ঢাকা শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মাদকে দিশাহারা নতুন প্রজন্ম

সাকী মাহবুব
মাদকে দিশাহারা নতুন প্রজন্ম

আমাদের সমাজের নতুন প্রজন্ম আজ এক ভয়াবহ সংকটের মুখোমুখি। সেই সংকট হলো মাদকাসক্তি। মাদকের ছোবলে শুধু ব্যক্তিজীবনই নয়, ভেঙে যাচ্ছে পরিবার, নষ্ট হচ্ছে সামাজিক শৃঙ্খলা। এই নীরব মহামারি আমাদের তরুণ সমাজের প্রাণশক্তিকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে। আজকাল মাদক হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত সব জায়গায় এর সহজলভ্যতা লক্ষণীয়। ফেনসিডিল, ইয়াবা, হেরোইন, গাঁজা থেকে শুরু করে নানা ধরনের সিনথেটিক ড্রাগ খুব সহজেই পাওয়া যাচ্ছে। একসময় মাদকের ক্রেতা ছিল নির্দিষ্ট কিছু গোষ্ঠী; কিন্তু এখন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও এর প্রধান শিকার। পকেটমানির টাকা থেকে শুরু করে পারিবারিক সম্পদ বিক্রি করে তারা এই মরণ নেশার পেছনে ছুটছে। সামাজিক অবক্ষয় মাদকের এই বিস্তারকে আরও ত্বরান্বিত করছে।

যৌথ পরিবারের বন্ধন আলগা হয়ে যাচ্ছে, মা-বাবা উভয়েই ব্যস্ত কর্মজীবনে। ফলে সন্তানরা একাকিত্বে ভুগছে এবং ভুল সঙ্গ বেছে নিচ্ছে। বন্ধুদের সঙ্গে সিগারেট বা অ্যালকোহল দিয়ে শুরু হলেও, ধীরে ধীরে তারা কঠিন মাদকের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। হতাশা, ব্যর্থতা এবং মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পেতেও অনেকে মাদকের আশ্রয় নিচ্ছে।

মাদকাসক্তি শুধু একটি অভ্যাস নয়, এটি একটি রোগ। মাদকের কারণে শরীরে নানা ধরনের মারাত্মক রোগ বাসা বাঁধে। লিভারের ক্ষতি, কিডনি বিকল হওয়া, হার্ট অ্যাটাক এবং মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা কমে যাওয়ার মতো ঘটনা অহরহ ঘটছে। এর চেয়েও বড় ক্ষতি হচ্ছে মানসিক স্বাস্থ্যের। মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা হতাশা, উদ্বেগ এবং আগ্রাসী আচরণে ভুগতে থাকে, যা তাদের নিজেদের এবং সমাজের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। মাদকাসক্তির ফলে সমাজে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

মাদক কেনার টাকা জোগাড় করতে অনেকে চুরি, ছিনতাই, এমনকি খুন পর্যন্ত করছে। পারিবারিক সহিংসতা, বিচ্ছেদ এবং আর্থিক সংকট মাদকাসক্ত পরিবারের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। মাদকের অন্ধকার গহ্বরে পড়ে থাকা তরুণদের দেখে মনে হয়, তাদের সব স্বপ্ন, সম্ভাবনা ও সৃজনশীলতা হারিয়ে গেছে।এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। সবার আগে দরকার সচেতনতা।

স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মাদকের কুফল সম্পর্কে নিয়মিত সেমিনার ও ওয়ার্কশপের আয়োজন করা উচিত। পাঠ্যপুস্তকে মাদকের ক্ষতিকর দিকগুলো অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। পরিবারের ভূমিকা এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মা-বাবার উচিত সন্তানের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করা, তাদের কথা শোনা এবং তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া। সন্তানদেরকে সুস্থ বিনোদন ও গঠনমূলক কাজে উৎসাহিত করতে হবে। খেলাধুলা, শিল্পকলা এবং সামাজিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণের মাধ্যমে তারা নিজেদের প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে পারে।সরকারের উচিত মাদকবিরোধী অভিযান জোরদার করা এবং মাদক ব্যবসায়ীদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনা। একই সঙ্গে মাদকাসক্তদের চিকিৎসার জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা তৈরি করতে হবে।

মাদক নিরাময় কেন্দ্রগুলোর মান উন্নয়ন এবং মনোবিজ্ঞানীদের মাধ্যমে কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা করা জরুরি।মাদকাসক্তি একটি সামাজিক ব্যাধি। এটি প্রতিরোধে আমাদের সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। প্রতিটি পরিবারকে তার সন্তানের প্রতি যত্নশীল হতে হবে, প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে হবে এবং রাষ্ট্রকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। তাহলেই আমরা মাদকের এই মরণ ছোবল থেকে আমাদের নতুন প্রজন্মকে রক্ষা করতে পারব এবং একটি সুস্থ ও সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়তে পারব।

লেখক : সহকারী শিক্ষক, নাদির হোসেন উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়, কশবামাজাইল, রাজবাড়ী।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত