তরুণ সমাজ- একটি জাতির সবচেয়ে উজ্জ্বল সম্পদ। তাদের সৃজনশীলতা, কর্মক্ষমতা ও উদ্দীপনাই দেশের অগ্রগতির মূল চালিকাশক্তি। অথচ আজ সেই তরুণদের একটি বড় অংশ ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে মাদক নামক এক মরণনেশার করাল গ্রাসে। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও নৈতিক অবক্ষয়ের এই দিকটি এখন শুধু উদ্বেগজনক নয়, বরং জাতির ভবিষ্যতের জন্য এক ভয়ংকর অশনিসংকেত।
মাদকের বাস্তবতা : সংখ্যা নয়, সরব নীরবতা সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার তথ্য মতে, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৭০ লাখেরও বেশি মানুষ মাদকাসক্ত, যার প্রায় ৮০ শতাংশ তরুণ ও কিশোর। স্কুল-কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস, এমনকি মফস্বলের অলিগলিও আজ মাদকচক্রের করতলে। ‘ইয়াবা’ ‘আইস’ ‘ফেনসিডিল’ ‘হেরোইন’- এইসব নাম আজ আর শুধু অপরাধ পাতার শব্দ নয়, বরং এদেশের ভবিষ্যতের কিশোর-কিশোরীদের হাতের নাগালে থাকা বস্তু। সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো- অনেক অভিভাবকই জানেন না, সন্তান কখন আসক্ত হয়ে পড়েছে। কেননা, মাদক এখন ছদ্মবেশে আসে- কখনও বন্ধু সেজে, কখনও স্ট্রেস রিলিভার হয়ে, আবার কখনও স্মার্টনেসের প্রতীক হিসেবে। ফলে একসময় সন্তান চলে যায় এমন এক জায়গায়, যেখান থেকে ফেরার পথ প্রায় বন্ধ।
আসক্তির অন্তর্নিহিত কারণ : শুধু কৌতূহল নয়, সামাজিক ব্যর্থতা তরুণদের মাদকে জড়িয়ে পড়ার পেছনে কিছু গভীর সামাজিক ও মানসিক ব্যর্থতা কাজ করছে। পারিবারিক সংযোগহীনতা : ব্যস্ত পিতা-মাতা সন্তানের মানসিক টানাপোড়েন ও একাকিত্ব বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছেন।
বন্ধুবান্ধবের চাপ : অনেক সময় বন্ধুদের প্ররোচনায়, ‘না’ বলতে না পারার অক্ষমতায় তরুণরা জড়িয়ে পড়ে মাদকে।
বেকারত্ব ও হতাশা : উচ্চশিক্ষা অর্জনের পরও কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তা তরুণদের মাঝে এক ধরনের মানসিক অসহায়ত্ব সৃষ্টি করছে।
মনোবৈকল্য ও আত্মপরিচয়ের সংকট : আত্মবিশ্বাসের অভাব, মানসিক অবসাদ, একাকীত্ব কিংবা ভালোবাসাহীনতার সুযোগ নিয়ে মাদক সহজেই জায়গা করে নিচ্ছে মনে।
প্রযুক্তির ছদ্মবেশে বিষক্রিয়া : প্রযুক্তির অগ্রগতির পেছনে লুকিয়ে আছে বিপদ- ‘ডার্ক ওয়েব’, ‘কোডেড বার্তা’, ‘ডেলিভারি অ্যাপ’-এর মাধ্যমে এখন ঘরে বসেই তরুণরা পাচ্ছে ইয়াবা ও আইসের মতো মারাত্মক মাদক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মাদক সেবনের গ্ল্যামারাইজেশন তরুণদের মধ্যে এক বিকৃত কল্পনা তৈরি করছে- যেখানে নেশা যেন স্বাধীনতার আরেক নাম।
রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা : চেষ্টার ঘাটতি নয়, কার্যকারিতার অভাব, সরকার মাদক নিয়ন্ত্রণে নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে: আইন প্রণয়ন ও সংশোধন, র্যাব ও ডিএনসিসি-র বিশেষ অভিযান, সীমান্তে নজরদারি, ‘সেয়ান না টু ড্রাগস’ ক্যাম্পেইন, পুনর্বাসন কেন্দ্র সম্প্রসারণ ।
তবে বাস্তবতা বলছে, এই উদ্যোগগুলো এখনও যথেষ্ট ফলপ্রসূ নয়। মাদকের মূল চালিকাশক্তি- চক্রের গডফাদাররা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে দুর্নীতিবাজ কিছু সদস্যের অন্ধ সমর্থন, মামলার ধীরগতি ও রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়া- সব মিলিয়ে কার্যকর দমন এখনও সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
করণীয় : প্রতিরোধ নয়, প্রতিরোধের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে : ১. পারিবারিক সংলাপ ও মূল্যবোধের পুনর্জাগরণ: সন্তানকে সময় দিন, শুনুন, বুঝুন। ২. স্কুল-কলেজে কাউন্সেলিং বাধ্যতামূলক করুন: একাডেমিক পাঠ্যসূচির বাইরেও মানসিক শিক্ষা জরুরি। ৩. কর্মসংস্থান ভিত্তিক তরুণ প্রকল্প: দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা, ই-কমার্স ট্রেনিং, স্টার্টআপ ইনিশিয়েটিভ তরুণদের শক্তভাবে বেঁধে রাখতে পারে। ৪. সাংস্কৃতিক বিকাশ ও খেলাধুলা: মাদকমুক্ত সমাজ গঠনে সাংস্কৃতিক কার্যক্রম ও খেলাধুলা হতে পারে বিকল্প নেশা। ৫. বিচারিক কঠোরতা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা: মাদক ব্যবসার মূল হোতাদের নাম গোপন না রেখে বিচারের আওতায় আনতে হবে।
মাদক নামক নীরব ঘাতক বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় তরুণ প্রজন্মকে গ্রাস করছে। এটি আর কেবল একটি স্বাস্থ্যের সমস্যা নয়, বরং জাতীয় নিরাপত্তা ও ভবিষ্যতের প্রশ্ন। মাদকাসক্ত তরুণ মানেই অন্ধকারে গন্তব্যহীন এক ভবিষ্যৎ। জাতির সম্ভাবনাকে বাঁচাতে এখনই সময়, প্রতিরোধ নয়- প্রতিরোধের সংস্কৃতি গড়ে তোলার। পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং রাষ্ট্রকে একযোগে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে- তা না হলে যে প্রজন্ম হারিয়ে যাচ্ছে, তাদের আর ফেরানো সম্ভব হবে না।
লেখক : সমাজকর্মী ও শিক্ষার্থী ফুলছড়ি সরকারি
কলেজ, জুমারবাড়ী, সাঘাটা, গাইবান্ধা