প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
বাংলাদেশে উন্নয়ন নিয়ে প্রতিদিন গল্প বলা হচ্ছে। নতুন সেতু, ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল, স্যাটেলাইট- এসব অর্জন নিয়ে আমরা উচ্ছ্বসিত। কিন্তু উন্নয়নের আসল প্রশ্ন হলো- এই সমাজের সবচেয়ে অসহায় মানুষগুলো কতটা সুরক্ষা পাচ্ছে? অনাথ শিশুদের দিকে তাকালেই সেই উত্তর মেলে। আমরা গর্ব করি মাথাপিছু আয়ে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে, কিন্তু লাখো অনাথ শিশুর চোখে চোখ রাখলে বোঝা যায় আমরা এখনও মানবিক উন্নয়নের পরীক্ষায় ফেল করছি।
অনাথ মানে শুধু বাবা-মা হারানো শিশু নয়। অনেক সময় বাবা-মা জীবিত থেকেও শিশু অনাথ হয়ে যায়। দারিদ্র?্য, পারিবারিক ভাঙন, অকাল বিবাহ, মাদকাসক্তি কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগে অনেক শিশু পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। কাউকে আবার জন্মের পরই ফেলে দেওয়া হয় হাসপাতালের করিডোরে বা রাস্তার ডাস্টবিনে। তারা রাষ্ট্রের নাগরিক; কিন্তু সমাজের কাছে পরিচয় হয়- ‘পরিত্যক্ত’। এই শব্দটাই শিশুর জীবনের শুরুতে বঞ্চনার ছাপ ফেলে দেয়।
সরকারি হিসাব মেলে না, বেসরকারি গবেষণা ভিন্ন সংখ্যা বলে। কিন্তু ধারণা করা হয় বাংলাদেশে অন্তত ১১ লাখ শিশু অনাথ বা পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। রাজধানী ঢাকায় শুধু পথশিশুর সংখ্যা দুই লাখের বেশি। প্রতিদিন যারা ট্রাফিক সিগন্যালে ফুল বিক্রি করছে, জুতার ব্রাশ করছে, প্লাস্টিক কুড়াচ্ছে, তাদের একটা বড় অংশ অনাথ। অথচ তারা কোনো সরকারি নথিতে দৃশ্যমানই নয়।
রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ আছে। প্রতিটি জেলায় কিছু সরকারি আশ্রয়কেন্দ্র আছে, পাশাপাশি আছে বেসরকারি এতিমখানা। ধর্মীয় সংগঠনগুলোও অনেক এতিমখানা চালায়। কাগজে কলমে এই সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এসব প্রতিষ্ঠানের অবস্থা ভয়াবহ। অধিকাংশ জায়গায় খাদ্যের মান নিম্নমানের, শিশুদের জন্য আলাদা চিকিৎসক নেই, শিক্ষার মান খুবই দুর্বল। দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনার কারণে সরকার যে টাকা বরাদ্দ করে তার বড় অংশই ভিন্ন খাতে চলে যায়। শিশুদের হাতে পৌঁছায় না পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার, ভালো বই বা দক্ষতা উন্নয়নের সুযোগ।
এতিমখানার ভেতর এক ধরনের কৃত্রিম নিরাপত্তা তৈরি হয়। বাইরে থেকে মনে হয়- শিশুরা নিরাপদ আছে, মাথার উপর ছাদ আছে, দিনে তিনবেলা খাবার পাচ্ছে। কিন্তু অনাথ শিশু শুধু আশ্রয়ে বাঁচে না। তার দরকার ভালোবাসা, ব্যক্তিত্ব গঠনের পরিবেশ, জীবনের বাস্তব দক্ষতা শেখার সুযোগ। এগুলো নেই বললেই চলে। একটি শিশু যখন প্রতিদিন মনে করে- ‘আমি একা, আমার কেউ নেই’- তখন সেই একাকিত্ব তাকে ভেতরে ভেতরে ভেঙে দেয়।
সমস্যা শুধু আশ্রম নয়, আমাদের সামাজিক মানসিকতা। আমরা মৌসুমি দয়া দেখাই। ঈদে নতুন জামা দিয়ে এলাম, কোরবানির সময় মাংস দিলাম, এতেই আমাদের দায়িত্ব শেষ। বছরের বাকি সময় শিশুদের কথা মনে থাকে না। যেন তারা কেবল উৎসবের সাজসজ্জার অংশ। অথচ সমাজের প্রতিটি শিশু যদি দেশের ভবিষ্যৎ হয়, তবে অনাথ শিশু কেন ভবিষ্যতের বাইরে থাকবে?
মৌলিক প্রশ্ন হলো- আমরা কি করুণা দেখাতে চাই, নাকি অধিকার নিশ্চিত করতে চাই? করুণা দিয়ে ক্ষণিকের ক্ষুধা মেটে, কিন্তু করুণা মর্যাদা দেয় না। মর্যাদা আসে সমান সুযোগ থেকে। অথচ অনাথ শিশুরা সেই সুযোগ পায় না। স্কুল-কলেজে ভর্তি হতে গেলেই বাধা, চিকিৎসা নিতে গেলেও অবহেলা। ‘এতিম’ শব্দটি শুনলেই সমাজ সমবেদনা দেয়; কিন্তু সমান মর্যাদা দিতে চায় না। এখানেই আমাদের ব্যর্থতা।
রাষ্ট্রের ব্যর্থতার পাশাপাশি সমাজও দায়ী। অনাথ শিশুদের আমরা আলাদা শ্রেণি বানিয়ে রেখেছি। তাদের সাথে সাধারণ শিশুদের মিলেমিশে বেড়ে ওঠার সুযোগ নেই। ফলে সামাজিকভাবে তারা বিচ্ছিন্ন থাকে। বড় হয়ে যখন কর্মসংস্থানের জন্য বের হয়, তখনও তারা পিছিয়ে থাকে। কারণ আশ্রমের শিক্ষা তাদের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার মতো মানসম্পন্ন নয়।
এই বঞ্চনার সুযোগ নেয় অপরাধচক্র। পথশিশুদের একটা বড় অংশ মাদক পাচার, ভিক্ষাবৃত্তি, চুরি কিংবা যৌন শোষণের ফাঁদে পড়ে। সংবাদপত্রে শিশু অপরাধীর খবর পড়লে আমরা আঁতকে উঠি; কিন্তু খুব কমই ভাবি- তার পেছনে হয়তো আছে এক অনাথ আশ্রমের অন্ধকার, এক মা-বাবাহীন জীবনের ক্ষত।
আন্তর্জাতিক পরিসরে অনাথ শিশুদের জন্য বিকল্পব্যবস্থা রয়েছে। উন্নত দেশগুলোতে দত্তক গ্রহণ, ফস্টার কেয়ার, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা ও পরিবারভিত্তিক যত্ন প্রতিষ্ঠিত। নরওয়ে, সুইডেন বা কানাডায় কোনো শিশুকে দীর্ঘদিন আশ্রমে রাখা হয় না। পরিবারভিত্তিক যত্নে শিশুকে বড় করা হয়, যাতে সে সমাজের মূলধারায় বেড়ে উঠতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে দত্তক নেওয়ার সংস্কৃতি প্রায় নেই বললেই চলে। আইনি জটিলতা আর সামাজিক কুসংস্কার এর বড় বাধা। মুসলিম পরিবারগুলো ‘কাফালা’ পদ্ধতিতে শিশুকে লালন করতে পারে, কিন্তু বাস্তবে সেই উদ্যোগ অতি সীমিত। ফলে অনাথ শিশুর জীবনের বড় সময়টাই আশ্রমের চার দেয়ালের ভেতরে কেটে যায়।
প্রশ্ন উঠছে- সমাধান কোথায়? প্রথমত, আশ্রমগুলোকে আধুনিক করতে হবে। শুধু খাওয়ানো নয়, মানসম্মত শিক্ষা, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা, তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষা, কর্মমুখী প্রশিক্ষণ- সবকিছু নিশ্চিত করতে হবে। আশ্রমকে হতে হবে একটি পূর্ণাঙ্গ শিক্ষাকেন্দ্র। দ্বিতীয়ত, দত্তক গ্রহণ প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে। যে পরিবার শিশুকে গ্রহণ করতে চায়, তাদের জন্য আইনি ও সামাজিক বাধা কমাতে হবে। মিডিয়া ও সংস্কৃতির মাধ্যমে দত্তক নেওয়াকে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করতে হবে।
তৃতীয়ত, অনাথ শিশুদের জন্য আলাদা শিক্ষা ও কর্মসংস্থান কোটাকে বাস্তবায়ন করতে হবে। উচ্চশিক্ষায়, সরকারি চাকরিতে, কারিগরি শিক্ষায় তাদের জন্য নির্দিষ্ট আসন থাকতে হবে। চতুর্থত, মানসিক স্বাস্থ্যসেবার গুরুত্ব দিতে হবে। প্রতিটি আশ্রমে একজন কাউন্সেলর থাকা উচিত, যিনি শিশুদের মানসিক আঘাত থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করবেন। পঞ্চমত, সামাজিক সচেতনতা তৈরি করতে হবে। মিডিয়া, সাহিত্য, নাটক, সিনেমায় অনাথ শিশুদের করুণার প্রতীক নয়, বরং মর্যাদার প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করতে হবে।
বাংলাদেশ উন্নয়নের গল্প শোনাচ্ছে; কিন্তু অনাথ শিশুদের গল্প যেন হারিয়ে যাচ্ছে। পদ্মা সেতু যতটা আমাদের গর্বিত করে, অনাথ শিশুর চোখের জল ততটাই আমাদের ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। যদি লাখো শিশু অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকে, তবে আমাদের উন্নয়ন কতটা মানবিক তা নিয়েই প্রশ্ন উঠবে। আজ প্রয়োজন দয়া নয়, প্রয়োজন অধিকার। অনাথ শিশুর কপালে করুণার হাত নয়, থাকা উচিত সমান সুযোগের ছায়া। সমাজ যদি সত্যিই পরিবর্তন চায়, তবে এই শিশুদের আর একা ফেলে রাখা যাবে না। কারণ অনাথ শিশু মানে শুধু এক পরিবারহীন শিশু নয়- সে মানে রাষ্ট্রের একটি অসমাপ্ত প্রতিশ্রুতি। আর সেই প্রতিশ্রুতিকে পূর্ণ করতে না পারলে উন্নয়নের যেকোনো গল্পই শেষ পর্যন্ত বঞ্চনার গল্প হয়ে থাকবে।
লেখক : সোনাতলা, বগুড়া