ঢাকা শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ন্যায়পাল হতে পারে জনস্বার্থ রক্ষায় নতুন আশার আলো

মো. বিল্লাল হোসেন জুয়েল
ন্যায়পাল হতে পারে জনস্বার্থ রক্ষায় নতুন আশার আলো

গণতন্ত্র হলো জনগণের শাসন। এটি এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়- যেসব সিদ্ধান্ত তাদের জীবনকে প্রভাবিত করে সে সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণে তারা সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দুর্নীতি এবং অব্যবস্থাপনা জনগণের জীবনকে যখন দুর্বিষহ করে তোলে, তখন সাধারণ মানুষের স্বার্থ সংরক্ষণের কণ্ঠস্বর হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে ন্যায়পাল নামক প্রতিষ্ঠান। এটি এমন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি, যিনি সরকারের প্রশাসনিক কাজকর্মে জনগণের অভিযোগের বিচার করেন এবং অন্যায় ও স্বেচ্ছাচার বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।

ন্যায়পাল ধারণার উৎপত্তি সুইডেনে ১৮০৯ সালে। ধীরে ধীরে ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়া ও আফ্রিকার বহু রাষ্ট্রে এই প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। বর্তমানে বিশ্বের অধিকাংশ গণতান্ত্রিক দেশে ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠান চালু রয়েছে। আন্তর্জাতিক ন্যায়পাল ইনস্টিটিউট এর মতে, বিশ্বব্যাপী ১০০টির বেশি দেশে ন্যায়পাল ব্যবস্থা চালু রয়েছে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে শাসনব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হচ্ছে জনগণের অধিকার সুরক্ষা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং প্রশাসনের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। রাষ্ট্র যখন নাগরিকদের প্রতি ন্যায়সঙ্গত আচরণ করতে ব্যর্থ হয়, তখন প্রশাসনের অন্যায়, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে জনগণের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে ন্যায়পাল।

বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে সুসংহত করা এবং প্রশাসনকে জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যদিও সংবিধানে ন্যায়পাল নিয়োগের বিধান রয়েছে, বাস্তবে কার্যকর হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরই ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৭৭ নম্বর অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে ‘(১) সংসদ আইনের দ্বারা ন্যায়পালের পদণ্ডপ্রতিষ্ঠার জন্য বিধান করিতে পারিবেন। (২) সংসদ আইনের দ্বারা ন্যায়পালকে কোন মন্ত্রণালয়, সরকারি কর্মচারী বা সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষের যে কোনো কার্য সম্পর্কে তদন্ত পরিচালনার ক্ষমতাসহ যেরূপ ক্ষমতা কিংবা যেরূপ দায়িত্ব প্রদান করিবেন, ন্যায়পাল সেইরূপ ক্ষমতা প্রয়োগ ও দায়িত্ব পালন করিবেন। (৩) ন্যায়পাল তাহার দায়িত্বপালন সম্পর্কে বাৎসরিক রিপোর্ট প্রণয়ন করিবেন এবং অনুরূপ রিপোর্ট সংসদে উপস্থাপিত হইবে।’ সংবিধান মোতাবেক দেশে আজ পর্যন্ত এ পদটি সৃষ্টি হয়নি। ১৯৮০ সালে দেশে ‘ন্যায়পাল আইন’ নামে একটি আইন প্রণীত হলেও তা যথেষ্ট ত্রুটিপূর্ণ ছিল। ১৮ বছর পর ১৯৯৮ সালে ন্যায়পাল ও ন্যায়পাল অফিসের কর্মচারীদের বেতন, অফিসসহ আনুষঙ্গিক বিষয়ে প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেয়েছিল। এই সংক্রান্ত ফাইলটি সংসদে পাঠানো হলেও অজানা কারণে কাজটি আর অগ্রসর হয়নি। ২০০৫ সালে কর ব্যবস্থা তদারকির জন্য ‘কর ন্যায়পাল আইন-২০০৫’ গৃহীত হয়। কিন্তু ছয় বছর পর “কর ন্যায়পাল (রহিতকরণ) বিল, ২০১১” পাসের মাধ্যমে বাংলাদেশে কর ন্যায়পালের পদ এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত সকল কার্যক্রম বাতিল করা হয়। ২০১৭ সালে সুপ্রিম কোর্টে এক আইনজীবী ন্যায়পাল নিয়োগ করার বিষয়ে রিট করেন।

২০২১ সালে রাষ্ট্রপতির নিকট দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বার্ষিক প্রতিবেদন পেশ করার সময় ‘ন্যায়পাল পদ’ প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করা হয়। এখনও পর্যন্ত কোনো সরকারই পদটি সৃষ্টি করতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি।

বর্তমানে দেশে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোসহ জনপ্রশাসনকে গতিশীল করার জন্য মানবাধিকার কমিশন, তথ্য কমিশন, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর প্রভৃতি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে; তেমনি দুর্নীতি দমন কমিশনকে পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী করা হয়েছে।

অনেকে ২০০৪ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপটে ন্যায়পালের দপ্তর প্রতিষ্ঠার আবশ্যিকতা নেই মনে করেন। দুর্নীতি দমন কমিশন মূলত আর্থিক দুর্নীতির বিচার ও প্রতিরোধের জন্য অপরদিকে ন্যায়পাল সরকারি দপ্তরে সেবাপ্রত্যাশীর ভোগান্তি বা হয়রানির প্রতিকারে দায়িত্বপ্রাপ্ত। সুতরাং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় এ দুই প্রতিষ্ঠানের কাজ সম্পূরক বা পরিপূরক হলেও কাজের ক্ষেত্র সম্পূর্ণ পৃথক।

দেশে ন্যায়পালের দপ্তর এতদিনেও প্রতিষ্ঠিত না হওয়ার কারণে সরকারি সেবাপ্রার্থীর হয়রানির যেমন কমছে না, তেমনি সেবা প্রদানকারী সরকারি দপ্তরের জবাবদিহি ও সুশাসন প্রতিষ্ঠাও বিলম্বিত হচ্ছে। নাগরিকরা দুর্নীতি দমন কমিশনে যে সংখ্যায় অভিযোগ জানান, তার ৯০ শতাংশ অভিযোগ ‘দুদক’-এর তপশিলভুক্ত দুর্নীতি সম্পর্কিত নয়। সে কারণে ‘দুদক’ এসব অভিযোগ আমলে নিতে পারে না। ২০১৭ সালে ‘দুদক’ ১৭ হাজার ৯৯৩টি লিখিত অভিযোগ পেয়েছিল; কিন্তু ৭ শতাংশ অভিযোগ আমলে নিতে পেরেছিল। অধিকাংশই দুদকের তফসিলভুক্ত দুর্নীতি সম্পর্কিত ছিল না। অধিকাংশই অভিযোগ ছিল নাগরিক সেবাপ্রাপ্তিতে হযরানি সম্পর্কিত, যা মূলত ন্যায়পালের এখতিয়ারভুক্ত। দেশে এখন যে ন্যায়পাল পদ সৃষ্টির বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে, সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং রাজনৈতিক সংস্কারের লক্ষ্যে প্রাসঙ্গিক। এই মুহূর্তে অধ্যাদেশ জারি করে ন্যায়পালকে সত্যি একজন ক্ষমতাবান ব্যক্তিতে পরিণত করার বাস্তবতা তৈরি হয়েছে।

স্বাধীনতা ৫৪ বছর পরেও এই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি। এর পেছনে কিছু গুরুতর কারণ রয়েছে। রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবই এর মূল কারণ। ন্যায়পালকে যে ক্ষমতা দেওয়া হবে, তা দিয়ে তিনি সরকারের বিভিন্ন বিভাগ, এমনকি মন্ত্রীদের বিরুদ্ধেও তদন্ত করতে পারবেন। কোনো সরকারই তাদের ক্ষমতার ওপর এমন কোনো প্রতিষ্ঠানকে নজরদারি করতে দিতে চায় না। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণও একটি বড় বাধা। সরকারি কর্মকর্তারা চান না যে তাদের কার্যক্রমের ওপর কোনো স্বাধীন সংস্থা নজরদারি করুক। এটি তাদের ক্ষমতা ও প্রভাব কমিয়ে দিতে পারে।

সুশাসনের সংকট, দুর্নীতির প্রসার, এবং জনগণের হয়রানি, রাষ্ট্রে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা, তখন ন্যায়পাল জনস্বার্থ সংরক্ষণের একটি নতুন আশার আলো হতে পারে। সময় এসেছে এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার। ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠা শুধু একটি আইনি আনুষ্ঠানিকতা নয়, এটি সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথে একটি বিপ্লবী পদক্ষেপ। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় অন্তর্বর্তী সরকার কাছে সচেতন নাগরিক সমাজ প্রত্যাশা করে, অচিরেই দেশে জাতীয় ন্যায়পাল নিয়োগবিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসবে। এটি আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী দুর্গ তৈরি করবে, নাগরিকদের অধিকারকে সুরক্ষিত করবে এবং সুস্থ ও গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, সমাজকর্ম বিভাগ

বাংলাবাজার ফাতেমা খানম কলেজ, ভোলা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত