শিশুরা আমাদের দেশ ও সমাজের ভবিষ্যৎ। তাদের মেধা, চিন্তা ও চরিত্রের ভিত্তি স্থাপিত হয় শৈশবেই। শৈশবের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো সীমাহীন কৌতূহল। শিশুর মন যখন প্রশ্নে ভরে ওঠে- ‘আকাশ কেন নীল?’, ‘মানুষ মরলে কোথায় যায়?’, ‘আমি কোথা থেকে এসেছি?’, ‘বাবা-মা কেন ঝগড়া করে?’ তবে তা শুধু সরল জিজ্ঞাসা নয়, এটি তাদের অন্তর্দৃষ্টি ও চিন্তার গভীর প্রকাশ। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, অনেক সময় বড়রা এসব প্রশ্নকে অবহেলা করে অথবা মিথ্যা তথ্য দিয়ে শিশুকে চুপ করিয়ে দেয়। এতে শিশুর চিন্তার বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়, আত্মবিশ্বাস কমে যায় এবং তার ভাবনা বিকৃত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। পরিবার হলো শিশুর প্রথম বিদ্যালয়, আর বাবা-মা তার প্রথম শিক্ষক। শিশুর প্রশ্নের প্রতি সৎ ও বোধগম্য উত্তর দেওয়া বাবা-মা ও শিক্ষকদের নৈতিক দায়িত্ব।
শিশুরা যা জানে না, তা জানতে চাওয়া তাদের কৌতূহলের প্রমাণ। তাদের প্রশ্নকে যদি অবজ্ঞা করা হয়, তবে সে কৌতূহল ক্রমশ ম্লান হয়ে যায়। শিশুরা বোকার মতো প্রশ্ন করে না; তারা নিজের পরিবেশকে বোঝার চেষ্টা করে। শিশুর মনে প্রশ্ন জন্ম নেয় তখনই যখন সে বিশ্বকে উপলব্ধি করতে থাকে। প্রশ্নের উত্তর না জানা মানে শিশুর মানসিক বিস্তারের পথ রুদ্ধ করা। ‘আমরা গরিব কেন?’, ‘মানুষ মরলে কাঁদে কেন?’, ‘আল্লাহ দেখতে কেমন?’ এর মতো প্রশ্নে অনেক বড়রাও বিব্রত হন। তবে অভিভাবক ও শিক্ষক হিসেবে আমাদের উচিত এই প্রশ্নগুলোর যৌক্তিক ও সহজ ভাষায় উত্তর দেওয়া। এতে শিশুর মধ্যে ন্যায়ের বোধ ও মানবিক মূল্যবোধ গড়ে ওঠে। তারা সঠিক তথ্য পেলে জীবনের নানা বিষয়ে বিচক্ষণতা অর্জন করে। শিক্ষাবিদরা মনে করেন, শিশুর প্রশ্নের যথাযথ উত্তর না পেলে সে ভয়বোধে ভোগে, আত্মবিশ্বাস হারায় এবং সমাজে আস্থাহীন হয়ে পড়ে। মনের কথা গোপন করার অভ্যাস গড়ে উঠে, যা পরবর্তীতে মানসিক সমস্যার কারণ হতে পারে। সুতরাং, শিশুদের প্রশ্নের প্রতি অবহেলা নয়, বরং সতর্কতা ও দায়িত্বশীলতা প্রয়োজন। বর্তমান তথ্যবহুল যুগে শিশুদের সামনে অসংখ্য তথ্য আসে, যা কখনও বিভ্রান্তিকরও হতে পারে। ইন্টারনেট ও সামাজিক মাধ্যমে শিশুদের কৌতূহল ও প্রশ্ন অনেক। এ কারণে পরিবার ও শিক্ষকদের উচিত শিশুদের সঠিক তথ্য দিয়ে পথপ্রদর্শন করা। শিশু যদি ছোটবেলা থেকে সত্য ও যুক্তিসম্মত তথ্য পায়, তবে বড় হয়ে সে মিথ্যা, দুর্নীতি ও কুসংস্কার থেকে দূরে থাকবে। শিশুদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা প্রয়োজন, যেন তারা নির্ভয়ে প্রশ্ন করতে পারে। বাবা-মা ও শিক্ষকরা যদি ধৈর্যশীল, সহানুভূতিশীল ও বন্ধুবৎসল হন, তাহলে শিশুরা আত্মবিশ্বাসী, মানবিক ও সৎ হয়ে উঠবে। শিশুর প্রশ্নের পেছনে লুকিয়ে থাকে একেকটি সম্ভাবনার বীজ, যা একদিন দেশের উন্নয়ন ও সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হতে পারে। আমাদের উচিত শিশুর প্রশ্নকে গুরুত্ব দেওয়া, সময় নিয়ে তাদের বুঝিয়ে দেওয়া।
সত্যি কথা বলুন, কারণ শিশুরা সত্যি শুনতে চায় এবং সত্যিকে তাদের জীবনের ভিত্তি হিসেবে গড়ে তোলে। শৈশব থেকেই যদি শিশুদের মধ্যে অনুসন্ধান ও যুক্তির আলো জ্বলে, তাহলে তারা ভবিষ্যতে দেশের গর্বিত নাগরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। শিশুরা প্রশ্ন করতেই থাকবে, কারণ তাদের মন খোলা থাকবে। আমাদের কাজ হলো তাদের এই মনকে বন্ধ করে দেওয়া নয়, বরং পথ দেখানো। শিশুদের প্রশ্নের প্রতি যত্নবান, দায়িত্বশীল ও আন্তরিক থাকা আমাদের সামাজিক দায়িত্ব। সত্যি কথা বলুন, যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যা দিন, সহানুভূতিশীল হোন- এটাই গড়ে তুলবে এক প্রজন্ম, যারা দুর্নীতি, মিথ্যা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে অবিচল থাকবে। শৈশব থেকে যদি শিশুরা সত্যের সঙ্গে পরিচিত হয়, তবে তাদের চরিত্রে ন্যায়ের বোধ ও মানবিক মূল্যবোধের জন্ম হবে। শেষে বলি, শিশুর প্রশ্নকে কখনও ছোট করে দেখবেন না। প্রশ্নের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে ভবিষ্যতের সম্ভাবনা ও শক্তি। শিশুরা যদি সঠিক তথ্য পায়, তাহলে তারা দেশের গর্ব, মানুষের আশা এবং সমাজের আলো হতে পারে। তাই সত্য বলুন, ভালোবাসুন, সময় দিন, কারণ শিশুরা আমাদের ভবিষ্যৎ।
প্রাবন্ধিক ও শিক্ষার্থী