ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১০ জুলাই ২০২৫, ২৬ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

দলমাদল কামান এবং কাজী নজরুল

দেবব্রত নীল
দলমাদল কামান এবং কাজী নজরুল

মানুষ ফুলের বাগানে, নদীর তীরে বা মনোরম কোনো দৃশ্যের পাশে দাঁড়িয়ে নিজের ছবি ধারণ করেন। কিন্তু একজন ছিল অন্যরকম। যে নিজের ছবি তুলে রাখতো গোরস্থানে, শশ্মান ঘাটে, যুদ্ধক্ষেত্রে বিংবা কামানের পাশে। তিনি কাজী নজরুল ইসলাম। ফটো তোলার প্রতি ছিল নজরুলের দুনির্বার আকর্ষণ। সে যুগের ফটো তোলার সুযোগ সবখানে ছিল না। তার উপর ফটো তোলা ছিল ব্যয়বহুল। কিন্তু নজরুল ছিলেন আজন্ম শৈাখিন। একদিকে তার ঘরে খাবার নেই, হাতে কোনো অর্থ নেই, স্ত্রী প্রমিলার কোলে শিশু পুত্র। অন্যদিকে একের পর এক নিষিদ্ধ হচ্ছে গ্রন্থ। উল্লেখ্য যে, বিদ্রোহী কবিতার অভূতপূর্ব সাড়ায় বিমোহিত কবি ধারদেনা করে ৮০০ কপি বই ছাপিয়ে প্রকাশ করেন বিষের বাঁশি ও ভাঙার গান। কিন্তু বিট্রিশ রাজের ক্রোধে পড়ে গ্রন্থ দুটো বের হওয়ার পরপরই নিষিদ্ধ হয়ে গেল। গ্রন্থ নিষিদ্ধ হওয়ার পর কবি এক প্রকার দেউলিয়াই হয়ে গেলেন। কলকাতার আবাস ছেড়ে আশ্রয় নিলেন হুগলিতে এক বন্ধুর বাড়িতে। চারিদিকের এত সমস্যা কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে সেই অবস্থাতে নজরুল নিজের একটা ফটো তোলার জন্য কুঁড়ি টাকা খরচ করে ফেললেন। কোন সে ফটো চলুন শুনে নজরুলের ফটো তোলার গল্প।

১৯২৫ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন মারা যায়। কবি চিত্তরঞ্জনকে নিয়ে একটি কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন। ছাঁপা ও অন্যান্য আনুষাঙ্গিক কাজ চলছিল দ্রুতলয়ে। এমন সময়ে জুলাই মাসের আট তারিখে বাকুঁড়া থেকে কলেজের উদ্ধোধন করতে যাওয়ার জন্য একটি পত্র আসে। কবি ১০ জুলাই ১৯২৫ সালে নজরুল বাঁকুড়া যান। তার সঙ্গে ছিলেন বন্ধু প্রাণতোষ চট্টোপাধ্যায়। স্টেশন থেকে ছাত্ররা তাকে মিছিল করে নিয়ে যায়। কলেজের অধ্যক্ষ মিস্টার ব্রাউন সস্ত্রীক গাড়ি নিয়ে উপস্থিত হন। নজরুলকে নিয়ে বিপুল উল্লাসের সঙ্গে কলেজের উদ্বোধন হয়। বাঁকুড়া কলেজের সম্মেলন শেষ করে কবি বাঁকুড়ার ১৪ মাইল উত্তরে অবস্থিত গঙ্গাজলঘাটিতে যান। সেখানে তিনি অমরকানন নামে একটি আশ্রম এর উদ্বোধন করেন। এই উপলক্ষে তিনি ‘অমর কারণ মোদের কানন’ নামে একটি গান রচনা করেন এবং সেটি গেয়ে শোনান। পরে বাঁকুড়ায় ফিরে এসে তিনি বিষ্ণুপুর যান।

বাঁকুড়া জেলার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ২২ থেকে ২৩ মাইল দূরে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী বিষ্ণুপুর। স্থাপত্য ও কুটির শিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ স্থান বিষ্ণুপুর। কিন্তু স্থাপত্য ও কুটির শিল্পের জন্য নয়, নজরুলের কাছে বিষ্ণুপুর ছিল তার চেয়েও বেশি। কারণ বিষ্ণুপুর ছিল তৎকালীন সময়ে একমাত্র স্বাধীন রাজ্য। পরাধীন বিট্রিশ ভারতে নিষ্পেষিত কবি বিষ্ণুপুরকে স্বাধীন বঙ্গের প্রতীক হিসেবে শ্রদ্ধা জানান। প্রচণ্ড উচ্ছ্বাসে উচ্ছ্বসিত কবি রাজবাড়ীতে প্রবেশ পথে মাটিতে শুয়ে পড়েন। পাগলের মতো মাটিকে চুম্বন করতে থাকেন। মাটি দিয়ে নিজের কপালে তিলক কাটেন। আর বারবার উচ্চস্বরে বলতে থাকেন আমার স্বাধীন স্বদেশ, আমার স্বাধীন ভূমি। তারপর দলমাদল কামান দেখে তিনি কামান বুকে জড়িয়ে ধরেন। কামানোর গায়ে হেলান দিয়ে একটি ছবি তোলেন। এই ছবিটি নজরল তাঁর চিত্তনামা কাব্যগ্রন্থের প্রচ্ছদ হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। তার সমগ্র জীবনের বিদ্রোহী সত্ত্বা ও স্বাধীনতার প্রতি অনির্বান আকর্ষণ বহন করে এই ছবিটি।

কিন্তু ভাগ্যের কী নিদারুণ পরিহাস! অনেক ত্যাগ আর তিতিক্ষার পর যখন স্বাধীনতা এল তখন তিনি নিজেই একটা জীবন্ত ছবি। যে ছেিবকে হাত ধরে টেনে তুলতে হয়। মুখে খাবার তুলে দিতে হয়। স্বাধীনতা তার শ্রেষ্ঠ বরপুত্রকে ছাড়া হয়ে যায় রঙ্গহীন, বিষাদের মতো নিস্তব্ধ, অন্ধকার।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত