ঢাকা শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়োজনীয়তা

ইসতিয়াক আহমেদ হৃদয়
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়োজনীয়তা

ক্ষমতার ব্যবহার ও প্রয়োগের ভিত্তিতে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি একটি অতি প্রাচীন বিষয়। গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল সর্বপ্রথম স্বতন্ত্রীকরণ নীতি প্রয়োগ করেন। রাষ্ট্রের শাসনকার্য পরিচালনায় যার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। অধ্যাপক সি’লির মতে, “Democracy is from of government which has a share” . অধ্যাপক ফাইনাল বলেন- পরিপূর্ণ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি প্রয়োগ করলে সরকার কখনও মূর্ছিত হবে। কখনও হাত-পা ছুঁড়তে থাকবে। যারা শাসনকার্যে নিযুক্ত আছেন, তারাই উপলব্ধি করতে পারেন কিরূপ আইন প্রয়োগ করলে তাদের নিজস্ব ক্ষমতা না থাকে তাহলে শাসনকার্য পরিচালনা করা তাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে।

ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি মূলত গণতন্ত্রের ধারক ও বাহক। ব্যক্তিস্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকার রক্ষা এবং সরকারের স্বেচ্ছাচারিতায রোধ করার ভাবনা থেকে স্বতন্ত্রীকরণ নীতির উদ্ভব। অর্থাৎ সরকারের তিনটি বিভাগ পরস্পর স্বতন্ত্র থেকে নিজ নিজ ক্ষমতাচর্চা ও কার্যাবলি সম্পন্ন করবে। এক বিভাগ অন্য বিভাগের কাজে হস্তক্ষেপ করবে না। তাহলে গণতন্ত্রের মর্যাদা রক্ষা পাবে। আমরা জানি, স্বাতন্ত্রীকরণ নীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো ক্ষমতার পৃথকীকরণ। সরকারের তিনটি বিভাগ যেমন- আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগের ক্ষমতা পৃথক থাকবে। এই তিনটি বিভাগের ক্ষমতা ও কার্যাবলি সংবিধান দ্বারা সীমাবদ্ধ থাকবে এবং প্রশাসনিক কার্যক্রমে এক বিভাগের উপর অন্য বিভাগের কর্মকর্তারা হস্তক্ষেপ করবে না। এতে করে প্রত্যেক বিভাগের কাজের পরিধি নির্ধারণ করা যায় এবং প্রত্যেক বিভাগ পরিধিরভুক্ত কার্যসম্পাদন স্বাধীনতা ভোগ করে। ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির ফলে দেশের শাসনকার্য সুরক্ষিত হয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিরোধ সংঘটিত হলে ভাগ এক্ষেত্রে শাসন বিভাগের নিয়ন্ত্রণ মুক্ত থেকে রায় প্রদান করে- যা গণতন্ত্রকে অক্ষত রাখতে সহায়তা করে। ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির মাধ্যমে গণতন্ত্র সমুন্নত থাকে।

সুতরাং গণতন্ত্র সুরক্ষার ক্ষেত্রে ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ নীতি একটি মাইলফলক স্বরূপ। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় উন্নয়ন আর সুশাসনের আলোচনা যখন তুঙ্গে, তখন একটি শব্দ ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে- ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ, বা Decentralization। এটি শুধু একটি প্রশাসনিক কৌশল নয়, বরং একটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দর্শন যা জনগণের হাতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা তুলে দেওয়ার মাধ্যমে প্রকৃত অর্থে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে। আমাদের দেশে দীর্ঘদিন ধরে কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। রাজধানীকেন্দ্রিক প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফলে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলো উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত থেকেছে। স্থানীয় সমস্যাগুলোর নিরসন হয়েছে ঢাকার নির্দেশের অপেক্ষায়। এর ফলে নীতি-নির্ধারণ ও বাস্তবায়নের মাঝে সময়ক্ষেপণ হয়েছে, জনগণের আস্থা কমেছে এবং কখনও কখনও প্রশাসনিক জটিলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ মানে শুধু দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া নয়, বরং নির্দিষ্ট কর্তৃত্ব, সম্পদ এবং স্বাধীনতা প্রদান। একজন ইউপি চেয়ারম্যান বা পৌর মেয়র যদি তার এলাকায় নিজস্ব উন্নয়ন পরিকল্পনা করতে পারেন, তবে তিনি স্থানীয় বাস্তবতা বিবেচনায় কার্যকর সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হবেন। এতে জনগণের অংশগ্রহণ বাড়ে, জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয় এবং প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব হয়।

গণতন্ত্র শুধু পাঁচ বছর পরপর ভোট দেওয়া নয়। গণতন্ত্র তখনই পরিপূর্ণ হয়, যখন জনগণ প্রতিদিনের প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে নিজের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারে। স্বতন্ত্রীকরণের মাধ্যমে সাধারণ নাগরিকরা নিজের এলাকায় স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি বা অবকাঠামোগত উন্নয়নে মতামত দেওয়ার সুযোগ পান। এতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া আরও গণমুখী হয়ে ওঠে। যেখানে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা থাকে, সেখানে দুর্নীতির সুযোগও বেশি থাকে। কারণ ক্ষমতা যখন সীমিত কিছু মানুষের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়, তখন জবাবদিহিতা কমে যায়। কিন্তু যদি ক্ষমতা নীচের স্তরে বিকেন্দ্রীভূত হয়, তবে জনগণের সরাসরি নজরদারির সুযোগ বাড়ে এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত হয়। বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলই আলাদা সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা বহন করে। উপকূলীয় অঞ্চলের চাহিদা ভিন্ন, পাহাড়ি এলাকার সমস্যা ভিন্ন।

কেন্দ্র থেকে একযোগে সব অঞ্চলের জন্য সমান নীতি কার্যকর করা অসম্ভব। কিন্তু ক্ষমতা যদি স্থানীয় পর্যায়ে হস্তান্তর করা হয়, তাহলে স্থানীয় বাস্তবতার ভিত্তিতে উপযুক্ত পরিকল্পনা করা সম্ভব হয়, যা উন্নয়নের ভারসাম্য আনে।

ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ কোনো বিলাসিতা নয়, এটি সময়ের দাবি। এটি একটি গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনের ভিত্তি, যেখানে জনগণ শুধু ভোটার নয়—সরাসরি অংশগ্রহণকারী, তত্ত্বাবধায়ক এবং নীতি-নির্ধারক। উন্নয়নের গতিকে ত্বরান্বিত করতে, দুর্নীতি রোধ করতে এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে আমাদের এখনই প্রকৃত অর্থে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ বাস্তবায়নের দিকে এগোতে হবে।

লেখক : শিক্ষার্থী

নওগাঁ সরকারি কলেজ

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত