ঢাকা শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ব্রেইন ড্রেইনের ফাঁদ থেকে কবে মুক্তি মিলবে

হুমায়ুন আহমেদ নাইম
ব্রেইন ড্রেইনের ফাঁদ থেকে কবে মুক্তি মিলবে

বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো একটি দেশের প্রাণকেন্দ্র। এগুলো থেকেই বের হবে ভবিষ্যত দেশের কান্ডারি। যারা দেশকে নিয়ে যাবে অনন্য উচ্চতায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার অবস্থা ভঙ্গুর প্রকৃতির। যেন অল্প বাতাসেই তাসের ঘরের মতো ভেঙে যায়! বিশেষত, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের প্রতি জনগণের যে প্রত্যাশা তার কতটুকুই বা পূরণ করতে পারছে?

প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান সরকারের ব্যয়ে পরিচালিত হয়। পরোক্ষভাবে জনগণই সেই ব্যয়ের জোগানদার। কিন্তু মেডিকেল, বুয়েট, ঢাবিসহ সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য সরকার বাজেটের বড় অংশ খরচ করে। কিন্তু দেশের রাজনৈতিক এবং কর্মসংস্থানের অভাবের কারণে বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীর স্বপ্ন দেশত্যাগ করা।

কিন্তু শুধু দেশ ত্যাগ করাই কি একমাত্র সমাধান? দেশের প্রতি শিক্ষার্থীদের কোনো দায়িত্ব নেই? দেশের জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পড়াশোনা করে নিজস্ব ক্যারিয়ার গড়ে দেশকে কি দিচ্ছে? দেশর জনগণ কি প্রতিদান স্বরূপ কিছু পাচ্ছে? বুয়েট-মেডিকেলে পড়ে অনেকে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার না হয়ে ঝুঁকছেন বিসিএসের দিকে। ফলে চিকিৎসার জন্য সাধারণ জনগণ ভালো ডাক্তার না পেয়ে বঞ্চিত হচ্ছেন। দেশে কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হলে প্রয়োজন হচ্ছে বিদেশি ইঞ্জিনিয়ার। তাছাড়া, সাধারণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও বিদেশে গিয়ে উন্নত জীবনের প্রত্যাশায় তাদের মধ্যে ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশই আর ফিরে আসছেন না। অথচ এই কৃতি শিক্ষার্থীদের শিক্ষা সমাপনে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বিপুল অর্থ ব্যয় হচ্ছে। পরিস্থিতি এমন যে, গ্রাম ছেড়ে শহরে পড়তে আসা ছেলেটার আর গ্রামে ফেরা হয়নি উন্নত জীবন, ভালো ক্যারিয়ারের আশায়। ফলে গ্রামেরও আর কোনো উন্নয়ন হয় না। দেশীয় উন্নয়নে মেধার যথাযথ প্রয়োগ না হওয়ায় দেশের উন্নয়নের অগ্রগতিও হচ্ছে না। এর দায় এককভাবে কারোর না। এটা রাষ্ট্রের দায়, রাষ্ট্র শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের ভবিষ্যতের যোগসূত্র স্থাপন করতে পারেনি।

আমরা দেখি বিগত কয়েক দশক আগে দেশ খাদ্যে অস্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল, সে দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলো কিছু বিজ্ঞানীর কল্যাণে। সীমিত সুবিধা সত্ত্বেও বাংলাদেশের কৃষি বিজ্ঞানীরা প্রায় ৫০টির অধিক উচ্চ ফলনশীল ধান আবিষ্কার করেছেন এবং যে বাংলাদেশকে একদিন ‘তলাবিহীন ঝুঁড়ি’ বলে উপহাস করা হয়েছিল, সে বাংলাদেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। খাদ্য উৎপাদনে এই বিপুল সাফল্যের পেছনে একদিকে যেমন কৃষকের অবদান রয়েছে, তেমনি কৃষি বিজ্ঞানীদের অবদান গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু চিরদিন খাদ্য ঘাটতির দেশকে খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণতার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে আসা এই বিজ্ঞানীরাও অবহেলার শিকার। তারা তাহলে কোথায় যাবে?

ইউনেস্কোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে প্রায় ৫২,৮০০ শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য দেশ ছেড়েছে, যা ২০০৮ সালের তুলনায় প্রায় তিন গুণ বেশি। পাশাপাশি প্রতিবছর আনুমানিক ১০,০০০ দক্ষ পেশাজীবী স্থায়ীভাবে বিদেশে চলে যাচ্ছে। মেধা পাচারের ক্ষতি নির্ণয়নের জন্য বিজ্ঞানীরা হিউমান ফ্লাইট আন্ড ব্রেইন ড্রেইন ইন্ডেক্স নামের একটি ইনডেক্স নির্ণয় করেছে। ২০২৪ সালের হিসাব মতে হিউম্যান ফ্লাইট অ্যান্ড ব্রেইন ড্রেইন ইনডেক্স বাংলাদেশের স্কোর ৬.৭, যা বিশ্বব্যাপী গড় ৪.৯৮-এর থেকে অনেক বেশি এবং আমাদেরকে শীর্ষ ২০% মেধা পাচারকারী দেশের মধ্যে রেখেছে।

দেশে শিক্ষাব্যবস্থার ঘাটতি, চাকরির বাজারের সিলেবাসের সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক সিলেবাসের অমিল, দুর্নীতি এবং বিবদমান রাজনৈতিক সমস্যার জন্য কেউ আর দেশে ফিরে আসতে চায় না। এই ধরনের সমস্যাগুলোকে সমাধান করতে প্রয়োজন শিক্ষাব্যবস্থাকে আধুনিক ও আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে গড়ে তুলতে হবে। শুধু পথে ঘাটে বিশ্ববিদ্যালয় না করে গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত অর্থায়ন নিশ্চিত করতে হবে। চাকরির বাজারে সুষম ও স্থায়ী কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে হবে, যেখানে ন্যায্য বেতন ও ক্যারিয়ার উন্নয়নের সুযোগ থাকবে। নিয়োগে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি নির্মূল করতে হবে। তাছাড়া, যোগ্যতাভিত্তিক নিয়োগ সবার জন্য নিশ্চিত হয়। তরুণদের দেশের প্রতি আশা, আত্মবিশ্বাস ও মর্যাদা ফিরিয়ে দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের দেশে থেকেই স্বপ্নপূরণ করতে পারে- সে প্রত্যাশা পূরণে সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা প্রয়োজন। দেশীয় মেধা যখন সম্পূর্ণরূপে দেশে ব্যবহৃত হবে, তখনই সমৃদ্ধ হবে বাংলাদেশ।

লেখক : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ সদস্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ফিচার কলাম আ্যান্ড

কনটেন্ট রাইটার্স।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত