প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
বাংলাদেশে শিশু অধিকার নিয়ে যত সুন্দর কথা, যত দৃষ্টিনন্দন নীতিমালা, যত দিবস উদযাপন- সবই কাগজে-কলমে। বাস্তব মাঠে পরিস্থিতি ভয়াবহ। জন্ম নেওয়া প্রতিটি শিশুর মৌলিক অধিকার হলো মায়ের দুধ পাওয়া। অথচ পরিসংখ্যান বলছে, দেশে অর্ধেকের বেশি শিশু নিয়মিত মায়ের দুধ পায় না। এ সংখ্যা নিছক তথ্য নয়, বরং রাষ্ট্র, সমাজ আর কর্পোরেট স্বার্থের জটিল জালের এক নগ্ন দলিল। আমরা মুখে বলি শিশু হলো ভবিষ্যৎ, শিশু হলো জাতির আশা, শিশু হলো উন্নয়নের চালিকাশক্তি। কিন্তু জন্মের প্রথম ঘণ্টা থেকেই তাকে আমরা বঞ্চিত করি তার প্রাথমিক খাদ্য থেকে। এটা নিছক অবহেলা নয়, বরং শিশুর অধিকার হরণের এক ধরনের বৈধীকৃত সামাজিক অপরাধ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফ স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে, শিশুর জন্মের প্রথম এক ঘণ্টার মধ্যে স্তন্যপান শুরু করতে হবে এবং ছয় মাস পর্যন্ত কেবলমাত্র মায়ের দুধ খাওয়াতে হবে। এরপর দুই বছর পর্যন্ত পরিপূরক খাবারের পাশাপাশি মায়ের দুধ চালিয়ে যেতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। মায়ের দুধ শিশুর জন্য প্রথম ভ্যাকসিন, প্রথম রোগপ্রতিরোধী, প্রথম পুষ্টি। কিন্তু বাংলাদেশে এ সহজতম বিষয়টিই নিশ্চিত করতে পারি না। কেন পারি না? এ প্রশ্নটাই আসল। সমস্যার প্রথম কারণ সামাজিক কুসংস্কার। এখনও দেশের বহু পরিবারে জন্মের পর প্রথম দুধ বা কলোস্ট্রামকে নোংরা মনে করা হয়। গ্রামের বহু এলাকায় প্রথমে শিশুর মুখে মধু, মিষ্টি বা গুলানো চিনি দেওয়া হয়। আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্র বারবার বলছে- এ কলোস্ট্রামই শিশুর জন্য সেরা অ্যান্টিবডির ভাণ্ডার। তবুও অভ্যাসগত অজ্ঞতা এখনও শিশুর অধিকারকে হরণ করছে। দ্বিতীয় কারণ কর্পোরেট আগ্রাসন। বহুজাতিক শিশুখাদ্য কোম্পানিগুলো হাসপাতাল থেকে শুরু করে ফার্মেসি পর্যন্ত নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করে। চিকিৎসকদের উপহার দেওয়া হয়, ফার্মেসিগুলোকে লোভনীয় কমিশন দেওয়া হয়, বিজ্ঞাপন ও মিডিয়া ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে প্রচার করা হয়- ‘ফর্মুলা দুধই আধুনিক জীবনযাত্রার প্রতীক।’ অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আন্তর্জাতিক কোড অনুযায়ী এসব বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ। বাংলাদেশেও আইন আছে। কিন্তু প্রয়োগ? আইন আছে কাগজে, কোম্পানির ব্যবসা চলে রাস্তায়।
তৃতীয় কারণ কর্মক্ষেত্রের নিষ্ঠুর বাস্তবতা। শহরের অফিস থেকে শুরু করে তৈরি পোশাক কারখানা- প্রায় কোথাও স্তন্যদানের অনুকূল পরিবেশ নেই। মাতৃত্বকালীন ছুটি কাগজে আছে, বাস্তবে অনেক প্রতিষ্ঠান তা মানে না। যারা কিছু ছুটি পানও, তাদের জন্য ছয় মাস পূর্ণ স্তন্যপান নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। অফিসে বা কারখানায় দুধপান কক্ষ নেই। ফলে মা বাধ্য হন ফর্মুলার দিকে যেতে। একদিকে কর্মজীবী মায়ের জীবনের চাপ, অন্যদিকে রাষ্ট্রের উদাসীনতা- মিলে গিয়ে শিশুর মৌলিক অধিকার হরণ হয় প্রতিদিন।
চতুর্থ কারণ রাষ্ট্রের অবহেলা। সরকারি নীতিমালায় সুন্দর সুন্দর লক্ষ্য আছে। জাতীয় পুষ্টি নীতিমালায় লেখা আছে, ‘শিশুর জন্মের প্রথম ঘণ্টায় স্তন্যপান শুরু এবং ছয় মাস পর্যন্ত একচেটিয়া স্তন্যপান নিশ্চিত করা হবে।’ কিন্তু হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, নবজাতককে প্রথমেই গুঁড়ো দুধের বোতল ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। প্রসূতি মায়েদের স্তন্যদান শেখানোর মতো প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী নেই। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যারা আছেন, তারাও অনেকে ভুল ধারণা দেন- ‘দুধ না নামলে ফর্মুলা খাওয়ান।’ এ দায় কি কেবল মায়ের? না, এ দায় রাষ্ট্রের ব্যর্থতা।
ফলাফল ভয়াবহ। বাংলাদেশে শিশু মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ এখনও নিউমোনিয়া আর ডায়রিয়া। গবেষণা বলছে, মায়ের দুধ না খাওয়া শিশুরা এসব রোগে বহুগুণ বেশি আক্রান্ত হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানায়, প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় আট লাখ শিশু কেবল স্তন্যপান না করানোর কারণে মারা যায়। বাংলাদেশেও খর্বাকৃতির শিশুদের হার এখনও ৩০ শতাংশের ওপরে। অর্থাৎ প্রতি তিনটি শিশুর মধ্যে একজন শারীরিক ও মানসিক বিকাশে পিছিয়ে যাচ্ছে। এ চিত্র কেবল স্বাস্থ্যগত নয়, এটি অর্থনৈতিক ক্ষতিও ডেকে আনে। ফর্মুলা দুধ কিনতে গিয়ে পরিবারগুলো মাসে গড়ে দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকা ব্যয় করে। নিম্নবিত্ত পরিবারের জন্য এটি অযৌক্তিক বোঝা। নিরাপদ পানি বা স্যানিটেশন না থাকায় ফর্মুলা দুধই হয়ে ওঠে শিশুর অসুখের কারণ।
কিন্তু ক্ষতি এখানেই থেমে থাকে না। স্তন্যদান কেবল খাদ্য নয়, এটি আবেগীয় বন্ধন। মায়ের শরীরের উষ্ণতা, শিশুর নিরাপত্তাবোধ, মানসিক বিকাশ- সবকিছু মায়ের দুধের সঙ্গে সম্পর্কিত। যখন শিশুকে জন্মের পরই বোতলে ঠেলে দেওয়া হয়, তখন এই বন্ধন দুর্বল হয়। দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব পড়ে শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যে, আত্মবিশ্বাসে, এমনকি ভবিষ্যতের সামাজিক আচরণেও। আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা দেখলে স্পষ্ট হয়, ইচ্ছা থাকলে পরিবর্তন সম্ভব। শ্রীলঙ্কা বহু বছর আগে থেকেই সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে দুধপান কক্ষ বাধ্যতামূলক করেছে। ভিয়েতনাম মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস করেছে। ফলে সেখানে শিশুরা শতভাগ মায়ের দুধ পায়। আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলোতেও সচেতনতা বাড়িয়ে স্তন্যপানের হার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ কেন পারবে না? এখানে ইচ্ছার অভাব, অগ্রাধিকার না দেওয়া, এবং কর্পোরেট স্বার্থের কাছে আত্মসমর্পণই প্রধান কারণ। দায় কেবল মায়ের নয়। পরিবারকেও দায় নিতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে দাদি-নানি কুসংস্কার চাপিয়ে দেন, মা বাধ্য হন মানতে। চিকিৎসকদেরও দায় আছে। অনেক চিকিৎসক নিজের সুবিধা বা অজ্ঞতার কারণে ফর্মুলা পরামর্শ দেন। কর্মক্ষেত্রেরও দায় আছে। রাষ্ট্রের দায় সবচেয়ে বেশি। যদি মাতৃত্বকালীন ছুটি বাস্তবায়ন না হয়, যদি অফিসে দুধপান কক্ষ বাধ্যতামূলক না হয়, যদি বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণ না হয়, তাহলে শিশুর অধিকার রক্ষা করবে কে?
এখন প্রশ্ন- আমরা কী চাই? কর্পোরেট কোম্পানির মুনাফা, না ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বাস্থ্য? যদি সত্যিই শিশুকে ভবিষ্যৎ বলে মনে করি, তাহলে অবিলম্বে কয়েকটি কাজ করতে হবে। প্রথমত, মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানে স্তন্যদানের কক্ষ বাধ্যতামূলক করতে হবে। তৃতীয়ত, ফর্মুলা দুধের বিজ্ঞাপন ও কর্পোরেট আগ্রাসন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। চতুর্থত, হাসপাতালে প্রসূতি মায়েদের সহায়তায় বিশেষ প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ দিতে হবে। পঞ্চমত, কুসংস্কার ভাঙতে জাতীয় পর্যায়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে।
এসব উদ্যোগ কোনো বিলাসিতা নয়। এটি একটি প্রজন্মকে সুস্থ, শক্তিশালী, মেধাবী করে গড়ে তোলার জন্য অপরিহার্য। কারণ মায়ের দুধ কেবল খাদ্য নয়, এটি একটি শিশুর জন্মগত অধিকার। এ অধিকার কেড়ে নেওয়া মানে তাকে অসুস্থতার দিকে ঠেলে দেওয়া, তাকে বৈষম্যের দিকে ঠেলে দেওয়া। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশ। আমরা পদ্মা সেতু বানিয়েছি, মেট্রোরেল চালু করেছি, উপগ্রহ পাঠিয়েছি। এসব নিয়ে আমাদের গর্ব আছে। কিন্তু উন্নয়নের আসল মানদ- হলো ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সক্ষমতা। সেই প্রজন্ম যদি জন্মের পর প্রথম খাবার থেকেই বঞ্চিত হয়, তবে সব উন্নয়নই প্রশ্নবিদ্ধ। আমরা কী ধরনের উন্নয়ন চাই? ইট-পাথরের উন্নয়ন, না মানুষের উন্নয়ন?
আজকের শিশুই আগামী দিনের নাগরিক। জন্মের পর প্রথম খাবার থেকে তাকে বঞ্চিত করা মানে তার মৌলিক অধিকার কেড়ে নেওয়া। রাষ্ট্র, সমাজ আর পরিবার যদি এই মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে না পারে, তবে শিশু অধিকার, পুষ্টি নীতি, টেকসই উন্নয়ন- সবই অর্থহীন বুলি ছাড়া আর কিছু নয়।
লেখক : তেকানীচুকাইনগর, সোনাতলা, বগুড়া