প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসকে যদি আমরা একটি জটিল নাট্যমঞ্চ ভাবি, তাহলে সেখানে জাতীয় পার্টির অবস্থান নিঃসন্দেহে রহস্যময় ও বৈপরীত্যপূর্ণ। একদিকে দলটির জন্ম হয়েছে সরাসরি সামরিক অভ্যুত্থান ও স্বৈরাচারী ক্ষমতার বৈধতা রক্ষার হাতিয়ার হিসেবে, অন্যদিকে দীর্ঘ তিন দশক ধরে তারা জাতীয় সংসদের অপরিহার্য অংশে পরিণত হয়েছে। এখন প্রশ্ন উঠেছে- এই দল যদি রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ হয়, তাহলে প্রকৃতপক্ষে ক্ষতি হবে কার? লাভবান হবে কারা? আর বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় এর দীর্ঘমেয়াদি প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে?
জাতীয় পার্টির জন্মগত ইতিহাসই আসলে এর স্থায়ী বৈধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে রেখেছে। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সামরিক শক্তির জোরে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। এরপর নিজের ক্ষমতাকে স্থায়ী ও সাংবিধানিক বৈধতা দেওয়ার উদ্দেশ্যে ১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। এ দলটি কোনো গণআন্দোলনের দাবির ফসল নয়, কোনো আদর্শিক লড়াইয়ের উত্তরাধিকার নয়, বরং একক সামরিক স্বপ্নপূরণের রাজনৈতিক আচ্ছাদন মাত্র। এই জন্মপর্ব থেকেই দলের উপর অবৈধতার দাগ লেগে আছে।
কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হলো- এই দাগ থাকা সত্ত্বেও জাতীয় পার্টি রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে কখনও হারিয়ে যায়নি। ১৯৯১ সালের প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনে তারা ৩৫টি আসন পেয়ে প্রমাণ করেছিল, জনগণের ভোট ব্যাংকে তাদের একটি দৃশ্যমান অবস্থান আছে। এরপর প্রায় প্রতিটি নির্বাচনে তারা কোনো না কোনোভাবে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিয়েছে। কখনও শাসকদলের সঙ্গে মিত্র হয়ে, কখনও বিরোধীদলে থেকে, আবার কখনও একই সঙ্গে সরকার ও বিরোধী উভয় ভূমিকায় অভিনয় করে। এ কারণেই অনেক বিশ্লেষক জাতীয় পার্টিকে ‘রাজনৈতিক কুশীলব’ বা ‘রাজনৈতিক ভাড়াটে বাহিনী’ হিসেবে অভিহিত করেন।
এখন দেখা যাক, জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করার নৈতিক যুক্তি কতটা শক্তিশালী। দলটি বারবার এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছে, যেখানে তারা শাসক দলের অবৈধতাকে বৈধতা দিয়েছে। ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনে তারা অংশগ্রহণ করে আওয়ামী লীগকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বৈধতা দেয়। ২০১৮ সালের নির্বাচনে একই কৌশল দেখা গেছে- প্রহসনের নির্বাচনকে প্রতিযোগিতামূলক দেখানোর জন্য জাতীয় পার্টির প্রহসনমূলক ভূমিকা ছিল। ২০২৪ সালেও একই চিত্র পুনরাবৃত্তি হয়েছে। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে- এমন একটি দল যদি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার পরিপন্থি কাজ করে, তাহলে কি তাদের রাজনৈতিকভাবে নিষিদ্ধ করা উচিত নয়? নৈতিক যুক্তি একদিকে শক্তিশালী হলেও বাস্তবতা অন্যদিকে অত্যন্ত জটিল।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে জাতীয় পার্টি শুধু একটি দল নয়; বরং দুই প্রধান শক্তি- আওয়ামী লীগ ও বিএনপির জন্য একটি ভারসাম্যের উপাদান। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনে জাতীয় পার্টির সমর্থন নিয়েছিল। ২০০৮ সালেও আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির মধ্যে সমঝোতা দেখা গেছে। অন্যদিকে, বিএনপিও পরোক্ষভাবে জাতীয় পার্টির অস্তিত্ব থেকে উপকৃত হয়েছে। কারণ বিএনপি যখন আন্দোলনে ব্যর্থ হয়েছে বা নির্বাচনে বর্জন করেছে, তখন জাতীয় পার্টির অংশগ্রহণ সরকারকে ‘ন্যূনতম বৈধতা’ দিয়েছে। ফলে আওয়ামী লীগকে সরাসরি দায়ী করা গেলেও, বিএনপিও এই রাজনৈতিক বাস্তবতার সুবিধাভোগী ছিল।
এখন যদি দলটি নিষিদ্ধ হয়, তাহলে কারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে? প্রথমত, বিএনপি কৌশলগতভাবে বিপাকে পড়বে। তাদের আন্দোলনের ব্যর্থতা বা নির্বাচনি বর্জনের সময় জাতীয় পার্টি সরকারের বৈধতার বোঝা বহন করত। জাতীয় পার্টি না থাকলে ভবিষ্যতে বিএনপিকে সরাসরি চাপ নিতে হবে, এবং সরকারও আরেকটি ‘সেফটি ভালভ’ হারাবে। দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জাতীয় পার্টি ছিল তাদের জন্য ‘কৃত্রিমবিরোধী দল’। সংসদে ভিন্ন স্বর রাখলেও শেষ পর্যন্ত তারা আওয়ামী লীগের পক্ষে কাজ করেছে। দলটি নিষিদ্ধ হলে আওয়ামী লীগকে প্রকৃত বিরোধী দলের মুখোমুখি হতে হবে। এতে তাদের স্বাচ্ছন্দ্যের রাজনীতি ভেঙে পড়বে। তৃতীয়ত, জাতীয় পার্টির কর্মীসমর্থক ও সাংগঠনিক কাঠামো ছত্রভঙ্গ হয়ে যাবে। এই বিশাল সংগঠনের একটি অংশ হয়তো বিএনপির দিকে ঝুঁকবে, আরেক অংশ আওয়ামী লীগের ছায়ায় আশ্রয় নেবে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে দলীয় ভিত্তি দুর্বল হয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে একধরনের শূন্যতা তৈরি হবে।
চতুর্থত, নতুন শক্তি যেমন জামায়াতে ইসলামী বা নতুন উদীয়মান নাগরিক প্ল্যাটফর্মগুলো এই শূন্যতা পূরণের সুযোগ পাবে। এরা দাবি তুলবে যে, জাতীয় পার্টির জায়গা তারা নিতে সক্ষম। এর ফলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আদর্শিক মেরুকরণ আরও বাড়তে পারে।
এখন যদি জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধ করা হয়, তবে রাষ্ট্রীয় পরিণতি কী হবে? প্রথমত, রাজনৈতিক বহুত্ববাদ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যদিও জাতীয় পার্টি কার্যত শাসকগোষ্ঠীর দোসর হিসেবে কাজ করেছে, তবুও সাংবিধানিকভাবে একটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব বিলোপ গণতন্ত্রের জন্য ইতিবাচক দৃষ্টান্ত নয়। দ্বিতীয়ত, এটি ভবিষ্যতে আরেকটি বিপজ্জনক নজির তৈরি করবে- কোনো দলকে রাজনৈতিক অপরাধের দায়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে বাতিল করা হলে একসময় এই নজির বিরোধীদের ক্ষেত্রেও ব্যবহার হতে পারে।
তাহলে আবার মূল প্রশ্নে ফিরে আসা যাক- জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধ হলে আসল ক্ষতি কার? বাস্তবতা হলো, সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে আওয়ামী লীগের। কারণ তারা আর সংসদে একধরনের ‘কৃত্রিম বিরোধিতা’র আবরণে রাজনীতি চালাতে পারবে না। বিএনপিও এক অর্থে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, কারণ তাদের কৌশলগত সুবিধা হারিয়ে যাবে। তবে দীর্ঘমেয়াদে জাতীয় পার্টির নিষিদ্ধকরণ সবচেয়ে বড় ক্ষতি করবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে। এতে বহুত্ববাদী রাজনীতির পরিসর সংকুচিত হবে, আর আদর্শিকভাবে দুর্বল হলেও একটি শক্তিশালী সাংগঠনিক প্ল্যাটফর্ম হারিয়ে যাবে।
জাতীয় পার্টি আসলেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একধরনের বৈপরীত্য। তাদের জন্ম যেমন বিতর্কিত, টিকে থাকার কৌশলও তেমনি আপসকামী। তবুও তারা তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে রাজনীতির কেন্দ্রস্থলে অবস্থান করেছে। এই দলকে হঠাৎ করে নিষিদ্ধ করে দেওয়া মানে হবে ইতিহাসের একটি অস্বস্তিকর অধ্যায়কে জোর করে মুছে ফেলা। কিন্তু ইতিহাস কখনোই মুছে যায় না; বরং তা অন্য কোনো রূপে ফিরে আসে।
অতএব, জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধ হলে সাময়িকভাবে হয়তো কিছু দল উপকৃত হবে; কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতি হবে পুরো রাজনৈতিক ব্যবস্থার। কারণ জাতীয় পার্টি যতটা না শক্তিশালী দল, তার চেয়ে অনেক বেশি হলো একধরনের ভারসাম্য রক্ষাকারী শক্তি। এই ভারসাম্য ভেঙে গেলে বাংলাদেশের রাজনীতি আরও অস্থিতিশীল, আরও দ্বন্দ্বমুখর হয়ে উঠবে।
লেখক : কলামিস্ট, রংপুর