ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১০ জুলাই ২০২৫, ২৬ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

উপকূলীয় বন কেন হারিয়ে যাচ্ছে

ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র
উপকূলীয় বন কেন হারিয়ে যাচ্ছে

সুন্দরবনের মানুষ বনবিবি নামের এক দেবতা পূজা করেন। ইনি নারীশক্তি। এই অঞ্চলের বনে বসবাসরত জেলে, বাওয়ালি, মৌয়ালরা মনে করেন বাঘ ও অন্যান্য অপশক্তি থেকে বাঁচার জন্য তারা তাকে পূজা করেন। বনবিবি হয়তো বা এই অঞ্চলের মানুষদের বাঘ বা অন্য কোনো অপশক্তি থেকে তাদের রক্ষা করছেন। কিন্তু আরেকটি অপশক্তি তো ধীরে ধীরে আস্ত এই বনকেই খেয়ে ফেলছে। এই সমস্ত সুন্দরবন, এই দীর্ঘ উপকূলীয় বনকে কি বনবিবি পারবেন বাঁচাতে?

বাংলাদেশে উপকূলীয় এলাকার দ্বৈর্ঘ্য ৭১০ কিলোমিটার। নানা প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এই উপকূল এলাকা। ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে উপকূলীয় এলাকায় ম্যানগ্রোভ বনায়ন করা হয়েছে ১১ হাজার ৭৪৫ হেক্টর। উপকূলীয় এলাকায় প্রায় ৮ হাজার একর জমিতে বনায়ন করা হয় ১৯৯৭ সালে। ২০১৬ সাল পর্যন্ত বন বিভাগ প্রায় ৫ লাখ একর উপকূলীয় বনায়ন করে। বলা হয় এটিই প্রথম বিশ্বের সর্ববৃহৎ উপকূলীয় বনায়ন প্রকল্প। একটি তথ্য মতে ষাটের দশকে ম্যানগ্রোভ জাতের গাছ ১ হাজার ১০০ একর জমিতে লাগানো হয়। এসব গাছের মধ্যে গেওয়া, কেওড়া, ছইলা এখানে উল্লেখযোগ্য। বন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী উপকূলীয় এলাকায় যেসব চর জেগে উঠেছে, সেসব চর এলাকায় ১৯৬৫ সাল থেকে বন সৃষ্টি করা হচ্ছে। এসব বনকে প্যারাবন বলা হয়। এই প্যারাবন গড়ে উঠেছে নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর এবং কক্সবাজার জেলায়। এই বন নানাভাবে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের হাত থেকে জানমাল ও দেশকে রক্ষা করে যাচ্ছে। প্রায় ১ লাখ ৯৬ হাজার হেক্টর ভূমিতে এই বন তৈরি করা হয়েছে, যা দেশের আয়তনের ১.৩৬ শতাংশ।

একে ঘিরে তৈরি হয়েছে বিশাল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। এখানে বিরাট অংশের মানুষ মৎস্যজীবী। প্রায় ২৮ প্রজাতির চিংড়িসহ ১৮৭ প্রজাতির মাছ শিকার করা হয় উপকূলীয় এলাকায়। উপকূলীয় অঞ্চলের ১১ হাজার ৫০০ হেক্টরজুড়ে রয়েছে চিংড়ি চাষ। কক্সবাজারে প্রায় ১৪৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে রয়েছে দীর্ঘ সমুদ্রসৈকত। এই অঞ্চলেই নৌবাণিজ্য ও নৌপরিবহন হচ্ছে। এছাড়া জাহাজ ভাঙা শিল্প, তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান এসব তো আছেই। বাংলাদেশে জনসংখ্যার বেশি ঘনত্বের কারণে এসব অঞ্চলে পরিবেশগত নানা সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। উপকূলীয় অঞ্চলে কৃষিজমি কমে যাচ্ছে। বাড়ছে মৎস্যজীবীর সংখ্যা। এছাড়া উপকূলীয় সম্পদের অতিব্যবহার, পানি দূষণ, ম্যানগ্রোভ বন ধ্বংস ইত্যাদি লেগেই আছে।

গত ১০ বছরে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে প্রায় ৩৯ শতাংশ বন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ১৯৭৬ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত মিরসরাইয়ে বনভূমির পরিমাণ ছিল ১৪ হাজার ৩৬১ হেক্টর। ১৯৯৭ সালে সব বন মিলিয়ে এর পরিমাণ হয়েছে ৭ হাজার হেক্টর। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী উপকূলীয় অঞ্চলের বন প্রতিনিয়ত বিলীন হয়ে যাচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে যেমন বনাঞ্চল বিলীন হচ্ছে, তেমনি স্থানীয় প্রভাবশালীরা নির্বিচারে ধ্বংস করে যাচ্ছে, এসব বন। মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপের তিন সহস্রাধিক একর প্যারাবন কেটে ছোট বড় অর্ধশত চিংড়ি ঘের নির্মাণ করেছে প্রভাবশালীরা- সম্প্রতি একটি পত্রিকায় এমন প্রতিবেদন প্রকাশ পেয়েছে ।

সম্প্রতি রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে বাংলাদেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) ন্যাশনাল ইভেন্ট অন কোস্টাল ফরেস্ট কো-ম্যানেজমেন্ট ফর ইকোসিস্টেম রিস্টোরেশন অ্যান্ড এসডিএস টুল বিষয়ে একটি কর্মশালার আয়োজন করে। এখানেই অনেকেই বক্তব্য রাখেন। বক্তব্যে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে এসেছে। বেলার প্রধান নির্বাহী তাসলিমা ইসলাম জানান, কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণ করতে গিয়ে ৭ লাখ ২০ হাজার গাছ কাটতে হয়েছে। এছাড়া পাহাড় কাটতে হয়েছে ২৬টি। অক্সফাম বাংলাদেশের জলবায়ুনীতি বিশেষজ্ঞ এসএম সাইফি ইকবাল একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সামনে আনেন। তিনি জানান, চিংড়ি ঘেড়, গাছ কাটা এসব কারণে প্রতি বছর ১ শতাংশ করে ম্যানগ্রোভ বন কমছে।

বনের ওপর মানুষ প্রাচীনকাল থেকেই নানাভাবে নির্ভরশীল। ঘর বানানো, জ্বালানি প্রভৃতি কাজে মানুষ প্রাচীনকাল থেকেই বন ব্যবহার করে আসছে। জাতিসংঘের মতে সারা বিশ্বে ১.৬ বিলিয়নেরও বেশি মানুষ জীবিকার প্রয়োজনে বনের ওপর নির্ভর করছে। প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে আজ অবধি বিশ্বের ৮০ শতাংশ বন মানুষের কারণে ধ্বংস হয়েছে। এফএও-এর তথ্য অনুযায়ী বৈশ্বিক অর্থনীতিতে জ্বালানি কাঠের বার্ষিক অর্থমূল্য ৪ লাখ মার্কিন ডলারেরও বেশি। বনের ওপর মানুষ নানাভাবে নির্ভরশীল। বন অক্সিজেন তৈরি করে। আমাদের ঠান্ডা রাখে। কার্বনডাই অক্সাইড সংরক্ষণ করে। বাতাস পরিষ্কার ও ভূমিক্ষয় রোধ করে। খাবারের জোগান দেয় ও কোটি কোটি মানুষকে চাকরি দেয়। বন বাতাস থেকে কার্বনডাই অক্সাইড শোষণ করে। বাতাসকে নির্মল রাখে। পৃথিবীর প্রায় ৩০ কোটি লোক বাস করে বনে। এদের মধ্যে ৬ কোটি লোকই আদিবাসী। এসব মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বনের ওপর নির্ভর করে। একটি তথ্যমতে যুক্তরাষ্ট্রের গাছ বছরে ৮৫০ জন মানুষ বাঁচায় আর স্বাস্থ্য খরচ কমায় ৬৮০ কোটি ডলার। পৃথিবীর এক কোটি মানুষ সরাসরি বনের ওপর নির্ভরশীল। বন আমাদের বিভিন্ন ধরনের ওষুধসহ মধু, মাশরুম, ফল, বাদাম ইত্যাদির যোগানদাতা। এছাড়া বনের গাছপালা শব্দ প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে, যা মারাত্মক শব্দদূষণ থেকে আমাদের রক্ষা করে। বলা হয়ে থাকে বাড়ির চারপাশে গাছপালা থাকলে ৫ থেকে ১০ ডেসিবেল শব্দ কমিয়ে আনতে পারে।

নানা কারণে উপকূলীয় বন ধ্বংসের দিকে। সৈকত, মোহনা, জলাভূমি, মাটির প্রকৃতির কারণে সুন্দরবনসহ উপকূলীয় বনগুলোতে একটি স্বতন্ত্র বাস্তুতন্ত্র গঠন করেছে। এর ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব রয়েছে। ইউনেস্কোর প্রতিবেদন অনুযায়ী সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে সুন্দরবনের ৭৫ শতাংশ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। বিভিন্ন সময়ে আইলা, আম্ফান ও ইয়াসের মতো ঘূর্ণিঝড়ের কারণে সুন্দরবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের ফলে বনে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করে। মিষ্টি পানিপ্রবাহ কমে যায়। এতে করে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। ফলে সুন্দরী, কেওড়া, গোলপাতাসহ বিভিন্ন গাছ মারা যায়। কিছুদিন আগে ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে সুন্দরবনের অনেক জায়গা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঘূর্ণিঝড় রিমালের সময় উঁচু জোয়ার হয়।

জলোচ্ছ্বাসের ঘটনা ঘটে। স্বাদু পানির উৎস শতাধিক পুকুর তলিয়ে যায়। সুন্দরবনের কারণে ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের গতি ৭০ কিলোমিটার কমেছে। এটি জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা কমিয়েছে তিন থেকে ৪ ফুট। অথচ ১৯৬০ সালের পর থেকে আমাদের দেশে যতগুলো ঘূর্ণিঝড় হয়েছে তার মধ্যে আম্ফান ছিল সবচেয়ে দীর্ঘ। এত দীর্ঘ হওয়ার পরও সিডর বা আইলার চেয়ে এর ক্ষয়ক্ষতি অনেক কম করতে পেরেছে। কেননা, সুন্দরবনে এসেই এই ঝড়ের গতি কমতে শুরু করে। জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ১৫ থেকে ১৮ ফুট হওয়ার শঙ্কা থাকলেও সুন্দরবনের কারণে এটি কমে ১০ থেকে ১২ ফুট হয়। ২০০৭ সালে সিডর আর ২০০৯ সালে যে আইলার তাণ্ডব দেখা গেছে বাংলাদেশে তারও ক্ষয়ক্ষতি কমিয়েছে সুন্দরবন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউটের একটি গবেষণা প্রতিবেদন মতে ঘূর্ণিঝড় সিডরের সময় সুন্দরবন ৪৮৫.২৯ মিলিয়ন ডলারের সম্পদ রক্ষা করেছিল। এসব জানা সত্ত্বেও আমরা সুন্দরবনসহ উপকূলীয় বনগুলো রক্ষা করতে পারছি না। এই অবস্থায় সবাই বন রক্ষায় রাজনৈতিক সদিচ্ছার বিষয়ে যেমন গুরুত্ব দিচ্ছেন তেমনি বন রক্ষায় আইনের প্রয়োগ ও সহব্যবস্থাপনার দিকে নজর দিতে চাচ্ছেন অনেকেই।

লেখক : শিক্ষক ও গবেষক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত