বাংলাদেশসহ বিশ্বের নানা প্রান্তে জলবায়ু পরিবর্তনের চরম প্রভাব দেখা দিচ্ছে। এক সময়ের প্রাকৃতিক ভারসাম্যে পরিপূর্ণ পরিবেশ আজ রূপ নিয়েছে এক বিপজ্জনক আবহে, যেখানে তাপমাত্রা শুধু বাড়ছেই নয়, রীতিমতো মানুষের জীবন হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে। গ্রীষ্মকাল এখন আর স্বাভাবিক ঋতু পরিবর্তনের ফল নয় বরং এক ভয়াবহ বাস্তবতা; যেখানে সূর্যের তেজ যেন প্রতিনিয়ত বাড়ছে, শহর থেকে গ্রাম সবখানে ছড়িয়ে দিচ্ছে অসহনীয় উত্তাপ। দিনের পর দিন চলা এই দাবদাহ জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। আর এর পেছনে মূল কারণ হচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্যের লঙ্ঘন এবং ক্রমবর্ধমান কংক্রিটের জঙ্গল।
একসময় ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরগুলো ছিল সবুজ বৃক্ষ, খোলা মাঠ এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। কিন্তু উন্নয়ন আর আধুনিকতার নামে সেই সবুজকে আমরা কেটে ফেলেছি। যেখানে একসময় ছিল শীতল ছায়া, সেখানে এখন শুধু সিমেন্ট-লোহার দেয়াল। বাড়ি, রাস্তা, মার্কেট, ফ্লাইওভার নির্মাণে প্রতিনিয়ত গাছ কাটা হয়েছে নির্বিচারে। আমরা মনে করিনি যে একটি গাছ শুধু বাতাস বিশুদ্ধ করে না, এটি চারপাশের তাপমাত্রাও নিয়ন্ত্রণ করে। নগরায়নের অতি বিস্তার, অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণ এবং ছাদবাগানের প্রতি মানুষের উদাসীনতা শহরগুলোকে পরিণত করেছে একেকটি তাপদ্বীপে (Urban Heat Island), যেখানে দিনের বেলাতেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে।
চলমান এই দাবদাহ সাধারণ মানুষের জীবনে এক ভয়াবহ সংকট তৈরি করেছে। শ্রমজীবী মানুষ, বিশেষ করে রিকশাচালক, নির্মাণশ্রমিক, কৃষক এবং দিনমজুররা এই তীব্র তাপপ্রবাহে জীবিকার জন্য ঘর থেকে বের হলেও ফিরে আসছেন ক্লান্তি, পানিশূন্যতা ও অসুস্থতা নিয়ে। হাসপাতালগুলোতে হিটস্ট্রোক, ডিহাইড্রেশন, ঘামাচি ও চর্মরোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। বৃদ্ধ ও শিশুদের অবস্থাও সংকটজনক হয়ে উঠছে। তাপপ্রবাহের কারণে মৃত্যুর হারও উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে।
একটি পরিপক্ব গাছ বছরে প্রায় ৪৮ পাউন্ড কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করতে পারে এবং এটি আশপাশের তাপমাত্রা ২ থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত কমাতে পারে। অথচ আমরা প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ গাছ কেটে ফেলছি এবং তার জায়গায় বসাচ্ছি উচ্চ তাপ শোষণকারী কংক্রিট ও পিচ।
বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন ও অন্যান্য দূষিত গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় গ্লোবাল ওয়ার্মিং ও ওজোন স্তর ক্ষয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এর ফলে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি সরাসরি ভূপৃষ্ঠে পৌঁছায়, যা তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য দায়ী। আর এই সমগ্র চক্রটি মানবসৃষ্ট পরিবেশ ধ্বংসেরই ফল। উন্নয়ন প্রয়োজন, তবে তা অবশ্যই পরিকল্পিতভাবে। একটি গাছ কাটলে তার বিকল্প রোপণ নিশ্চিত না করলে উন্নয়ন হবে ধ্বংসাত্মক। শহরের প্রতিটি রাস্তার পাশে, পার্কে, ছাদে, স্কুল-কলেজ ও সরকারি-বেসরকারি ভবনের আঙিনায় যদি পরিকল্পিতভাবে গাছ লাগানো যায়, তবে কিছুটা হলেও এই তীব্র দাবদাহের রাশ টেনে ধরা সম্ভব। যেসব দেশের শহরগুলোতে পর্যাপ্ত গাছপালা আছে, সেখানে গ্রীষ্মকালও অপেক্ষাকৃত সহনীয়। সবুজ পরিবেশ শুধু তাপমাত্রা নয়, মানুষের মানসিক ও শারীরিক সুস্থতার জন্যও অপরিহার্য। একটি গাছ তার চারপাশের বাতাস শীতল রাখে, ধুলাবালি ও দূষিত কণা শোষণ করে এবং আমাদের ফুসফুসকে দেয় বিশুদ্ধ নিঃশ্বাসের উপহার। শিশুদের বেড়ে ওঠার জন্য একটি সবুজ খোলা পরিবেশ যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি একজন কর্মজীবী মানুষের জন্যও কাজের পরিবেশে সবুজের ছোঁয়া প্রশান্তির উৎস।
এখন সময় এসেছে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সবুজায়নকে অগ্রাধিকার দেওয়ার। এটি শুধু একটি পরিবেশবান্ধব কার্যক্রম নয়, বরং অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই। স্কুলের পাঠ্যবইয়ে, গণমাধ্যমে, সামাজিক আন্দোলনে এবং নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে বারবার সবুজায়নের গুরুত্ব তুলে ধরতে হবে। সরকারকে নগর পরিকল্পনায় পরিবেশগত দিক বিবেচনায় নিতে হবে এবং আইন প্রয়োগে কঠোরতা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি জনগণকেও সচেতন হতে হবে, কেননা প্রকৃতি আমাদের কাছে শুধু সম্পদ নয়, এটি আমাদের জীবনরক্ষার একমাত্র আশ্রয়।
এই ভয়াবহ ভবিষ্যৎ রোধ করতে হলে প্রয়োজন সম্মিলিত পদক্ষেপ, প্রয়োজন প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা। কংক্রিটের বন্দিত্ব থেকে প্রকৃতিকে মুক্ত করতে না পারলে দাবদাহের ভয়াবহতা থেকে কারও মুক্তি নেই। জলবায়ু সংকটের বর্তমান চিত্র আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, প্রকৃতিকে অবহেলার পরিণাম কত ভয়াবহ হতে পারে। কংক্রিটে বন্দি এই নগরসমূহে নিঃশ্বাস নেওয়ার মতো পরিবেশ নেই, নেই সামান্য ছায়া কিংবা শীতলতার আশ্বাস। তাই ভবিষ্যৎকে রক্ষা করতে হলে সবুজায়ন হতে হবে রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকার, সামাজিক আন্দোলন ও ব্যক্তিগত দায়িত্ববোধের সমন্বিত প্রয়াস।
লেখক : শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা