ঢাকা শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ভূমিকম্প মোকাবিলায় সচেতনতাই প্রয়োজন

আফতাব চৌধুরী
ভূমিকম্প মোকাবিলায় সচেতনতাই প্রয়োজন

দুর্যোগ হলো এমন একটি বিপর্যয়কর ঘটনা বা পরিস্থিতি, যা মানুষের স্বাভাবিক জীবনধারাকে শুধু ব্যাহত করে না- পারিপার্শ্বিকতাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে, যা মোকাবিলা করা ওই ক্ষতিগ্রস্ত সমাজের পক্ষে কষ্টকর এবং ক্ষেত্র বিশেষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। দুর্যোগ সাধারণত দু’প্রকার। যথা- প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মনুষ্য সৃষ্ট দুর্যোগ। ভূমিকম্প একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। সাধারণত কঠিন ভূ-ত্বকের আকস্মাৎ কেঁপে ওঠাকে বলা হয় ভূমিকম্প। প্রাকৃতিক কারণবশত ভূ-আলোড়নের ফলে ভূ-পৃষ্ঠের কোন কোন অংশে আকস্মিক কম্পনের সৃষ্টি হলে তাকে ভূমিকম্প বলা হয়। ভূ-অভ্যন্তরস্থ শিলারাজির স্থিতিস্থাপক ভারসাম্যে তারতম্য ঘটলে ভূ-ত্বকের বিচ্যুতির মাধ্যমে নিঃসরিত স্থিতি বিনষ্টকারী শক্তিদ্বারা এ কম্পনের উৎপত্তি হয়। টেকটোনিক থিওরী অনুযায়ী ভূ-পৃষ্ঠ নির্দিষ্ট সংখ্যক অভ্যন্তরীণভাবে দৃঢ় ও শক্ত প্লেট দ্বারা বিভক্ত। একটি প্লেটের সঙ্গে আরেকটি প্লেটের সংঘর্ষই ভূমিকম্পের মূল কারণ। ভূ-কম্পন কেন্দ্র সাধারণত ভূত্বকের ৬-৩৬ কিমি. গভীরতার মধ্যে অবস্থান করে। ভূমিকম্পের পন্দন কেন্দ্র থেকে তরঙ্গের ন্যায় চারদিকে প্রসারিত হয়। সিসমোগ্রাফ বা ভূ-কম্পন লিখন যন্ত্রের সাহায্যে এরূপ তরঙ্গের প্রকৃতি সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায়। কয়েকটি প্রধান কারণে ভূমিকম্প হয়ে থাকে। যথা- ক) কোন কারণে পৃথিবীর অভ্যন্তরে শিলাচ্যুতি ঘটলে তাপ বিকিরণের ফলে ভূগর্ভে সংকুচিত হয়ে ভূত্বকে ভাঁজের সৃষ্টি হলে। খ) ভূগর্ভে হঠাৎ চাপহ্রাস পেয়ে পৃথিবীর মধ্যকার পদার্থ কঠিন অবস্থা হতে তরল অবস্থায় পরিণত হয় এবং আগ্নেয়গিরির অগ্যুৎপাতের সময় লাভা বের হওয়ার ফলে ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়ে থাকে। গ) প্লেট মুভমেন্টের কারণে ভূমিকম্প হয়ে থাকে। ভূত্বক প্রধাণত কতগুলো প্লেট দ্বারা নির্মিত। এসব প্লেটের ভূতাত্বিক নাম পলি টেকটোনিক প্লেট। এছাড়াও রয়েছে অসংখ্য সাব প্লেট। এগুলো সব সময় সঞ্চারণশীল। প্লেটগুলো চলতে চলতে কখনও যদি একটি অন্যটিকে অতিক্রম করে ফেলে কিংবা একটি অন্যটির গায়ে চড়ে বসে তখনি ভূমিকম্প হয়। ভূমিকম্পের ফলে বাড়িঘর, দালানকোঠা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়, গাছপালা উপড়ে পড়ে, নদীর পাড় ভেঙে পড়ে, জীবন ও সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি।

ভূমিকম্পের মাত্রা : ভূ-কম্পন এবং এর তীব্রতা নিরূপণের জন্য সাধারণত সিসমোগ্রাফ এবং রিখটার স্কেল ব্যবহৃত হয়। সিসমোগ্রাফের সাহায্যে ভূত্বকের অনুলিপি প্রস্তুত করা সম্ভব এবং ভূ-কম্পের মাত্রা নিরূপণ করা যায়। ভূমিকম্পের মাত্রা দুভাবে নির্ধারণ করা হয়। একটি হচ্ছে তীব্রতা এবং অন্যটি হচ্ছে প্রচণ্ডতা। তীব্রতা ভূ-কম্পন লিখনযন্ত্র দ্বারা পরিমাপ করা হয় এবং রিখটার স্কেলে সংখ্যায় তা প্রকাশ করা হয়। রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের মাত্রা ৫-এর বেশি হলেই বিপদের সম্ভাবনা থাকে। ভূ-কম্পন বিশারদগণ ৭-৭.৯ রিখটার স্কেলের ভূমিকম্পকে ভয়াবহ এবং ৮ বা ততোধিক রিখটার স্কেলের ভূমিকম্পকে অত্যন্ত ভয়াবহ বা প্রবল বলে অভিহিত করে থাকেন। রিখটার স্কেলের মাত্রানুসারে ভূমিকম্পের নাম: (১) অত্যন্ত ভয়াবহ বা প্রবল-৮ বা তার চেয়ে বেশি (২) ভয়াবহ-৭ থেকে ৭.৯ (৩) শক্তিশালী-৬ থেকে ৬.৯ (৪) মধ্যমণ্ড৫ থেকে ৫.৯ (৫) হালকাণ্ড৪ থেকে ৪.৯ (৬) মৃদু-৩ থেকে ৩.৯ (৭) খুবই মৃদু-৩ এর কম।

ভূমিকম্পের প্রবণতা : ইতিহাস পর্যালোচনা থেকে দেখা যায় যে, নির্দিষ্ট সময় অর্থাৎ ১০০ বছর পর পর একই স্থানে আবার ভূমিকম্প হয়। ১৮৯৭ সালে বাংলাদেশে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছিল। সে হিসাবে আরেকটি বড় ধরনের ভূমিকম্পের সময় হয়ে গেছে বলে ধরে নেওয়া যায়। ১৯৯৭ সালে চট্টগ্রামে, ১৯৯৮ সালে কুতুবদিয়ায়, ১৯৯৯ সালে মহেশখালীতে এবং ২০০১ সালের ১৯ ডিসেম্বর ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় সংঘটিত ভূমিকম্প একটি বড় ধরনের ভূমিকম্পেরই পূর্বাভাস। বাংলাদেশের উত্তর, উত্তর-পূর্ব ও মধ্যাঞ্চলের দুই-তৃতীয়াংশ এলাকা ভূমিকম্পের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।

বেঙ্গল বেসিনের অধিকাংশ এলাকাজুড়ে বাংলাদেশের অবস্থান। ভূমিকম্পপ্রবণতার বিবেচনায় ভূ-তত্ত্ববিদরা বাংলাদেশকে নিম্নবর্ণিত তিনটি অঞ্চলে বা বলয়ে বিভক্ত করেছেন: (ক) অধিক ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল বা বলয়: বৃহত্তর সিলেট, ময়মনসিংহ এবং রংপুর শহরসহ দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল এ অঞ্চল বা বলয়ে অন্তর্ভুক্ত (খ) ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল বা বলয়: বৃহত্তর দিনাজপুর, বগুড়া, টাঙ্গাইল, ঢাকা, কুমিল্লা এবং চট্টগ্রাম এ অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত (গ) কম ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল বা বলয়: বৃহত্তর রাজশাহী, পাবনা, কুষ্টিয়া, যশোর, ফরিদপুর, খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী এবং নোয়াখালী এ অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত।

ভূমিকম্পের পূর্বাভাস : এখন পর্যন্ত বৈজ্ঞানিকভাবে ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে প্রকৃতির কিছু অস্বাভাবিক আচরণ থেকে কিছু কিছু অঞ্চলে বা কোন কোন দেশে ভূমিকম্পের কিছুটা পূর্বাভাস অনুমান করা যায়। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে : (ক) ভূমিকম্পের আগে সাপ, ইঁদুর গর্ত থেকে বের হয়ে আসে। কারণ ইঁদুর তার গর্তে যাওয়া-আসার যে পথ তা ছোট হয়ে আসাটা টের পায় (খ) মুরগির ডিমপাড়া বন্ধ হয়ে যায়। কারণ মাইক্রোওয়েভের কম্পনের কারণে সুরসুরি অনুভব করে (গ) অ্যাকুরিয়ামের মাছ লাফ-ঝাঁপ শুরু করে (ঘ) কুকুর কিংবা গরু ইত্যাদি ডাকাডাকি ও লাফালাফি শুরু করে।

ভূমিকম্পে সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি : ভূমিকম্প একটা মারাত্মক বিধ্বংসী প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি এর তীব্রতা ও প্রচণ্ডতার ওপর নির্ভরশীল। একটি বিপর্যয়কর ভূমিকম্পে সাধারণত যে ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকে তা হল : ক্লিনিক-হাসপাতাল-ভবনাদি ধসে ও ভেঙে পড়ে এবং অগ্নিকাণ্ড ঘটে, বিধক্ষস্ত হয়ে পড়া ভবনাদির নিচে মানুষ ও গবাদিপশু আটকা পড়ে, গ্যাস লাইন ফেটে যায়, বিদ্যুৎ বিপর্যয় ঘটে, পানি ও পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থা ধ্বংস হয়, স্বাস্থ্যব্যবস্থায় বিপর্যয় ঘটে ও বহুবিধভাবে মানুষের মৃত্যু ঘটে, রাসায়নিক দ্রব্যাদি নির্গত হয়ে বিফোরণ ঘটে, রাস্তা-ঘাট, সেতু-কালভার্ট ধ্বংস হয়ে জরুরি যানবাহন চলাচলের প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয় এবং যোগাযোগব্যবস্থায় বিপর্যয় ঘটে, নদী বা সমুদ্র উপকূলে জলোচ্ছ্বাস হয়।

ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়ার আগে করণীয় : পরিবারের সদস্যদের ভূমিকম্প সম্পর্কে ধারণাদান ও সচেতন করা, অগ্নিনির্বাপণ, উদ্ধার এবং প্রাথমিক চিকিৎসা সম্পর্কে প্রশিক্ষণ প্রদান, প্রাথমিক চিকিৎসা বক্স প্রস্তুত রাখা, ব্যাটারিচালিত টর্চলাইট ও রেডিও রাখা, ভূমিকম্পকালীন সময়ে ভবন হতে জরুরিভিত্তিতে বের হওয়ার পথ, বিকল্প পথ আগেই জেনে নেওয়া, ব্লাড ডোনার ফোরাম গঠন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষিকা, মসজিদের ইমাম, ধর্মীয় নেতা প্রমুখদের ভূমিকম্প প্রস্তুতি ও ক্ষয়ক্ষতি প্রশমন বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান এবং সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ, সকল অত্যাবশ্যকীয় টেলিফোন ও মোবাইল নম্বর সংরক্ষণ ও হালনাগাদকরণ, জারিগান, পথনাটক ও মহড়া ইত্যাদির মাধ্যমে গণসচেতনতা বৃদ্ধি করা, ভূমিকম্প প্রস্তুতি ও প্রশাসনমূলক পোস্টার ও লিফলেট মুদ্রণ এবং সর্বস্তরের জনগণের মধ্যে বিতরণ, ঘরবাড়ি শক্ত করে তৈরি করা, ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড মেনে চলা প্রভৃতি।

ভূমিকম্প চলাকালীন সময়ে করণীয় : শান্ত থাকুন, লোভ সংবরণ করুন, মাথায় হেলমেট পরে নিন, ঘর বা বিল্ডিংয়ের ভেতর থাকলে শক্ত পিলারের পাশে অবস্থান নিন, সম্ভব হলে খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিন, লিফট ব্যবহার না করা, পানিতে থাকলে দ্রুত উপরে ওঠে আসা, বৈদ্যুতিক তার, খুঁটি ও সুউচ্চ ভবন থেকে যত সম্ভব দূরে থাকুন, চলন্ত কোনো গাড়িতে থাকলে গাড়ি থামিয়ে ভেতরেই অবস্থান করুন।

ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়ার পর অত্যাবশ্যকীয় কার্যক্রমগুলো : অনুসন্ধান, আটকে পড়া লোকদের স্থান চিহ্নিতকরণ ও উদ্ধার, অগ্নিনির্বাপণ, লোকজনকে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তরকরণ, আহতদের সংখ্যা ও ধরন নির্ধারণ এবং মৃতদের শনাক্তকরণ ও অপসারণ, প্রবেশপথ ও নির্গমন পথ পরিষ্কারকরণ, যোগাযোগব্যবস্থা পুনরুদ্ধার, নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ, বৈদ্যুতিক লাইনগুলো সাময়িকভাবে বিচ্ছিন্নকরণ এবং পুনঃস্থাপন, ক্ষয়ক্ষতি জরিপ সম্পাদন ও জরুরি ত্রাণ বিতরণ, রোগ নিয়ন্ত্রণ, জীব-জন্তুর মৃতদেহ অপসারণ ও পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ, ধ্বংসস্তূপ ও আবর্জনা পরিষ্কারকরণ, তথ্যাদি যথাস্থানে প্রেরণ এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে দ্রুত যোগাযোগ স্থাপন।

ভূমিকম্প ব্যবস্থাপনা : ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি হ্রাস সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা বা প্রস্তুতির বিকল্প নেই। ভূমিকম্প কখন হবে তা নিশ্চিতভাবে কেউ বলে দিতে পারে না। বিজ্ঞানীগণ ও এ যাবৎ এর পূর্বাভাস জানার ক্ষেত্রে কোনো নির্ভরযোগ্য প্রযুক্তি আবিস্কার করতে পারেনি। তাই এ ক্ষেত্রে আমাদের করণীয় হচ্ছে ভূমিকম্প ব্যবস্থাপনা ও পূর্ব প্রস্তুতিকে জোরদার করা। ভূমিকম্প পরবর্তী দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রয়োজন আগাম পরিকল্পনা, সচেতনতা ও প্রস্তুতি গ্রহণ। আসুন ভূমিকম্প সম্পর্কে আমরা সকলে সচেতন হই এবং যথাযথভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করি।

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট সদস্য-জেলা দুর্যোগব্যবস্থাপনা কমিটি, সিলেট

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত