবস্থান ৩০৯তম, যেখানে ভারতের রাজধানী নয়া দিল্লির অবস্থান ৩৫০তম! এই স্বীকৃতির মাধ্যমে ঢাকা দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ অর্থনৈতিক রাজধানীর মুকুট ধারণ করে। সামনে কেবল মুম্বাইকে পেছনে ফেলে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম অর্থনৈতিক শহরের শ্রেষ্ঠত্বের হাতছানি! দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, ঢাকার এই স্বর্ণযুগে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা হতে অন্য কোথাও স্থানান্তরের প্রস্তাব করেছে টাস্কফোর্স।
একি শুধুই ভুল প্রস্তাবনা, নাকি ঢাকার চোখধাঁধানো অগ্রগতি তথা সমগ্র বাংলাদেশের অগ্রগতি স্থবির করার একটি চৌকস প্রচেষ্টা, তা ভাবার বিষয়। সময় এসেছে রাজধানী স্থানান্তরের এ প্রস্তাব সঠিক না ভুল, নাকি খামখেয়ালি কোন একটি অঞ্চল কে বিশেষ প্রাধান্য দিতে চাইছে অথবা কোন একটি গোষ্ঠীকে বিশেষ সুবিধা দিতে চাইছে, নাকি এই প্রস্তাবনার মাধ্যমে টাস্কফোর্স শত্রুরাষ্ট্রের মদদপুষ্ট হয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি ধ্বংসের নীল নকশাঙ্কন করছে তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে খুঁজে বের করার। একটি দেশের রাজধানী নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় প্রভাবক বা নিয়ামক হিসেবে কাজ করে; যেমন শহরগুলোর ভৌগোলিক অবস্থান, সমৃদ্ধ ইতিহাস, অর্থনীতি ও বাণিজ্য, ধর্মীয় প্রাধান্য ও রাজনৈতিক সমঝোতা ইত্যাদি। এবার, এসব প্রভাবকের ভিত্তিতে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা হতে স্থানান্তরের প্রাসঙ্গিকতা এবং যৌক্তিকতা কতটুকু তা নিয়ে একটু আলোকপাত করা যাক।
ইতিহাস : স্বয়ংক্রিয় রাজধানী হিসেবে খ্যাত ইতিহাস সমৃদ্ধ অঞ্চলসমূহ স্বয়ংক্রিয়ভাবেই দেশগুলোর জনগণের কাছে গুরুত্ব পায় এবং সময়ের পরিক্রমায় রাজধানীর মর্যাদা পায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ষোড়শ শতাব্দীর দিকে মাদ্রিদ খুবএকটা গুরুত্বপূর্ণ শহল না হলেও রাজা দ্বিতীয় ফিলিপ সেখানে থাকা শুরু করার সুবাদে শহরটি রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক কেন্দ্রে পরিণত হয় এবং পরবর্তীতে স্পেনের রাজতন্ত্রের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। এর চার’শ বছর পর মাদ্রিদ স্পেনের আনুষ্ঠানিক রাজধানীর পায়। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার রয়েছে চার’শ বছরের রাজধানীর গৌরবময় ইতিহাস ও ঐতিহ্য। সভ্যতার বিচারে পত্নতত্তবিদদের সাম্প্রতিক তথ্য মতে ঢাকার রয়েছে আড়াই হাজারেরও বেশি ঐতিহ্য। ইতিহাস ও ঐতিহ্েয রাজধানী ঢাকা এক ও অদ্বিতীয়।
ভৌগোলিক অবস্থান : সামরিক ও প্রতিরক্ষা কৌশল বিবেচনা করে রাজধানী নির্বাচন কিংবা অন্যান্য অঞ্চল হতে রাজধানী শহরের দূরত্ব বিবেচনায় কোন একটি দেশের কেন্দ্রের শহরকে রাজধানী নির্বাচন করা হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ১৯৬১ সালে ব্রাজিলের রাজধানী উপকূলীয় শহর রিও ডি জেনিরো হতে ভৌগলিক বিবেচনায় স্থানান্তরিত করে কেন্দ্রীয় শহর ব্রাসিলিয়ায় আনা হয়। ভৌগলিক অবস্থান বিবেচনায় ঢাকা বাংলাদেশের কেন্দ্রে অবস্থিত। ভৌগলিক অবস্থান, সামরিক ও প্রতিরক্ষা কৌশল বিবেচনায় দেশের অন্য সকল শহরগুলো রাজধানী ঢাকার চেয়ে যোজন-যোজন পিছিয়ে।
অর্থনীতি : অর্থনৈতিকভাবে চাঙ্গা একটি শহর আন্তর্জাতিক অঙ্গনের ও স্থানীয় রাজনীতিবিদদের নজর কাড়ে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, রোমান সাম্রাজ্য হতেই বৃটেনের অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্র ‘লন্ডন’ যুক্তরাজ্েযর রাজধানী রাজধানী হিসেবে বিবেচিত। রাজধানী ঢাকার অতীত ও বর্তমান অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিঃসন্দেহে অভূতপূর্ব। অবশ্য, আন্তজার্তিক বাণিজ্যে বাণিজ্যিক রাজধানী খ্যাত চট্টগ্রাম দেশের মোট রপ্তানি বাণিজ্যের ৭৮ভাগ ও আমদানি বাণিজ্যের ৮১ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে। কাজেই, বাণিজ্যিক বিচারে চিটাগাং-কে রাজধানী ঘোষণা করা যেতে পারে; যদিও ২০১৭ সালে চটটগ্রাম বাংলাদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী খেতাব অর্জন করে। কাজেই, ভৌগলিক অবস্থান ও অর্থনৈতিক বিবেচনায় এবং ইতিহাস ও ঐতিহ্য ধারণ করলে ঢাকা হতে রাজধানী স্থানান্তরের কোন একটি যৌক্তিক কারণ দৃষ্টিগোচর হয়না।
প্রস্তাবনা : ঢাকা হতে রাজধানী স্থানান্তরের বিষয়ে না ভেবে সরকারের উচিৎ রাজধানীর দূষণসমূহ হ্রাস, বিশেষত বায়ু ও শব্দ দূষণ, ও যানজট নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
এছাড়া, ট্যানারী শিল্পের ন্যায় গার্মেন্টস্ শিল্প ঢাকা হতে অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থাও বেশ কার্যকর হবে। অধিকন্তু, প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ এখন সময়ের দাবি; বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রতিটি বিভাগীয় শহরের সমৃদ্ধির দিকে নজর না দিয়ে রাজধানী স্থানান্তরের মত ধ্বংসাত্মক ও বিলাসী ছেলেখেলায় মত্ত হওয়াটা মোটেও বিবেচকের কাজ হবে না। সরকারের উচিৎ হবে প্রশিসনিক বিকেন্দ্রীকরণে মনোনিবেশ করে প্রতিটি বিভাগীয় অঞ্চলের সমৃদ্ধির পথ সুগম করা।
অ্যাডভোকেট ও কলামিস্ট