ঢাকা শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

রাজনীতিতে অশালীনতার দায়-দায়িত্ব

শাহেদ শফিক
রাজনীতিতে অশালীনতার দায়-দায়িত্ব

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভাষার ব্যবহার এখন এক উদ্বেগজনক অবস্থায় পৌঁছেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্ব ও নেতাদের মুখ থেকে শালীন ও ভদ্র আলোচনার বদলে প্রতিনিয়ত শোনা যাচ্ছে আক্রমণাত্মক, বিদ্বেষমূলক এবং কখনও কখনও অশ্রাব্য শব্দচয়ন। এমন প্রবণতা কেবল রাজনৈতিক সৌজন্যকেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে না, বরং গণতন্ত্রের সুস্থ বিকাশকেও বাধাগ্রস্ত করছে। রাজনীতির মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত জনগণের কল্যাণ ও রাষ্ট্র পরিচালনার সুষ্ঠু পরিকল্পনা। কিন্তু যখন রাজনৈতিক ভাষা শালীনতা হারায়, তখন জনগণ রাজনীতিকে আর নীতি বা আদর্শ হিসেবে দেখে না, বরং দেখে ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা আর ক্ষমতার দ্বন্দ্ব হিসেবে। এই অবিশ্বাসই জনগণকে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।

রাজনীতি আসলে এক ধরনের জনসেবার অঙ্গীকার। কিন্তু যখন ভাষা শিষ্টাচার হারায়, তখন রাজনীতির মূল উদ্দেশ্যই আড়াল হয়ে যায়। নেতাদের উচিত মনে রাখা তাদের প্রতিটি বাক্য কেবল ব্যক্তিগত নয়, বরং জনগণের সামনে পুরো দলের মূল্যবোধের প্রতিফলন। তাই ভাষার দায়িত্বশীল ব্যবহারই গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের অন্যতম শর্ত। সম্প্রতি জুলাই আন্দোলন পরবর্তী সময়ে আন্দোলনের সহযোদ্ধারে মধ্য প্রচণ্ড অসালিক ভাষার ব্যবহার দেখা যাচ্ছে। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের সদস্য সচিব রবিউল ইসলাম নয়ন থেকে শুরু করে, বিএনপির সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা কিংবা জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণ অঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহর মধ্যকার বাকযুদ্ধ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ পুরো রাজনীতিতে নেতিবাচক বার্তা ছড়িয়েছে।

স্বাধীনতার পর থেকে এ দেশে রাজনীতি নানা উত্থান-পতনের ভেতর দিয়ে গেছে। বছর খানেক আগেও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নেমেছিল। তখনকার মঞ্চে বক্তব্য ছিল প্রেরণাদায়ী, লক্ষ্য ছিল রাষ্ট্র ও জনগণের কল্যাণ। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আজকের বাস্তবতায় রাজনীতি যেন রূপ নিয়েছে ব্যক্তিগত আক্রমণ আর নোংরা বাক্যবিনিময়ের প্রতিযোগিতায়। বাংলাদেশের ইতিহাসে ভাষার গুরুত্ব অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।’ ৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রাম প্রতিটি আন্দোলনের প্রাণ ছিল সঠিক ভাষা, স্লোগান এবং বক্তব্য। সেই ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার আলোকে বর্তমান রাজনীতিতে যদি ভাষার মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়, তবে তা শুধু রাজনীতিকেই নয়, জাতীয় চেতনাকেও আঘাত করে।

সম্প্রতি বিভিন্ন দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা একে অন্যকে উদ্দেশ্য করে যে ধরনের অসালীন মন্তব্য করেছেন, তা শুধু নেতিবাচক উদাহরণই নয়, বরং রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্যও মারাত্মক ক্ষতিকর। রাজনীতিবিদেরা যখন জাতীয় ইস্যু, জনগণের দুঃখ-কষ্ট কিংবা রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি নিয়ে পরস্পরের সঙ্গে বিতর্ক করার পরিবর্তে কেবল আক্রমণাত্মক ভাষা ব্যবহার করেন, তখন সাধারণ মানুষ রাজনীতির প্রতি আস্থা হারাতে শুরু করে। এভাবে ধীরে ধীরে রাজনীতি পরিণত হয় বিদ্বেষ ও বিভাজনের চর্চায়।

রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে প্রতিহত করার জন্য শক্তিশালী যুক্তি, প্রমাণ ভিত্তিক সমালোচনা বা গঠনমূলক কর্মসূচির অভাবই অনেক সময় নেতাদের ভাষাকে এমন আক্রমণাত্মক করে তোলে। অথচ গণতন্ত্রে মতবিরোধ স্বাভাবিক; কিন্তু মতবিরোধ প্রকাশের মাধ্যম হওয়া উচিত শালীন, যুক্তিনিষ্ঠ এবং জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য। অশ্লীলতা ও কটূক্তি মুহূর্তের আবেগ মেটাতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে তা দলীয় ঐক্য নষ্ট করে, বিরোধী শিবিরকে আরও উসকে দেয় এবং জাতীয় রাজনীতিকে আরও অস্থির করে তোলে। আক্রমণাত্মক বক্তব্যের সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয় রাজনৈতিক ঐক্যে। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের অভিজ্ঞতা বলে, বিভিন্ন মত ও দলের মধ্যে এক ধরনের ঐক্য না হলে কোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলন সফল হয় না। কিন্তু নেতারা যদি একে অন্যকে ব্যক্তিগতভাবে হেয় করার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েন, তবে সেই ঐক্য ভেঙে পড়বে। অশালীন বক্তব্য রাজনীতির ভেতরে বিভক্তি যেমন বাড়ায়, তেমনি আন্দোলনের ধারাকেও দুর্বল করে দেয়। বিরোধী শিবির যদি পরস্পরের প্রতি আস্থা হারায়, তবে স্বৈরাচারবিরোধী শক্তি সহজেই ভাঙনের শিকার হবে। ইতিহাসে বহুবার দেখা গেছে আভ্যন্তরীণ বিভাজনই গণআন্দোলনের সবচেয়ে বড় শত্রু। বাংলাদেশ এখন এক নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘ একদলীয় শাসনের অবসান ঘটিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলো গণতান্ত্রিক ধারা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য নতুন আশা জাগিয়েছে। কিন্তু এ সময়ে যদি নেতারা নিজেরাই ভদ্রতা ও রাজনৈতিক শিষ্টাচার হারিয়ে ফেলেন, তবে গণআন্দোলনের অর্জন দ্রুত ম্লান হয়ে যেতে পারে। জনগণ তখন প্রশ্ন তুলবে— ‘যারা স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছে, তারা নিজেরাই কি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চায় ব্যর্থ?’ তরুণ প্রজন্ম আজকের দিনে রাজনীতির প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে এর অন্যতম কারণ এই কুরুচিপূর্ণ বাক্যবিনিময়। বিশ্ববিদ্যালয়, সামাজিক মাধ্যম কিংবা ক্যাম্পাস রাজনীতিতে তরুণরা রাজনীতিকে ইতিবাচক শিক্ষার জায়গা হিসেবে দেখতে চায়। অথচ তারা যখন নেতাদের থেকে অশালীন ভাষা শোনে, তখন তাদের মনে প্রশ্ন জাগে রাজনীতি কি সত্যিই সমাজ বদলের হাতিয়ার, নাকি কেবল ক্ষমতার লড়াই।

রাজনৈতিক ভাষার অবক্ষয় শুধু দলগুলোর অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়, এটি গোটা সমাজের সাংস্কৃতিক মানসিকতার ওপরও প্রভাব ফেলছে। যখন জনগণ প্রতিদিন সংবাদে কিংবা টেলিভিশনে নেতাদের মুখ থেকে অশালীন শব্দ শুনে, তখন তা ধীরে ধীরে সামাজিক জীবনে ছড়িয়ে পড়ে। পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিংবা কর্মক্ষেত্র—সব জায়গায় ভাষার সৌজন্য হারাতে শুরু করে। অতএব এখনই সময় রাজনৈতিক নেতৃত্বকে ভাষার ব্যবহারে দায়িত্বশীল হতে হবে। মনে রাখতে হবে, রাজনীতির ভাষা কেবল একটি দলের নেতাকর্মীরাই শোনে না, তা শোনে দেশের কোটি মানুষ, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম। এই তরুণদের কাছে যদি রাজনীতির পাঠ হয়ে দাঁড়ায় গালিগালাজ, কটূক্তি আর ব্যক্তিগত আক্রমণ, তবে ভবিষ্যৎ গণতন্ত্রের জন্য এটি এক অশুভ বার্তা বয়ে আনবে। গণতন্ত্রের বিকাশের জন্য পার্লামেন্ট ও গণমাধ্যমে সুস্থ বিতর্ক অপরিহার্য। বিরোধী মতকে সম্মান জানিয়ে যুক্তি দিয়ে প্রতিহত করাই গণতান্ত্রিক রাজনীতির সৌন্দর্য। অথচ বর্তমান রাজনীতিতে দেখা যাচ্ছে, গঠনমূলক বিতর্কের পরিবর্তে কটূক্তিই যেন মূল হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। ফলে সংসদীয় সংস্কৃতিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। রাজনীতিতে মতভিন্নতা থাকবে, মতবিরোধ থাকবে। কিন্তু তা প্রকাশ করতে হবে সভ্যতা, সৌজন্য এবং যুক্তির মাধ্যমে। প্রতিপক্ষকে আঘাত করার জন্য নয়, বরং নিজেদের অবস্থানকে শক্তভাবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ভাষার ব্যবহার হওয়া উচিত। বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে দেখা গেছে যে সব নেতা সৌজন্য বজায় রেখেছেন, তারাই দীর্ঘমেয়াদে জনগণের আস্থা অর্জন করেছেন। যেমন, নেলসন ম্যান্ডেলা কিংবা মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে শিষ্টাচার ও সৌজন্য ছিল সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাংলাদেশের রাজনীতিতেও নেতাদের উচিত সেই শিক্ষা গ্রহণ করা। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়- যে দল বা নেতারা ভাষায় শালীনতা বজায় রেখেছেন, তারাই শেষ পর্যন্ত জনগণের হৃদয়ে জায়গা করে নিতে পেরেছেন। এখন প্রয়োজন রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে শালীনতা ও ভাষার প্রশিক্ষণ চালু করা। নেতাকর্মীরা যাতে বুঝতে পারে, ভাষা কেবল ব্যক্তিগত মতামত নয়, এটি পুরো দলের ভাবমূর্তির প্রতিফলন। দল যদি এ বিষয়ে কঠোর হয়, তবে নেতাদের ভাষা ব্যবহারে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। আজকের রাজনীতিবিদদের জন্য বার্তাটি স্পষ্ট ভাষার সংস্কৃতি বদলানো এখন সময়ের দাবি। আক্রমণ নয়, শালীন সংলাপই গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। এভাবে অশালীন রাজনৈতিক ভাষা কেবল দেশের অভ্যন্তরীণ ঐক্যকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে না, বরং বৈদেশিক অঙ্গনেও রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি কলুষিত করে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত