ঢাকা রোববার, ১৮ মে ২০২৫, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

রাগের আগুনে সম্পর্কের ছাই

রাজু আহমেদ
রাগের আগুনে সম্পর্কের ছাই

রাগ সম্পর্ককে বিভক্ত করে ফেলে। অতিরিক্ত ক্রোধে অন্যের ওপর অন্যায় হয়। যারা রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, তারা পশুর মতো নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে। অশান্ত রাগ হৃদয়ের কোমলতা ধ্বংস করে এবং মানুষকে নির্দয়তার দিকে ঠেলে দেয়। রাগের বহিঃপ্রকাশে অন্যের ক্ষতি কম হলেও, নিজের সর্বনাশ অনিবার্য হয়। আত্মিক কোমলতা হারিয়ে, আপনজন হারানোর যন্ত্রণায় এবং স্বাভাবিক আচরণ করতে না পারার ব্যথায় রাগান্বিত ব্যক্তি কঠোর কষ্টে ভোগে। কথায় আছে, রাগলেন তো হারলেন।

নিজেকে সংযত রাখার ভেতর, প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রাখার ভাঁজে বিজয়ের চিহ্ন থাকে। রাগারাগি করে উদ্দেশ্য সাধন, মন জয় কিংবা প্রতিষ্ঠা অর্জনের উদাহরণ খুবই দুর্লভ। বরং অধিকাংশের দৃষ্টিতে অহেতুক ক্রোধ প্রকাশকারী ব্যক্তিরা মানসিক অস্থিরতায় ভোগে বলে বিবেচিত হয়।

মানুষের হৃদয়ে কোমলতা ও কঠোরতা যুগপৎ বাস করে। কোনটি প্রাধান্য পাবে তা নির্ধারিত হয় ব্যক্তির অভ্যাস, আচরণ ও পারিপার্শ্বিকতায়। তবে সাধারণত মানুষ কোমলতা প্রত্যাশা করে, কঠোরতা পছন্দ করে না। ন্যায়-অন্যায়ের বিচারে কঠোরতাও কখনও অপরিহার্য। বিচারক যদি সর্বত্র নরম মনোভাব দেখান, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ব্যাহত হবে। আবার, যদি কেউ স্ত্রী-সন্তান, প্রতিবেশী কিংবা পরিবেশের প্রতি নির্দয় হয়ে ওঠে, তবে সম্পর্ক ভেঙে যাবে। তাই অবস্থা বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে প্রকৃত প্রজ্ঞার পরিচায়ক।

প্রত্যাশিত আচরণের মানদ- সবসময় অন্যের দ্বারা নির্ধারিত না করে, নিজের মাপকাঠিতেও গন্তব্য নির্ধারণ করা যুক্তিযুক্ত। আপনার রাগে যদি কেবল আপনি ক্ষতিগ্রস্ত হন, তাহলে সেটি ব্যক্তিগত ক্ষতি; কিন্তু যদি তাতে অন্যের ক্ষতি হয়, তখন তা ভয়াবহ আকার ধারণ করে। রাগের উত্তাপে কঠিন কথা বলে কারও মন ভেঙে দিলে চরম জুলুম হয়। আর মজলুমের দোয়া ও অভিশাপ দ্রুত কবুল হয়।

সংসার বা সমাজে যারা অহেতুক রাগে ফেটে পড়ে, তাদের মানুষ ভয় করে। অথচ ভয় পাওয়া আর আপন হওয়া এক নয়। এর সত্যতা বোঝার জন্য বিপদে পড়তে হয় কিংবা দুঃসময়ে সঙ্গী খুঁজতে হয়। যারা সমাজে ভয়ের রাজত্ব কায়েম করে, বিপদের দিনে তারা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে। তখন জীবনের গতি অভিশাপে রূপ নেয়।

কণ্ঠের কর্কশতার চেয়ে সদালাপের অশ্লীলতা আরও ভয়ংকর। একজন সামান্য মানুষও সম্মান ও ভালোবাসার দাবিদার। যারা কথায় কথায় ‘মানুষ ছাড়া অন্যকিছুর বাচ্চা’ বলে, তারা নিজেরাই কীসের বংশধর, তা নিয়ে ঘোর সন্দেহ আছে।

আপনার রাগে যদি অন্যের ঘুম হারাম হয়, মন বিষণ্ণ হয়, চোখে অশ্রু আসে- তবে জেনে রাখুন, আপনার জীবনও সুস্থভাবে চলবে না। পৃথিবীর কোথাও না কোথাও আপনার বিরুদ্ধে প্রতিশোধের তীর আঁটা হচ্ছে।

অতিরিক্ত কোনো কিছুই কল্যাণকর নয়; হোক তা রাগ অথবা কোমলতা। তবে রাগ হৃদয়ে নির্মম ক্ষত তৈরি করে। আর যারা স্বভাবে অতিমাত্রায় কোমল, তারা নিজেদের কষ্ট দেন, চোখের জল ফেলেন। তবুও, এটা শ্রেয়। কারণ অন্যের সঙ্গে অসৌজন্য আচরণ করা, মুড সুইংয়ের নামে অত্যাচার চালানো কিংবা রাগের দাপটে জুলুম করা কেবল অন্ধকারের পৃষ্ঠপোষকতা করে।

আপনি জানেন কি- প্রচণ্ড রাগী ব্যক্তি একেকটি বিস্ফোরকের মতো? যা নিজের ধ্বংসের সঙ্গে সঙ্গে অন্যকেও তছনছ করে। স্বভাবগতভাবে কারও মধ্যে রাগের প্রবণতা বেশি থাকতে পারে। বলা হয়, রাগী মানুষের হৃদয় নরম হয়! বাস্তবতা হলো, মানুষ কখনওই হৃদয় অবধি পৌঁছাতে পারে না যদি বাহ্যিক আচরণ তার হৃদয় ছুঁতে না পারে।

রাগ এক ভয়ংকর মানসিক ব্যাধি। রাগ যত কমবে, জীবন তত উজ্জ্বল হবে। দিনশেষে আমরা সবাই আপন-পর মিলিয়ে সুন্দর থাকতে চাই।

রাগান্বিত ব্যক্তির বিবেকের স্বাভাবিক কার্যকারিতা লোপ পায়। সে কী বলছে, কী করছে- এসবের বোধ হারিয়ে ফেলে। ক্রুদ্ধ মানুষের সঙ্গে পাষ- পশুর কোনো পার্থক্য থাকে না। সে নিজেকে ধ্বংস করে এবং অন্যের মনে দাহ ছড়িয়ে দেয়। অযৌক্তিক রাগ থেকে নিজেকে বাঁচাতে হবে। যাদের ভেতরে রাগ প্রবল, তাদের একদিনে পরিবর্তন সম্ভব নয় এবং উচিতও নয়। ধীরে ধীরে পরিবর্তন আনলে তা স্থায়ী হয়। পরিকল্পিতভাবে মন্দ স্বভাব থেকে বের হয়ে একজন পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠতে হবে।

একজন ভালো মানুষ কেবল প্রিয়জনের কাছেই নয়, বরং পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের জন্যও অমূল্য সম্পদ। মাথা ঠান্ডা রেখে লক্ষ্যে পৌঁছানো- এর চেয়ে বড় বিজয় আর কী হতে পারে? মানুষের সামনে নিজের উত্তম দিক তুলে ধরুন। সম্মান, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা আপনা-আপনি আসবে। রাগ কমান, সম্পর্ক বাঁচান।

প্রাবন্ধিক।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত