ঢাকা রোববার, ১৮ মে ২০২৫, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

উপেক্ষিত না হোক উত্তরবঙ্গের বৈচিত্র্যময় সাঁওতাল নৃগোষ্ঠী

মো. তাহমিদ রহমান
উপেক্ষিত না হোক উত্তরবঙ্গের বৈচিত্র্যময় সাঁওতাল নৃগোষ্ঠী

নৃতাত্ত্বিকভাবে বাংলাদেশের বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর পরতে পরতে লুকিয়ে আছে বর্ণিল রঙের ছটা। ঐতিহাসিক, নৃতাত্ত্বিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ অনুযায়ী বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ একটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাঁওতাল। আর্য সভ্যতার পূর্বে যে বিশাল জনগোষ্ঠীর মানুষ ছিলেন তা আলোকপাত করতে গিয়ে জি এ গ্রিয়ারসন এ অঞ্চলের অধিবাসীদের তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করেছিলেন। এর মধ্যে একটি শ্রেণিকে তিনি সাঁওতাল/সান্তাল হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বসবাসকারী অন্যতম প্রাচীন সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কৃষ্টি তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য অনুযায়ী পরিচালিত হয়। দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, রাজশাহী, নওগাঁ, ঠাকুরগাঁও এবং পঞ্চগড় জেলায় বসবাসকারী সাঁওতালদের রয়েছে তেভাগা ও স্বদেশী আন্দোলন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। ১৮৫৫-৫৬ সালের সাঁওতাল বিদ্রোহের পর তারা মূলত রাজশাহী ও নওগাঁ ছেড়ে মালদহ, বামনগোলা ও হিলি অঞ্চলে বসবাস শুরু করে। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের জোতদারদের জায়গাজমি দেখভাল করার আমন্ত্রণে দেশের উত্তরাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। উত্তরাঞ্চলের জোতদারদের জমাজমি চাষ করার পাশাপাশি সাঁওতাল সম্প্রদায় বিভিন্ন পশু-পাখি শিকার করে জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করত। ১৯৪১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী বর্তমান বাংলাদেশ এলাকায় সাঁওতালদের সংখ্যা ছিল প্রায় আট লক্ষ। দেশ বিভাগের পর লোক গণনার সময় সাঁওতালদের স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে গণ্য না করার ফলে বহুদিন তাদের সঠিক সংখ্যা নির্ধারণ করা যায়নি। আশির দশকে খ্রিষ্টান মিশনারিদের গৃহীত হিসাব অনুযায়ী উত্তরবঙ্গে সাঁওতাল জনসংখ্যা লক্ষাধিক। ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী সাঁওতাল জনসংখ্যা দুই লক্ষের বেশি। ২০০১ সালের জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশে সাঁওতাল জনসংখ্যা ১২৯০৪৯ জন। স্বাধীন বাংলাদেশে সাঁওতাল জনসংখ্যা বাড়ার পরিবর্তে সময়ের পরিক্রমায় কমেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে এদের সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকলেও স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ভূমি থেকে উচ্ছেদ, নানা অত্যাচার, শোষণ-নিপীড়ন, ইত্যাদি কারণে এরা দলে দলে দেশ ত্যাগে বাধ্য হয়। এদের অনেকেই চলে গেছে পাশের দেশ ভারতে। সেখানে সাঁওতালদের বর্তমান সংখ্যা ৬ লাখের মতো, আর নেপালে রয়েছে ৫০ হাজারেরও বেশি। উপমহাদেশের অন্যতম আদি বাসিন্দা এই সাঁওতালরা মূলত কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা এবং কৃষিসংস্কৃতির জনক ও ধারক হিসেবে স্বীকৃত। নৃতাত্ত্বিকভাবে সাঁওতালরা অস্ট্রিক ভাষাভাষী আদি-অস্ট্রেলীয় (প্রোটো-অস্ট্রালয়েড) জনগোষ্ঠীর বংশধর। দেহ কাঠামোর বৈশিষ্ট্যগত কারণে অনেকেই সাঁওতালদের বিশুদ্ধ প্রাক-দ্রাবিড়ীয় গোষ্ঠীর প্রতিনিধি বলে মনে করে। সাঁওতালরা আর্যদের আগে থেকেই উত্তরাঞ্চলে বসবাস করছে। তাই নৃতাত্ত্বিকদের ধারণা মতে এই অঞ্চলের আদিম অধিবাসীদের অন্যতম হলো সাঁওতাল জনগোষ্ঠী। উত্তরাঞ্চলের দুই বিভাগে সারা দেশের মোট আদিবাসীর প্রায় অর্ধেকের বেশি সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর বাস। কিন্তু রাষ্ট্রের মূল ধারার জীবন ব্যবস্থায় অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী যেমন: মারমা, গারো, মণিপুরী, জৈন্তিয়া, মুরং, হাজং সম্প্রদায়ের তুলনায় সাঁওতাল জনগোষ্ঠী নানাভাবে উপেক্ষিত। শিক্ষাসহ নানা ধরনের নাগরিক সুবিধা থেকে সাঁওতালরা বঞ্চিত। সাধারণ পর্যবেক্ষণে দেখা যায় পাহাড়ের আদিবাসীরা যেসব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন বা সরকার বিভিন্ন সেবা প্রদানের জন্য যে ব্যবস্থা চালু রেখেছে সেগুলো উত্তরাঞ্চলের আদিবাসীদের জন্য নেই। উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় সাঁওতাল ও অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রায় ২১ লাাখ আদিবাসী বাস করে। এদের মধ্যে ভোটারের সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। এই বৃহৎ ভোটার সংখ্যাটি রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ছয়টি সংসদীয় আসনের জয় পরাজয় নির্ধারণের বড় নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে আসছে। সাঁওতাল জনগোষ্ঠী তাদের পরিচয় দেয় ‘হড়’- অর্থাৎ মানুষ হিসেবে। মাটির তৈরি প্রায় জানালাবিহীন নিচু দরজাবিশিষ্ট ছোট ছোট ঘরে এরা বাস করে। সাঁওতাল সমাজে পুরুষের আধিপত্য অপেক্ষাকৃত বেশি। তবু পারিবারিক জীবনে নারীর ভূমিকাও কম নয়। এদের ঘর ছোট, কিন্তু গৃহাঙ্গন অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন। মাটির দেয়ালে নানা রকম কারুকার্য চিত্রণ সাঁওতাল নারীর সৌন্দর্যস্পৃহা ও শিল্পমনের পরিচয় তুলে ধরে। সাঁওতাল মহিলারা বালা, হাঁসুলি, মল ইত্যাদি পরতে এবং খোঁপায় ফুল গুজতে ভালোবাসে। সাঁওতালদের পোশাক পাঁচি, পাঁচাতাত ও মথ। তবে পুরুষরা থান কাপড়ের ধুতি, লুঙ্গি, গেঞ্জি, গামছা এবং নারীরা হাতেবোনা শাড়িও পড়ে। সাঁওতালদের মধ্যে ছয় রকম বিবাহপ্রথা চালু আছে এবং শুধু বহিঃগোত্র বিবাহের চল আছে। অভিভাবকের পছন্দ অনুসারে বিয়েকে সাঁওতালি ভাষায় ‘ডাঙুয়াবাপলা’ বলে। সাঁওতালরা মূলত কৃষিকাজ করে। নিবিড়ভাবে নিরীক্ষণ করলে দেখা যায় যে, উত্তরাঞ্চলীয় সাঁওতাল আদিবাসীরা সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাসী না। এরা ধর্ম বা জাতি-গোষ্ঠী নিয়ে কোনো সময় সমাজের জন্য ক্ষতিকর এমন কোনো কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয় না। উত্তরাঞ্চলের আদিবাসীরা অত্যন্ত নিরীহ শান্তিপ্রিয়। এই অঞ্চলের আদিবাসীরা পরিশ্রমী। তাই দেখা যায় এই দুই বিভাগের মূল কৃষি শ্রমিক সাঁওতাল আদিবাসী জনগোষ্ঠী। দেশের বর্তমানের সিংহভাগ ধান উৎপান্ন হয় বরেন্দ্র ও উত্তরের অন্যান্য জনপদে। দেশের খাদ্য পণ্য উৎপাদনে উত্তরাঞ্চলের সাঁওতাল আদিবাসীরা মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। উত্তরাঞ্চলের সাঁওতাল আদিবাসীরা উৎসবপ্রিয় মানুষ তাই এরা কখনও ধর্মীয় সংঘাত বা জাতিগত সংঘাতে লিপ্ত হয় না। উত্তরাঞ্চলের আদিবাসীদের জন্য আলাদা করে কোনো সরকারি সংস্থা কাজ করছে না। বিশেষ করে আদিবাসীদের ক্ষমতায়ন লক্ষ্যে স্থানীয় সরকারে তাদের সংরক্ষিত প্রতিনিধিত্ব আসন নেই। জাতিসংঘের আদিবাসীবিষয়ক ঘোষণাপত্রের অনুচ্ছেদণ্ড২৮ (১) অনুযায়ী আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভূমি, ভূখণ্ড ও সম্পদ যা তাদের ঐতিহ্যগতভাবে মালিকানাধীন কিংবা অন্যথায় দখলকৃত বা ব্যবহারকৃত এবং তাদের স্বাধীন ও পূর্বাবহিত সম্মতি ছাড়া বেদখল, ছিনতাই, দখল বা ক্ষতিসাধন করা হয়েছে এসব যাতে ফিরে পায় কিংবা তা সম্ভব না হলে, একটা ন্যায্য, যথাযথ ও উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ পায় তার প্রতিকার পাওয়ার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার রয়েছে। যেহেতু উত্তরের ১৬ জেলার আদিবাসীদের ভূমিসংক্রান্ত নানা জটিলতা রয়েছে, এই ভূমি জটিলতা নিরসনের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের ন্যায় স্বাতন্ত্র আদিবাসী কমিশন গঠন করা হলে ভালো হয়। স্থানীয় সরকারে আদিবাসীদের জন্য প্রতিনিধিত্ব কোটা সংরক্ষণ করার প্রয়োজন। এই সংরক্ষিত পদ থাকবে আদিবাসীদের জন্য। আদিবাসী প্রার্থীরা এই পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নির্বাচিত হবেন। সাঁওতাল আদিবাসীদের নিজস্ব ভাষা ও অক্ষর রয়েছে। কিন্তু সেই ভাষায় পাঠ্যপুস্তক না থাকায় মূলধারার সঙ্গে মিশে পড়াশোনা করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই উপেক্ষিত হয়। তাই রাষ্ট্রের দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে মূলধারার পাশাপাশি সাঁওতালদের নিজস্ব ভাষায় শিক্ষা প্রদানের জন্য সরকারিভাবে বিদ্যালয় স্থাপন করা। বৈষম্য, শিক্ষার অভাব, অজ্ঞতা, অসচেতনতা ও দারিদ্র্যের কারণে ক্রমান্বয়ে নিজ সংস্কৃতি হারিয়ে ফেলতেছে এ জনগোষ্ঠী। আশঙ্কা হয় যথাযথ রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের অভাবে হয়তো লুপ্ত হয়ে যাবে উত্তরাঞ্চলের ক্ষুদ্র সাঁওতাল নৃগোষ্ঠীর সুপ্রাচীন ঐতিহ্য। রাষ্ট্রব্যবস্থার কাছে একটাই প্রত্যাশা বংশানুক্রমে বসবাস করা সাঁওতাল জনগোষ্ঠী যথাযথভাবে শিক্ষা, কর্মক্ষেত্র, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও আইনগত অধিকার লাভ করুক।

শিক্ষক ও কলামিস্ট

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত