প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা জাতীয় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও ঘটছে দুর্ঘটনা। হতাহত হচ্ছে। দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল।
এমন কোনো দিন নেই সড়কে প্রাণ ঝরছে না। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে বিভিন্ন সময় নানা আলোচনা, সমালোচনা, প্রতিবাদণ্ডবিক্ষোভ, সভা-সমাবেশ হলেও তাতে বাস্তবধর্মী কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করার কারণে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। প্রত্যেক বছর সড়ক দুর্ঘটনায় হাজার হাজার মানুষ নিহত হলে ও দুর্ঘটনা রোধে সরকারি কোনো কার্যকরী উদ্যোগ নেই। প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনায় পারিবারিক, সামজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বড় ধরনের ক্ষয় ক্ষতি হচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনায় সবছেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জীবন ও সম্পদের। একটি দুর্ঘটনায় সারা জীবনের গ্লানি বয়ে বেড়ায় ভুক্তভোগী পরিবার। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পাশাপাশি অসংখ্য মানুষ সারাজীবনের জন্য পঙ্গুত্ববরন করছে। স্বজন হারিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছেন স্বজনরা।
বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির সড়ক দুর্ঘটনা সংক্রান্ত প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী ২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ১১ বছরের সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্য ও আহতদের বিশ্লেষণে চিত্র দেখা গেছে, দেশের সড়ক ও মহাসড়কে ৬২,৭১৫টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে শুধুমাত্র ২০২৪ সালে মারা গিয়েছে ৮,৫৪৩ জন মানুষ, আর আহত হয়েছে ১৪ হাজারেরও বেশি মানুষ। ২০১৯ থেকে ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাস পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৪২০০০ হাজারের বেশি মানুষ। বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হচ্ছে বেপরোয়া গাড়ি চালানো, চলন্ত অবস্থায় মোবাইল ব্যবহার, চোখে সমস্যা, চোখে ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে গাড়ি ড্রাইভ, হেলপার দ্বারা গাড়ি চালানো, মাদক সেবন, অসুস্থ প্রতিযোগিতা, অযথা ওভারটেক, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, নজরদারি ও তদারকির অভাব, ট্রাফিক আইন না মানা ও চালকদের অদক্ষতা দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। অবাক করা বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশের আইনে একজন মানুষের জীবনের চেয়ে একটি পশুর মূল্য (বাঘ) অনেক বেশি। যদি সড়ক দুর্ঘটনায় ড্রাইভারের ভুলে কিংবা ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো মানুষের মৃত্যু হয়, তাহলে ড্রাইভারের সর্বোচ্চ ৫ বছর শাস্তির বিধান রয়েছে। আর কোনো মানুষ ইচ্ছাগতভাবে একটি বাঘ হত্যা করে তাহলে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন ২০১২ অনুযায়ী ৭ বছর জেল ও সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা জরিমানা নির্ধারন করা হয়েছে।
অতি সম্প্রতি নোয়াখালীতে সংগঠিত মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় এ দেশের আপাময় জনসাধারণের অন্তরে নাড়া দিয়েছে। গত ৬ আগস্ট ভোরে ওমান প্রবাসী বাহার স্বজনকে নিয়ে বিমানবন্দর থেকে লক্ষ্মীপুরে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার পথে বাইক্রোবাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খালে পড়ে গেলে একই পরিবারের তিন শিশুসহ ৭ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। গাড়ির চালককে বার বার লক খুলতে অনুরোধ করলেও তিনি কর্ণপাত করেননি। দরজার লক ও জানালা খুলতে না পাড়ায় পানির মধ্য ডুবে সবার মৃত্যু হয়। চালকের চোখে ঘুম ঘুম ভাব থাকায় এ দুর্ঘটনা হয়ে বলে নিহতের স্বজনরা জানান। এগুলো নিছক বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। এরকম অসংখ্য ঘটনা প্রতিনিয়ত আমাদের চারপাশে ঘটছে। এমন কোনো দিন নেই সড়কে প্রাণ ঝরছে না।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বাংলাদেশের সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহীন গাড়ি চালনা। এদেশের বেশিরভাগ চলকের ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার প্রক্রিয়ায় ও অসচ্ছতা রয়েছে। সঠিকভাবে যাচাই-বাচাই না করেই অনেক সময় অবৈধ উপায়ে অদক্ষ চালককে লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে। প্রশিক্ষণবিহীন এ সমস্ত অদক্ষ চালকরা সড়ক মহাসড়কে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার সম্মুখীন হচ্ছে। পরিবহন মালিকদের লাইসেন্সবিহীন চালকের হাতে যানবাহন তুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে। বাংলাদেশে সড়ক মহাসড়কগুলোয় দুর্ঘটনার পেছনে বেপরোয়া গাড়ি চালনাসহ বেশ কিছু কারণ বেড়িয়ে এসেছে। এর মধ্য দুর্ঘনার বড় কারণ হচ্ছে প্রতিযোগিতার মনোভাব নিয়ে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালনো। যাত্রীবাহী বাসগুলোর মধ্য অসুস্থ প্রতিযোগিতা চালকের বেপরোয়া মনোভাবকে উৎসাহ দিচ্ছে। ‘সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য বেশি’ একথা চালকদের স্মরন রাখতে হবে।
প্রতিদিন স্বল্প পরিমাণ সড়কে বিপুলসংখ্যক যানবাহন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে সবার আগে প্রয়োজন চালকদের সচেতনতা। চালকদের গাড়ি চালানোর জন্য যে ধরনের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দরকার সেটা নেই। অনেক চালকরা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় গাড়ি চালিয়ে দুর্ঘটনার সম্মুখীন হচ্ছে। কোনো অবস্থায় নিয়মের বহির্ভূত বেপরোয়া গতিতে গাড়ি ড্রাইভ করা যাবে না। তাহলে দুর্ঘটনা যেমন কমবে সড়কে ফিরবে শৃঙ্খলা। বাংলাদেশের গ্রাম ও শহরের অধিকাংশ যানবাহন ফিটনেসবিহীন লক্কর-ঝক্কর। দেশের প্রচলিত আইনে ২০ বছরের পুরোনো বাস এবং ২৫ বছরের পুরোনো ট্রাক চালানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হলে ও এই আইন মানছে না কেউই। সারা দেশে মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহনের সংখ্যা ৭৫০০০ হাজারের বেশি। সড়কে বিশৃঙ্খলা ও বায়ুদূষণের জন্য মেয়াদোত্তীর্ণ ভাঙাচোরা বাসগুলোই দায়ী। সরকার বদল হয়, প্রশাসন বদল হয়; কিন্তু মেয়াদোত্তীর্ণ বাস ট্রাকগুলোর চিত্র বদল হয় না। পরিবহন মালিক শ্রমিক নেতাদের চাপের মুখে দীর্ঘদিন ধরে এসব যানবাহন ফিটনেসবিহীন অবস্থায় চলাচল করলে ও সরকারের তরফ হতে কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করো হয়নি। মাঝেমধ্য সড়ক পরিবহন অধিদপ্তর থেকে লোক দেখানো কিছু অভিযান পরিচালনা করলেও অধিকাংশ যানবাহন ফিটনেসবিহীন অবস্থায় রাস্তায় চলাচল করছে। যার কারণে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার সম্মুখীন হচ্ছে এবং যানমালের ক্ষতি হচ্ছে। বাংলাদেশের ৬০ শতাংশ চালক উচ্ছ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিকসসহ নানা রোগে আক্রান্ত। গাড়ি চালানোর জন্য যে ফিটনেস দরকার, এসব চালকদের তা নেই। অধিকাংশ চালকদের মধ্য সড়ক পরিবহন আইন সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব রয়েছে। চালকরা যথাযত প্রশিক্ষণ না পাওয়ায় সড়কের চিহ্ন এবং আইনকানুন সম্পর্কে পরিষ্কার কোনো ধারণা নেই। রোড সিগন্যাল না মানা এবং সড়কে শৃঙ্খলা না থাকায় দুর্ঘটনা বাড়েছে। অনুন্নত যোগাযোগব্যবস্থা ও অপ্রশস্ত রাস্তার কারণে অধিকাংশ যানবাহন সড়ক মহাসড়কে চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। অন্যদিকে রাস্তাঘাটের বেহাল অবস্থা, পরিবহন ব্যবস্থার দুর্দশাকে আরও প্রকট করে তুলছে। এছাড়া রাস্তার তুলনায় গাড়ির সংখ্যা বেশি হওয়ায় গাড়ি চালনায় নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সড়কে ফিটনেসবিহীন লক্কর-ঝক্কর বাস ও ট্রাকগুলোকে ফিটনেস সনদ দেওয়া বন্ধ করে সড়ক থেকে অপসারণ করতে হবে। প্রশিক্ষিত দক্ষ চালককে ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদান করতে হবে। অল্পবয়সি কিশোরদের হাতে গাড়ি তুলে দেওয়া যাবে না। প্রয়োজনে লাইসেন্স বাতিলের উদ্যোগ নিতে হবে। যাত্রী ও চালককে বাধ্যতামূলক সিটবেল্ট ও হেলমেট পরিধারন করার জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে উন্নত দেশের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশে ও একই কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে। জনগণের দীর্ঘদিনের দাবি সড়ক দুর্ঘটনা রোধে একটি সময়োপযোগী সড়ক পড়িবহন আইন করার। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ২০১৮ সালের যে আইন রয়েছে তার পূর্ণাঙ্গ প্রয়োগ নেই। এই আইনে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের কঠোর শাস্তির নজির নেই। সড়ক পরিবহন আইনে দুর্ঘটনায় প্রাণহানির দায়ে সাজার যে ধারা রয়েছে, তা সংশোধন করতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধ এবং সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে প্রয়োজন সরকারের বাস্তবসম্মত ও দৃশ্যমান পদক্ষেপ। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ ও হতাহত কমাতে প্রশাসনকে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।