প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
গণতন্ত্র আধুনিক রাষ্ট্রের একটি অটল স্তম্ভ, যা শুধু রাজনৈতিক কাঠামো নয়, বরং সামাজিক, নৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়ার সমষ্টি। এটি রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রতিটি স্তরে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে এবং নৈতিক দায়বদ্ধতার মাধ্যমে শাসনব্যবস্থাকে স্বচ্ছ ও কার্যকর রাখে। গণতন্ত্রের সার্থকতানির্ভর করে কাঠামোগত নিয়ম, নাগরিক সচেতনতা, রাজনৈতিক নেতৃত্বের নৈতিক দায়বদ্ধতা এবং প্রশাসনিক স্বচ্ছতার উপর।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, গণতন্ত্রের ইতিহাস বহুস্তরীয় ও জটিল। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর সংবিধানে গণতন্ত্রের মূলনীতি অন্তর্ভুক্ত করা হলেও, সামরিক হস্তক্ষেপ, একদলীয় শাসন, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং দলীয় রাজনীতির স্বার্থপর প্রয়োগ প্রায়শই গণতন্ত্রকে ব্যাহত করেছে। তবে, জনগণের সচেতন অংশগ্রহণ এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতির ধীর প্রগতি কিছুটা হলেও গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রেখেছে।
গণতন্ত্রের প্রকৃত শক্তি শুধু ভোট বা নির্বাচনে সীমাবদ্ধ নয়; এটি একটি চলমান সামাজিক চেতনা, যেখানে জনগণ সরকারের কার্যক্রম পর্যালোচনা করে, সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণ করে এবং নেতাদের প্রতি জবাবদিহি নিশ্চিত করে। নির্বাচন একটি প্রধান উপাদান, যা জনগণের মতামত নীতিনির্ধারণে অন্তর্ভুক্ত করে। তবে নির্বাচন কেবল আনুষ্ঠানিকতা নয়; এর কার্যকারিতানির্ভর করে ভোটের স্বচ্ছতা, অংশগ্রহণের সুযোগ, রাজনৈতিক চাপ এবং সংবিধানিক নৈতিকতার ওপর। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নির্বাচনি প্রক্রিয়া প্রায়শই বিতর্কিত হলেও, জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ গণতন্ত্রকে একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় টিকিয়ে রেখেছে।
গণতন্ত্রের তাত্ত্বিকভিত্তি অনুযায়ী, এটি শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতার বিতরণ নয়; এটি জনগণের নৈতিক এবং সামাজিক ক্ষমতায়নের প্রক্রিয়া। ক্লাসিক্যাল তত্ত্ববিদরা এটিকে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং জবাবদিহির মাধ্যমে রাষ্ট্রের কার্যকারিতা নিশ্চিত করার প্রক্রিয়া হিসেবে দেখেছেন। আধুনিক তত্ত্বে আরও জোর দেওয়া হয়েছে নাগরিক স্বাধীনতা, মানবাধিকারের সুরক্ষা এবং ক্ষমতার ভারসাম্যের গুরুত্বে। একটি কার্যকর গণতন্ত্রে নির্বাহী, আইনসভা এবং বিচারব্যবস্থার মধ্যে ভারসাম্য থাকা অপরিহার্য। এছাড়া রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বচ্ছতা, জনগণের প্রতি জবাবদিহি এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে হয়।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। দলীয় রাজনৈতিক বিরোধ, ক্ষমতার কেন্দ্রিক ব্যবহার, রাজনৈতিক সহিষ্ণুতার অভাব এবং সংলাপের সীমিত প্রচেষ্টা দেশীয় গণতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতি, প্রশাসনিক জটিলতা এবং নাগরিক সচেতনতার অভাব নির্বাচন ও নীতি নির্ধারণকে প্রভাবিত করেছে। ক্ষমতার স্বার্থপর ব্যবহার রাজনৈতিক সংস্কৃতির দুর্বলতা তৈরি করেছে, যার ফলে জনগণ প্রায়শই রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার প্রতি অবিশ্বাসী হয়ে পড়ছে।
গণতন্ত্রের কার্যকর বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন সুসংহত কাঠামো। শক্তি বিভাজন, স্বচ্ছ প্রশাসন, রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা, নাগরিক সচেতনতা এবং নির্বাচনি সংস্কার- এই সব উপাদান একত্রিত হলে গণতন্ত্র কার্যকর হয়। শক্তি বিভাজনের মাধ্যমে নির্বাহী, আইনসভা এবং বিচারব্যবস্থার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা সম্ভব, যা নৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণকে নিশ্চিত করে। স্বচ্ছ প্রশাসন সরকারের প্রতিটি স্তরে জনগণের নজরদারি এবং অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে, যা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং দমন-নিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
নির্বাচনী সংস্কার গণতন্ত্রের অন্যতম ভিত্তি। ভোটের স্বচ্ছতা, অংশগ্রহণের সুযোগ বৃদ্ধি এবং নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে। কার্যকর নির্বাচন কমিশন এবং সুষ্ঠু ভোটিং প্রক্রিয়া নিশ্চিত করলে জনগণ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে উৎসাহিত হয়। পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতৃত্বের নৈতিকতা অপরিহার্য। নৈতিক ও দায়িত্বশীল নেতৃত্ব জনগণকে ক্ষমতায়ন করে, সামাজিক ঐক্য বজায় রাখে এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে।
দলীয় রাজনীতিতে সংলাপ এবং সহমতের অভাব গণতন্ত্রের বড় চ্যালেঞ্জ। রাজনৈতিক বিরোধ এবং ক্ষমতার দ্বন্দ্ব জনসাধারণের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে, যা সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণও হয়ে ওঠে। সংলাপ এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার মাধ্যমে দলগুলো জাতীয় স্বার্থে একত্রিত হলে, গণতন্ত্রের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়। রাজনৈতিক সংস্কৃতির উন্নয়ন ঘটাতে হলে পার্টির স্বার্থের চেয়ে জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং সহমত ও সংলাপকে প্রাধান্য দিতে হবে।
শিক্ষা ও সচেতন নাগরিক সমাজ গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে। শিক্ষিত জনগণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের মূল্যায়ন করতে পারে, নেতাদের নৈতিক দায়িত্ব নিশ্চিত করতে পারে এবং সমাজে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়তা করে। নাগরিকদের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ, ভোটে সক্রিয়তা এবং নেতৃত্বের প্রতি জবাবদিহি নিশ্চিত করা গেলে, গণতন্ত্র কার্যকর হয় এবং সমাজে সমতার চেতনা বৃদ্ধি পায়।
গণতন্ত্রের অপরিহার্যতা শুধু রাজনৈতিক কাঠামোয় সীমাবদ্ধ নয়; এটি সামাজিক ন্যায়, মানবাধিকার এবং সাম্যের প্রতিফলন। সংখ্যালঘুদের অধিকার সুরক্ষা, নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, শ্রমিক ও কৃষকের স্বার্থ সংরক্ষণ- এই সব দিক গণতন্ত্রকে প্রকৃত অর্থে শক্তিশালী করে। গণতান্ত্রিক নীতি বাস্তবায়ন করা গেলে, শুধু রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নয়, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক সম্প্রীতি এবং সাংস্কৃতিক সংহতিও নিশ্চিত হয়।
অন্তর্নিহিত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা এবং অন্যান্য সংস্থা দেশের রাজনৈতিক সংস্কার, মানবাধিকার রক্ষা এবং আইনের শাসন নিশ্চিত করতে সহায়তা করে। তবে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সদিচ্ছা, নাগরিক সচেতনতা এবং প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ছাড়া আন্তর্জাতিক চাপ একা যথেষ্ট নয়। বাংলাদেশের উদাহরণে দেখা যায় অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংস্কার এবং নাগরিক অংশগ্রহণ ছাড়া গণতন্ত্রের কার্যকারিতা সীমিত থাকে।
গণতন্ত্রের স্থিতিশীলতা জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ, নেতৃত্বের নৈতিক দায়বদ্ধতা এবং প্রশাসনিক স্বচ্ছতার মাধ্যমে নিশ্চিত হয়। এটি শুধু একটি কাঠামোগত প্রক্রিয়া নয়; বরং একটি সামাজিক সংস্কৃতি, যা রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা, সরকারের কার্যকারিতা এবং জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করে। নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধি, নেতৃত্বের দায়বদ্ধতা এবং প্রশাসনিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করলে গণতন্ত্রের কার্যকারিতা শক্তিশালী হবে এবং দেশের রাজনীতি হবে স্থিতিশীল, স্বচ্ছ এবং জনগণের কল্যাণমুখী।
অতএব, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী ও টেকসই করতে হলে নাগরিক অংশগ্রহণ, রাজনৈতিক নেতৃত্বের নৈতিক দায়বদ্ধতা এবং প্রশাসনিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক। রাষ্ট্রীয় কাঠামোর পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা, শিক্ষার প্রসার এবং মানবাধিকার রক্ষা গণতন্ত্রের মূলভিত্তি হিসেবে কাজ করবে, যা দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য।
লেখক : কলামিস্ট, আমদিরপাড়া, জুমারবাড়ী, সাঘাটা, গাইবান্ধা