প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
গণতন্ত্র সমাজ বা রাষ্ট্রব্যবস্থার একটি বিশেষ রূপ। জনগণের সরকার ব্যবস্থা হিসাবেই এটি সমাদৃত হচ্ছে। ইংরেজি Democracy শব্দের বাংলা অর্থ গণতন্ত্র। ইংরেজি Democracy শব্দটি গ্রীক শব্দ Demos I Kratia থেকে উৎপন্ন হয়েছে। Demos শব্দের অর্থ জনগণ আর Kratia শব্দের অর্থ শাসন বা ক্ষমতা। উভয় শব্দের মিলিত অর্থ দাঁড়ায় জনগণের শাসন বা জনগণের ক্ষমতা। জনপ্রিয়ভাবে গণতন্ত্র বলতে বোঝায়, একটি বিশেষ ধারণা বা পদ্ধতি যেখানে সামাজিক ব্যবস্থা-রাষ্ট্রের বিধানাবলি প্রণয়ণের চূড়ান্ত ক্ষমতা অর্পণ করা হয় জনগণের উপর বা তাদের মনোনীত প্রতিভুর উপর। সংক্ষেপে বলতে গেলে বৃহত্তর অংশের অভিমতের ভিত্তিতে শাসনকার্য পরিচালনাকে গণতন্ত্র বলে।
অন্যতম শীর্ষ প্রবক্তা ‘আমেরিকান প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন ১৮৬৩ সালে গেটিসবার্গের এক জনসভায় ‘গণতন্ত্র’-এর অর্বাচীন সংজ্ঞা দেন এভাবে যে, Democracy is the government of the people by the people and for the people. অর্থাৎ ‘গণতন্ত্র এমন একটি সরকার ব্যবস্থা, যা জনগণের উপর জনগণের দ্বারা পরিচালিত জনগণের শাসন ব্যবস্থা বুঝায়’।
গ্রীক ঐতিহাসিক ও দার্শনিক হিরোডোটাস (Herodotus) গণতন্ত্রের সংজ্ঞায় বলেন, এটা এক প্রকার শাসনব্যবস্থা যেখানে শাসনক্ষমতা কোন শ্রেণী বা শ্রেণীসমূহের উপর ন্যস্ত থাকে না, সমাজের সদস্যগণের উপর ন্যস্ত হয় ব্যাপকভাবে’।
অধ্যাপক শেলী বলেন, Democracy is a form of government in which every one has a share in it. অর্থাৎ ‘যে সরকারব্যবস্থায় সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত থাকে তাকে গণতন্ত্র বলে’। সারকথা জনগণের অভিপ্রায় সদৃশ শাসনব্যবস্থার অভিধাই গণতন্ত্র। অন্যভাবে বলতে গেলে গণতন্ত্র হল গণতন্ত্র হ’ল এমন একটি শাসন ব্যবস্থা যা সম্পূর্ণরূপে জনসমষ্টির ইচ্ছাধীনে পরিচালিত।
এখন আসছি এ নিবন্ধের প্রধান বিষয় গণতন্ত্র ও ইসলামের সম্পর্ক নিয়ে : গণতন্ত্র বিষয়ে অনেকে ব্যাখ্যা প্রদান করেন যে- ‘বর্তমানে যে কয়টি রাজনৈতিক মতবাদ প্রচলিত আছে, তন্মধ্যে গণতন্ত্র অন্যতম ধর্মহীন। ধর্মহীন জাতীয় গণতন্ত্র মতবাদটি ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র এবং জাতীয়তাবাদ এই তিনটি মতাদর্শের সমন্বয়। তারা আরও যোগ করেন যে এই তিনটি মতবাদ একটি সুদৃঢ় যোগসূত্রে বাঁধা।
এ বিষয়ে আমার ধারণা হলো- বাংলাদেশ যে উদ্দেশ্যে ১৯৭২ সালে সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা সংযুক্ত করা হলো- ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ হলো রাষ্ট্র ও ধর্মকে আলাদা রাখা এবং রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের প্রতি পক্ষপাতিত্ব না করা। এটি এমন একটি নীতি যা কোনো নির্দিষ্ট ধর্মকে সমর্থন না করে মানববিষয় ও নাগরিক অধিকারকে গুরুত্ব দেয়। এর মূল উদ্দেশ্য হলো ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষা করা। জাতীয়তাবাদ- হলো নিজের জাতির প্রতি গভীর প্রেম ও গর্বের একটি শক্তিশালী অনুভূতি। এটি এমন একটি ধারণা যা একটি নির্দিষ্ট জাতির স্বার্থকে অন্য সকল কিছুর উপরে স্থান দেয় এবং একটি জাতির নিজস্ব স্বায়ত্তশাসিত, স্বাধীন রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠা ও রক্ষণাবেক্ষণে বিশ্বাসী।
আল্লাহতায়ালা তাঁর মনোনীত দ্বীন ইসলামকে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মাধ্যমে পূর্ণতা দান করেছেন। তিনি মুমিনদের নির্দেশ দিয়েছেন পরিপূর্ণভাবে ইসলামের মধ্যে প্রবেশ করতে। সুযোগ নেই এ দ্বীনের মধ্যে কিছু সংযোজন, বিয়োজন কিংবা পরিবর্তন, পরিবর্ধন করার। বড়ই আফসোসের বিষয় আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও দেখা যাচ্ছে এক শ্রেণির মুসলিমের মধ্যে ইসলামে সংযোজন-বিয়োজনের প্রবণতা।
আধুনিককালের পশ্চিমা সভ্যতার আগ্রাসী জোয়ারকে যৌক্তিকভাবে মোকাবিলায় অক্ষম এক শ্রেণির ইসলামী চিন্তাবিদ বিজাতীয় মতাদর্শকে কিছুটা সংস্কার করে ইসলামের মধ্যে গ্রহণ করার চেষ্টা চালিয়ে ছিলেন। বর্তমানেও ওই মানসিকতার ইসলামী চিন্তাবিদরা মানব রচিত গণতন্ত্রকে ইসলামের মধ্যে আত্মীকরণ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। অর্থাৎ গণতন্ত্র দৃষ্টিকোণ থেকে হারাম হলেও, স্থান কাল অবস্থার আলোকে তকমা দিয়ে নিজেদের সুবিধার্থে হারামকে আরাম বানিয়ে ফেলছেন। বিশেষ করে ক্ষমতার ধারপ্রান্তে আরহণ করার স্বার্থে জায়েজ ফতোয়া দিয়ে দিচ্ছেন।
বিগত ও বর্তমান শতাব্দীতে প্রভাব বিস্তার করে থাকা বিজাতীয় রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক মতবাদ ‘গণতন্ত্র’ সম্পর্কে একশ্রেণির ইসলামী চিন্তাবিদ অনুরূপ ভাষ্য প্রদান করে গণতন্ত্রকে মুসলিম বিশ্বে গ্রহণযোগ্য করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। তারা বলছেন, শুধু সার্বভৌমত্বের প্রসঙ্গটি বাদ দিলে গণতন্ত্রকে ইসলামের মধ্যে গ্রহণে কোনো সমস্যা নেই।
গণতন্ত্র ও ইসলাম কেন পরস্পরবিরোধী- এ প্রবন্ধে আমরা তা তুলে ধরায় প্রয়াস পাব। গণমানুষের ইচ্ছা বা আইন অনুসারে পরিচালিত হয় বলেই এর রাষ্ট্র বা শাসনব্যবস্থাকে গণতন্ত্র বলা হয়। অন্যদিকে ইসলাম আল্লাহর মনোনীত জীবনব্যবস্থা। আল্লাহর খলীফা হিসাবে এবং তাঁর ইচ্ছানুসারে পরিচালিত হয় বলে ইসলামের শাসনব্যবস্থাকে খিলাফত বলা হয়। পক্ষান্তরে ‘খেলাফত’ আল্লাহর অনুমোদিত শাসনব্যবস্থার নাম’। নিম্নে ইসলাম ও গণতন্ত্রের পারস্পরিক সংঘর্ষের দিকগুলো উল্লেখ করা হলো।
গণতন্ত্রে জনগণের সার্বভৌমত্ব মানা হয়। পক্ষান্তরে ইসলামের খিলাফতি রাষ্ট্রে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব মানা হয়, যা তাওহীদের অন্তর্ভুক্ত। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে রাষ্ট্র পরিচালনার অর্থ হলো- মানুষের প্রতিনিধি হিসাবে রাষ্ট্র পরিচালনা। পক্ষান্তরে খিলাফতের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা অর্থ হলো আল্লাহর প্রতিনিধি হিসাবে রাষ্ট্র পরিচালনা। গণতন্ত্রের মূল দর্শন হলো মানুষকে সন্তুষ্ট করা যেভাবেই হোক। পক্ষান্তরে ইসলামী খিলাফতের মূল উদ্দেশ্য হলো- আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ধর্ম নিছক একটি ব্যক্তিগত ব্যাপার। পক্ষান্তরে ইসলামী খিলাফতে ধর্ম শুধু ব্যক্তিগত জীবনে নয় মানুষের সার্বিক জীবনে ধর্মের বিধি-বিধান বাস্তবায়ন করে। রাষ্ট্রের সার্বিক ব্যবস্থাপনা ধর্মের নীতিমালা অনুসরণ করে চলে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণ যেহেতু সকল ক্ষমতার মালিক। এতে সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে যেকোন ব্যক্তি যেমন রাষ্ট্র প্রধান হতে পারে, তেমনি ইচ্ছামতো যেকোনো আইন রচনা করতে পারে। এজন্য ‘Majority must be granted’ হলো- গণতন্ত্রের চূড়ান্ত কথা। পক্ষান্তরে ইসলামী রাষ্ট্রে আল্লাহকেই যেহেতু সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক মানা হয়। কেননা, আল্লাহ অধিকাংশের মতানুসরণকে নিরুৎসাহিত করেছেন’ (আন‘আম ১১৬)।
গণতন্ত্রে রাজনীতি চলে বহুদলীয় পদ্ধতিতে। একদল সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে নির্বাচিত হয়ে রাষ্ট্র বা সরকার পরিচালনা করে। ভোটে পরাজিত দল বা দলগুলো বিরোধীদলে থেকে সরকারের সমালোচনা করে। পক্ষান্তরে ইসলামী রাষ্ট্রে রাষ্ট্র বা সরকার ব্যবস্থায় বহুদলীয় ব্যবস্থাপনা স্বীকৃত নয়। ইসলামী রাষ্ট্রের খলীফা উম্মাহর দায়িত্বশীল বা খাদেম হিসাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। তিনি বিশেষ কোনো দলের লোক হন না। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্র প্রধান বা শাসক একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকেন। মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে সার্বিক যোগ্যতা ও সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তাকে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হয়। পক্ষান্তরে ইসলামী খিলাফতে রাষ্ট্রপ্রধান যতদিন যোগ্যতা ও সক্ষমতার সঙ্গে শাসনকার্য পরিচালনা করতে পারবেন, ততদিন ওই দায়িত্বে বহাল থাকবেন। গণতন্ত্রে নেতাকে পদপ্রার্থী হতে হয়। অপরপক্ষে ইসলামে কেউ নেতৃত্ব বা পদ চাইলেই তিনি নেতৃত্ব দানের অযোগ্য বিবেচিত হন, তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় না। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের শূরা বা পরামর্শ পদ্ধতি এবং ইসলামী রাষ্ট্রের শূরা বা পরামর্শ পদ্ধতি এক রকম নয়। অথচ এই শূরা ব্যবস্থাকেই গণতন্ত্রের সঙ্গে ইসলামের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার সাদৃশ্য প্রমাণের জন্য সবচেয়ে বেশি যুক্তি উপস্থাপন করা হয়।
গণতন্ত্রের মূলনীতিগুলো সুস্পষ্টভাবে ইসলামবিরোধী হিসাবে প্রতীয়মান হয়। যেমন : গণতন্ত্রের মূল কথা জনগণের সার্বভৌমত্ব। অর্থাৎ সব ক্ষমতার মালিক সব ক্ষমতার উৎস জনগণ। একথা নিঃসন্দেহে আল্লাহবিরোধী।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কথা সাহিত্যিক এবং প্রেসিডেন্ট আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী
সংগঠন ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল এন্টি অ্যালকোহল।