বাংলাদেশ ঐতিহ্যগতভাবেই নদীমাতৃক দেশ। মানুষের নিরাপদ আমিষ ও পুষ্টি সরবরাহ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রপ্তানি বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন এবং সামগ্রিক আর্থসামাজিক উন্নয়নে মৎস্য খাতের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপ ও জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকির মধ্যেও সরকার সময়োপযোগী পদক্ষেপ ও বাস্তবসম্মত নীতিমালার মাধ্যমে মাছের উৎপাদন ও সুরক্ষায় অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছে। মৎস্য খাত শুধু আমিষ ও পুষ্টির জোগান নয় বরং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেরও অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের দেশের নদ-নদী, খাল-বিল, পুকুর, হাওর-বাঁওড়সহ অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ের পরিমাণ প্রায় ৩৮.৬ লক্ষ হেক্টর এবং বদ্ধ জলাশয় রয়েছে ৮.৫ লক্ষ হেক্টর। তদুপরি, দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বিস্তৃত ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সামুদ্রিক জলসীমা আমাদের মৎস্যসম্পদের অন্যতম প্রধান ভাণ্ডার।
মৎস্যসম্পদের সংরক্ষণ, উন্নয়ন, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এবং টেকসই আহরণ ও উৎপাদনের লক্ষ্যে সরকার যুগোপযোগী ও বাস্তবসম্মত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে। এই প্রেক্ষাপটে এবারের জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ দেশের মৎস্য খাতের টেকসই উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধির ধারাকে আরও শক্তিশালী করতে বিশেষ গুরুত্ব বহন করছে। জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ ২০২৫-এর প্রতিপাদ্য ‘অভয়াশ্রম গড়ে তুলি, দেশি মাছে দেশ ভরি’ শুধু একটি স্লোগান নয়, এটি আমাদের টেকসই উন্নয়নের অঙ্গীকার। মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, মাছসহ অন্যান্য জলজ সম্পদের নিরাপদ ও টেকসই উৎপাদন নিশ্চিত করা হলে দেশের খাদ্যনিরাপত্তা উল্লেখযোগ্যভাবে জোরদার করা সম্ভব। পাশাপাশি, এর ফলে রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পাবে এবং সাধারণ মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়ন আরও গতিশীল ও টেকসই হবে।
মৎস্য খাত জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। দেশের মোট জিডিপিতে মৎস্য খাতের অবদান ২.৫৩ শতাংশ এবং কৃষিজ জিডিপিতে ২২.২৬ শতাংশ। বর্তমানে দেশে বার্ষিক ৫০ লাখ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদিত হয়। দেশের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ১২ শতাংশ, অর্থাৎ প্রায় ২ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই খাতের সাথে সম্পৃক্ত, যার মধ্যে প্রায় ১২ লাখ নারী রয়েছেন। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়, বদ্ধ জলাশয় ও সামুদ্রিক জলাশয়ের উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনায় আধুনিক ও সময়োপযোগী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ফলে বাংলাদেশ মাছ উৎপাদনে উদ্বৃত্ত দেশের কাতারে উন্নীত হয়েছে। মাথাপিছু দৈনিক মাছের প্রাপ্যতা ৬৭.৮০ গ্রাম, যা দৈনিক চাহিদা ৬০ গ্রাম থেকে বেশি। বিশ্বের ৫০টিরও বেশি দেশে বাংলাদেশের মাছ ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানি হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের মৎস্য খাত উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। বিশ্বে ইলিশ আহরণে বাংলাদেশ ১ম, তেলাপিয়া উৎপাদনে ৪র্থ এবং এশিয়ায় ৩য় অবস্থানে রয়েছে। FAO -এর ২০২৪ সালের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থান মিঠা পানির মাছ আহরণে ৩য়, বদ্ধ জলাশয়ে চাষে ৫ম, ক্রাস্টাশিয়ান (চিংড়ি, কাঁকড়া ইত্যাদি) আহরণে ৮ম এবং উপকূলীয় ও সামুদ্রিক মাছ আহরণে ১৪তম। মৎস্য ও মৎস্যপণ্যের ভ্যালুচেইন উন্নয়ন এবং রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণে সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে দেশের মৎস্যপণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৯০.৬২ হাজার মেট্রিক টন মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানি করে ৬১৪৪.৯১ কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়েছে।
দেশীয় মাছের নিরাপদ প্রজনন ও আবাসস্থল নিশ্চিতকরণ, জলাশয়ে টেকসই উৎপাদন বজায় রাখা, মাছের প্রজাতিগত ও জিনগত বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ এবং জলজ পরিবেশ ও প্রতিবেশ ব্যবস্থার পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণের লক্ষ্যে সরকার বহুমুখী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। উন্মুক্ত জলাশয়ে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে মৎস্য অধিদপ্তর নিয়মিতভাবে পোনা মাছ অবমুক্তকরণ ও বিল নার্সারি কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
দেশের বিভিন্ন নদ-নদী ও অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে বিপন্নপ্রায় মাছের অবাধ প্রজনন, বংশবৃদ্ধি ও টেকসই উৎপাদন নিশ্চিত করতে বর্তমানে ৬৬৯টি অভয়াশ্রম চালু রয়েছে। ভবিষ্যতে আরও অভয়াশ্রম স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে। এর মধ্যে হাওরে ১০টি স্থায়ী অভয়াশ্রম, ইলিশের জন্য ৬টি, হালদা নদীতে ১টি, এবং কাপ্তাই হ্রদে ৬টি অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যা মৎস্যজীবীদের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে পরিচালিত হচ্ছে। এই অভয়াশ্রমগুলো জলজ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও মাছের প্রাকৃতিক প্রজননে বড় ভূমিকা রাখছে।
বাংলাদেশে শুরু হয়েছে ইলিশের ভরা মৌসুম। জাতীয় মাছ ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং টেকসই আহরণ নিশ্চিত করতে সরকারের গৃহীত Hilsa Fisheries Management Action Plan (Hilsa FMP) প্রণয়ন ও সফল বাস্তবায়ন, জাটকা সংরক্ষণ কার্যক্রম জোরদারকরণ, ইলিশ প্রজনন সুরক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়ন, ইলিশ অভয়াশ্রম ঘোষণা ও কার্যকর ব্যবস্থাপনার ফলে অভূতপূর্ব সাফল্য এসেছে। চলতি বছর জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহসহ নানা কর্মসূচির মাধ্যমে ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে এবং সংরক্ষণে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। চলতি মৌসুমে ১২ জুন থেকে ২০ জুলাই ২০২৫ পর্যন্ত দেশে ৪৬ হাজার ৭৯০ মেট্রিক টন ইলিশ আহরিত হয়েছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের ARIMA মডেল অনুসারে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদন ৫,৩৮,০০০ থেকে ৫,৪৫,০০০ মেট্রিক টন হতে পারে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। তবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মতো উৎপাদন হ্রাসের প্রবণতা অব্যাহত থাকলে প্রকৃত উৎপাদন এই পূর্বাভাসের চেয়েও কম হতে পারে বলে সতর্কতা জানানো হয়েছে।
সরকারের নানাবিধ উদ্যোগের ফলে জেলেদের আর্থসামাজিক উন্নয়ন, মৎস্য অভয়াশ্রম ও সংরক্ষিত এলাকা স্থাপন, ইলিশ সম্পদ সংরক্ষণ, ব্লু ইকোনমি বিকাশ, সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণ ও স্থিতিশীল আহরণ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম সফলভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে। সরকার বাস্তবভিত্তিক উদ্যোগের মাধ্যমে দেশের প্রকৃত জেলেদের শনাক্ত করে নিবন্ধন ও পরিচয়পত্র প্রদান কার্যক্রম ধারাবাহিকভাবে অব্যাহত রেখেছে। এ পর্যন্ত নিবন্ধিত ১৮ লাখ ১০ হাজার জেলের মধ্যে ১৫ লাখ ৮০ হাজার জেলেকে পরিচয়পত্র প্রদান করা হয়েছে, এখনও কার্যক্রম চলমান রয়েছে। জাটকা সংরক্ষণ এবং মা-ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুমে মাছ আহরণ থেকে বিরত থাকার প্রেক্ষিতে জেলেদের জীবন-জীবিকা নির্বাহে বিশেষ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।
প্রতি বছর জাটকা সংরক্ষণ কর্মসূচির আওতায় ৪ মাস ধরে নিবন্ধিত পরিবারগুলোকে মাসে ৪০ কেজি করে চাল দেওয়া হয়। মা-ইলিশ সংরক্ষণ উপলক্ষে প্রধান প্রজনন মৌসুমে ২২ দিন, পরিবার প্রতি ২৫ কেজি হারে চাল বিতরণ করা হয়। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মোট ৯ লাখ ২৮ হাজার জেলে পরিবারকে এসব সহায়তার আওতায় এনে প্রায় ৭১ হাজার ৬৩২ মেট্রিক টন ভিজিএফ চাল বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া, সমুদ্রে ৫৮ দিন মাছ ধরা নিষিদ্ধকালেও উপকূলীয় অঞ্চলের ৩ লাখ ১১ হাজার ৬২ নিবন্ধিত জেলে পরিবারকে মাসিক ৪০ কেজি হারে মোট ২২ হাজার ৮২ মেট্রিক টন চাল বিতরণ করা হয়েছে।
শুধু খাদ্য সহায়তা নয়, টেকসই জীবিকা নিশ্চিতে সরকারের উদ্যোগ আরও বিস্তৃত। ইলিশ আহরণে নিরুৎসাহিত করতে ৯ হাজার ২৮১টি জেলে পরিবারকে বিকল্প কর্মসংস্থানের উপকরণ প্রদান করা হয়েছে।
৭ হাজার ৮০০ জন জেলেকে বিকল্প আয়বর্ধক কর্মকাণ্ডে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি দেশীয় মাছ ও শামুক সংরক্ষণে ৪ হাজার ৭০ জন জেলেকে বিকল্প কর্মসংস্থানের উপকরণ দেওয়া হয়েছে। এসব বহুমুখী উদ্যোগ একদিকে যেমন জেলেদের আর্থিক নিরাপত্তা ও সামাজিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করছে, তেমনি অন্যদিকে জলজ সম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় দাদনমুক্ত অর্থনীতির লক্ষ্যে সহজ শর্তে ঋণপ্রাপ্তির জন্য বিশেষায়িত ব্যাংক প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রেরণ করেছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে উৎপাদন ব্যয় হ্রাসে বিদ্যুতের দাম কৃষি খাতের সঙ্গে সমন্বয় করতে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় বিদ্যুৎ, জালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের কাছে আবেদন করা হয়েছে।
বর্তমান বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকার মৎস্য খাতকে আধুনিক ও টেকসই করার লক্ষ্যে বহুমুখী কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় মাছচাষ ব্যবস্থাকে অভিযোজন সক্ষম এবং পরিবেশবান্ধব করার প্রয়াসে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন মৎস্য অধিদপ্তর সফলভাবে বাস্তবায়ন করছে। জলবায়ু সহনশীল মাছচাষের সম্প্রসারণ, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার এবং চাষিদের সক্ষমতা উন্নয়নে ব্যাপক কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে। এর আওতায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বাস্তবায়িত হয়েছে- খাঁচায় মাছচাষ, পুকুরে মিশ্রচাষ, কাঁকড়া ও বাগদা চিংড়ি চাষ, শুঁটকি উৎপাদন।
এই উদ্যোগগুলোর মাধ্যমে দেশের উপকূলীয় ও জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার জনগোষ্ঠী সরাসরি উপকৃত হচ্ছে। মাছচাষ ব্যবস্থার টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি স্থানীয় অর্থনীতিতেও প্রাণচাঞ্চল্য ফিরেছে। মৎস্য অধিদপ্তর আশাবাদী, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় এই কার্যক্রম মৎস্য খাতে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করবে এবং দেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি উপকূলীয় জনগণের জীবন-জীবিকায় স্থিতিশীলতা আনবে। এই অর্জন দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও রপ্তানি খাতের বৈচিত্র্য বৃদ্ধিতে মৎস্য খাতের গুরুত্ব ও সম্ভাবনাকে আরও সুদৃঢ় করেছে।
বাংলাদেশের ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্রসীমার টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে সরকার বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। এর অংশ হিসেবে Marine Protected Area (MPA) ঘোষণা এবং উন্নত ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম চালু রয়েছে। সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের লক্ষ্যে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এরইমধ্যে Marine Reserve, নিঝুমদ্বীপ সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা এবং নাফ সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকাগুলো সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করেছে। ফলে দেশের সামুদ্রিক জলসীমার ৮১০১ বর্গকিলোমিটার (৮.৬৪ শতাংশ) এলাকাকে সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয়েছে, যা জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (ঝউএ ১৪.৫) অর্জনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। এসব উদ্যোগ দেশের মৎস্যসম্পদের টেকসই উন্নয়ন এবং পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ২০৩০-এর লক্ষ্য অর্জনে মৎস্য খাত বিশেষ ভূমিকা রেখে চলেছে।
‘আরভি মীন সন্ধানী’ গবেষণা ও জরিপ জাহাজের মাধ্যমে এ পর্যন্ত ৫৪টি সার্ভে ক্রুজ পরিচালনা করা হয়েছে। আগামী ২২ আগস্ট থেকে ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক গবেষণা জাহাজ RV Dr. Fridtjof Nansen কর্তৃক Fisheries and Ecosystem Surve পরিচালিত হবে। এই উদ্যোগগুলো খাদ্যনিরাপত্তা, টেকসই মৎস্য আহরণ এবং সুনীল অর্থনীতির বিকাশে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে।
মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় হতে নানাবিধ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সামুদ্রিক মাছের প্রজনন সুরক্ষায় ১৫ এপ্রিল থেকে ১১ জুন পর্যন্ত ৫৮ দিন মৎস্য আহরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে, যা আগের ৬৫ দিনের পরিবর্তিত সময়কাল (এ বিষয়ে ১৬ মার্চ ২০২৫ এ প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে)। সামুদ্রিক মৎস্য বিধিমালা ২০২৩ সংশোধন এবং মৎস্য সংরক্ষণ ও সুরক্ষা আইন ১৯৫০ সংশোধনের মাধ্যমে অধ্যাদেশ ২০২৫ অনুযায়ী ধারা ৭ যুক্ত করার ফলে মুক্ত জলাশয়ে অভয়াশ্রম ঘোষণা করে মাছ ও অন্যান্য জলজপ্রাণী সংরক্ষণ করা যাবে ( এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন ২৯ জুন ২০২৫ এ জারি হয়েছে)।
বাংলাদেশে মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণ ও উন্নয়নে অভাবনীয় সাফল্য অর্জিত হয়েছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের নিরলস গবেষণার ফলে মিঠা পানির বিলুপ্তপ্রায় ৬৪টি মাছের মধ্যে ৪১টি প্রজাতির মাছের প্রজনন কৌশল ও চাষ পদ্ধতি সফলভাবে উদ্ভাবিত হয়েছে। একই সঙ্গে ১১০টি দেশীয় মাছের লাইভ জিন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, যা দেশীয় মাছের বংশগত বৈচিত্র্য সংরক্ষণে একটি ঐতিহাসিক উদ্যোগ।
একদিকে সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ বাস্তবায়ন করছে অন্যদিকে অবৈধ ও নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার, নদী ও জলাশয়ের দূষণ, নদীর নাব্যতা সংকট ও ভরাট, প্রজনন মৌসুমে অতিরিক্ত ও অনিয়ন্ত্রিত মাছ ধরা, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব, প্রাকৃতিক আবাসস্থল ধ্বংস, দাদন ও ঋণ নির্ভর জেলে পেশা, অসচেতনতা ও আইন অমান্য করাসহ বিভিন্ন কারণে মাছের স্বাভাবিক উৎপাদন হুমকির মুখে পড়ছে। তাই মাছের উৎপাদন ধ্বংসের বহুমুখী কারণ বন্ধে এবং মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন নিশ্চিত করতে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা সময়ের দাবি। এই লক্ষ্য অর্জনে সরকারের পাশাপাশি সব স্তরের জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন।
বাংলাদেশের মৎস্য খাত আজ শুধু পুষ্টির জোগানদার নয়, বরং দেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি। সরকারি বাস্তবমুখী উদ্যোগ, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার এবং জনগণের অংশগ্রহণের ফলে মৎস্য খাত টেকসই উন্নয়নের পথে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে। পুষ্টি, কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় মৎস্য খাতকে করি আরও শক্তিশালী- সবাই মিলে গড়ি টেকসই ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ।
সিনিয়র তথ্য অফিসার
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়