ঢাকা বুধবার, ২১ মে ২০২৫, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

সমন্বয়ে শান্তিতে বাস

নন্দিনী লুইজা
সমন্বয়ে শান্তিতে বাস

মানুষের জীবনে সুখ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিশেষ করে সংসারে সুখ অর্জন করা প্রত্যেক মানুষের একান্ত কাম্য। সংসারে সুখ মানে শুধু আর্থিক স্বচ্ছতা নয় বরং মানসিক শান্তি, পারিবারিক সুসম্পর্ক, শারীরিক সুস্থতা এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা এর সঙ্গে জড়িত।

সংসার জীবনে সুখণ্ডশান্তি বজায় রাখা, সংসারটা গতিশীলভাবে চালিয়ে যাওয়া এটা এক ধরনের সামাজিক, মানসিক এবং নিজের সঙ্গে নিজের প্রতিনিয়ত আত্মচর্চা বিশেষভাবে প্রয়োজন। সংসারে সুখী হতে হলে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখা আবশ্যকীয়, পারস্পরিক বন্ধন গড়ে তোলা জরুরি।

দাম্পত্য জীবনে সুখী হওয়ার প্রথম শর্ত হচ্ছে- স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা স্থায়ীভাবে বসবাস করা। ছোটখাটো ভুলত্রুটি সমন্বয়ের মাধ্যমে সমাধান করা পরস্পরের অনুভূতিকে গুরুত্বসহকারে দেখে মজবুত সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে একে অপরের সহযোগিতা করা। দাম্পত্য জীবন শুরু হয় দুজন অচেনা পরিবার থেকে আসা মানুষের সমন্বয়ে। তারা ধীরে ধীরে নিজেদের মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়নে, সংসারে সুখ এবং শান্তিতে বসবাস করার জন্য আত্মপ্রত্যয় নিয়ে সামাজিক দায়বদ্ধতার মধ্যে নিজেদের উপস্থাপন করে।

ফলে এই সম্পর্কটা এতটাই দৃঢ় এবং বিশ্বস্ততা হওয়া দরকার, যা আগামীতে এর ফল ভালো হবে না মন্দ হবে তা নির্ভর করে। তাই ইচ্ছা করল, সংসার জীবন শুরু করলাম বিষয়টা এমন নয়। এটা কোনো ছেলে খেলা নয়। পুতুল খেলাও নয়। এটা এমন নয়, আজ খেললাম কাল খেলব না বিষয়টা এত হালকাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। ফলে আমরা পারিবারিক জীবনটা কতটা সহিষ্ণুতা এবং মানবিকভাবে পরিচ্ছন্ন জীবনযাপন করতে পারি, সেই বিষয়টা পরিবারের প্রত্যেকটা সদস্যের সুস্পষ্ট ধারণ থাকা প্রয়োজন। একটা পরিবারে যখন স্বামী-স্ত্রীর সমন্বয়ে সন্তান জন্ম গ্রহণ করে, সেই সন্তানদের শিক্ষা, নৈতিকতার শিক্ষা দেওয়া, তাদের যত্নশীল করে তোলা, আবেগ, অনুভূতি দিয়ে তাদের বড় করে তোলা পিতা-মাতার নৈতিক দায়িত্ব।

এই দায়িত্বের ক্ষেত্রে শুধু দিন যায়, রাত আসে, খাওয়া পড়া হয়, সময়মতো টাকা-পয়সা দেওয়া, তাদের ব্যয়ভার বহন করা, এটাই কিন্তু মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। যদি তাই হতো তাহলে অন্য প্রাণীর সঙ্গে মানুষের পার্থক্য হতো না। মানুষ সৃষ্টির সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ জীব, মানুষকে অনেক নিয়মণ্ডকানুন, আইনশৃঙ্খলা, মেনে জীবন পরিচালনা করতে হয়। এ বিষয়গুলো পরিবার থেকেই শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়। তাই পিতা-মাতার উচিত, তারা যখন সন্তান জন্ম দেবে তার আগে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দাম্পত্য জীবনের পরিষ্কার এবং পরিচ্ছন্ন জীবন বোধ নিজেদের মধ্যে স্থাপন করতে হবে। তবেই সুস্থ স্বাভাবিক সন্তান জন্ম দিয়ে তাদের সঠিকভাবে পরিচালনা করে বড় করাটা নৈতিক দায়িত্ব। এমন দেখা গেছে, অনেক পরিবারে অর্থের প্রাচুর্য আছে, শিক্ষাদীক্ষার কোনো অভাব নেই তারপরও তাদের মধ্যে নীতি-নৈতিকতার অভাব থাকে, যা কি না সমাজে একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলে।

আমরা দেখছি শুধু অর্থ থাকলেই হবে না, প্রাচুর্য থাকলেই হবে না তার সঠিক ব্যবহার এবং যথোপযুক্ত সেই সম্পদের সদ্ব্যবহার ও মূল্যায়ন সমাজে নিজেদের অবস্থান সবকিছু বিবেচনা করে জীবনবোধ চালানোটাই পারিবারিক শিক্ষা। আমরা অনেক সময় দেখতে পাই একটা পরিবারে অর্থের তেমন প্রাচুর্য নেই, স্বল্প আয় এর মধ্যে তারা সুস্থ স্বাভাবিকভাবে, মানসিক প্রশান্তি নিয়ে সন্তানদের মধ্যে খোলামেলা আলোচনার মাধ্যমে সুন্দর সুখী জীবনযাপন করছে। সবচেয়ে বড় কথা আত্মতৃপ্তি নিয়ে জীবনযাপন করাটাই হচ্ছে সুখী জীবনের মূল দীক্ষা।

পৃথিবীতে মানুষ স্বল্প সময়ের জন্য আসে তাই মানুষের চাওয়া পাওয়া, আকাঙ্ক্ষা সর্বোচ্চ থাকে, এটাই সত্য। তবে নিজের অবস্থান বুঝে, সামাজিক দায়বদ্ধতাকে বাদ না দিয়ে সমাজের আট-দশটা মানুষের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে যদি পারস্পরিক সততা, সহযোগিতা এবং পরোপকারিতা একজন মানুষকে সমাজের মধ্যে সুপ্রতিষ্ঠিত করে তোলে আর ওই মানুষটার পারিবারিক প্রভাব অন্য সবার মধ্যে প্রভাবিত হয়। যা সমাজের ভালো ফলাফল ডেকে নিয়ে আসে।

পরিবার বলতে শুধু স্বামী-স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে এটা বোঝায় না। পরিবারে থাকে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, প্রতিবেশী যারা কি না, আপদে-বিপদে পাশে এসে দাঁড়ায় এবং নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে বসবাস করার জন্য এই মানুষগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক রাখা প্রত্যেকটা পরিবারের মানবিক গুণাবলি। এই গুণাবলি থাকলে পারিবারিক কলহ এড়িয়ে চলা এবং পরস্পরের মধ্যে সম্মান বজায় থাকে। আমরা এখন প্রযুক্তিনির্ভর যান্ত্রিক যুগে বাস করছি। এই যুগে বাস করে পারিবারিক সম্পর্ক সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় পরিচালনা করা বড়ই দুষ্কর।

তারপরেও আমাদের প্রত্যেকটা পরিবারের নৈতিক দায়িত্ব পরিবার, কাজ, ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা। শুধু অর্থের পেছনে ছুটে সংসারের যে সুখ আসবে এমন কোনো কথা নেই। পরিবারকেও সময় দিতে হবে, গল্প করতে হবে, সৃজনশীল কাজের মাধ্যমে বন্ধনকে দৃঢ় করার জন্য একে অপরের সমস্যা মনোযোগ সহকারে শুনতে হবে এবং সমাধানের পথ খুঁজতে হবে, কারো মধ্যে যেন অহমিকা বা দম্ভ কাজ না করে। যে কারণে পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা একে অপরের সঙ্গে খোলামেলা হতে যেন সংকোচবোধ না করে।

পরিবারকে সুখী করার জন্য, নিজে সুখী হওয়ার জন্য প্রতিনিয়তই অনুশীলন করা প্রয়োজন। মানসিক, শারীরিক, সৃজনশীলতা বৃদ্ধি করতে হবে। শুধু একক চিন্তাভাবনা করে অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কখনই পরিবারের মধ্যে তার প্রভাব বিস্তার করা ঠিক না। এতে করে পরিবারের আর সদস্যরা এই বিষয়গুলো আন্তরিক সহকারে গ্রহণ করছে কি না এ বিষয়টাও খেয়াল রাখতে হবে। ইচ্ছামতো পরিবারের কর্তা যদি বাবা হয়ে থাকে, সে তার চাওয়া পাওয়াকে মুখ্য করে পরিবারের অন্য সদস্যদের চিন্তা না করে চাপিয়ে দেওয়া হয় তাহলে ভুল বোঝাবুঝি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এতে পরিবারের মধ্যে লুকোচুরি খেলা শুরু হয়, সেটার প্রভাব পরিবার শুধু না সমাজে এমনকি রাষ্ট্রে যে আঘাত করে। কেননা, সমাজ এবং রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে যারা কি না, অগ্রগামী বা কর্ণধার তারা প্রত্যেকেই কোনো না কোনো পরিবারের সদস্য।

আরেকটি মূল্যবান বিষয় আমরা যারা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাস করছি অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশ, এই সকল দেশের মধ্যে ধর্ম নিয়ে অনেক কুসংস্কার, অপসংস্কৃতি বিরাজ করে। সারা বিশ্ব এখন প্রযুক্তিনির্ভর, হাতের মুঠোয় রয়েছে পৃথিবী ফলে আমাদের মতো উন্নয়নশীল এবং উন্নত দেশে প্রতিনিয়তই আমরা মানসিকভাবে অনেকটাই বিপর্যস্ত থাকি। সঠিকভাবে পারিবারিক জীবন চালানোর ক্ষেত্রে আমরা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগি। এই অসামঞ্জস্য সিদ্ধান্ত যা কি না, পরিবারে অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে প্রভাব ফেলে। এই প্রভাবের ফলে পারিবারিকভাবে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। নতুন প্রজন্ম যারা কি না প্রতিনিয়তই নিজের দেশকে উন্নত দেশের সঙ্গে তুলনা করছে তারা একভাবে জীবন বোধ নিয়ে চিন্তা করছে আর আমরা যারা বয়োজ্যেষ্ঠ তারা অন্যভাবে জীবন বোধের চিন্তা করছি। ফলে এই দুই প্রজন্মের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হওয়ার কারণে পরিবারে অনেক অশান্তি সৃষ্টি হয়। এই অশান্তিকে দূর করার জন্য আমাদের দরকার সমন্বয়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত