প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি আমাদের দেশ। মাতৃভূমির বুক চিড়ে বয়ে চলেছে ৯০৭টি নদী, ৩৭৩টি হাওড়। আমাদের রয়েছে পাহাড়ি অঞ্চল, ভাওয়ালের শালবন, সাফারি পার্ক, জলপ্রপাত, চা বাগান, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, ধর্মীয় উপাসনালয় ও বিশ্বের বৃহত্তম বালুকাময় সমুদ্র সৈকত। এছাড়াও দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিস্তীর্ণ পাহাড় ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জীবনযাত্রাও আমাদের অনন্য এক বৈচিত্র্যময় সম্পদ। প্রকৃতি মানুষের জীবনে অবিচ্ছেদ্য অংশ। ভ্রমণপিপাসুদের অনবদ্য আবেদন প্রকৃতি। উর্ধাকাশে বিস্তীর্ণ নীলিমা, পায়ের নিচে শীতল মাটি, চারপাশে গাছপালা আর নদীর স্বচ্ছ জল একজন ভ্রমণপিপাসুর জীবনে এনে দেয় অনন্য এক শান্তি ও শক্তি। ভ্রমণপিপাসুদের জন্য প্রকৃতি এক অপরূপ প্রেরণার উৎস, যা তাদের জীবনে আনন্দ, তৃপ্তি ও নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আসে। সভ্যতার শুরু থেকেই মানবসন্তান প্রকৃতি দর্শন, নতুন সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হওয়া, মানসিক প্রশান্তি এবং আত্মিক পরিশুদ্ধির জন্য ভ্রমণের নেশায় উদ্বুদ্ধ। কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়ায় বিশ্ব জুড়ে অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে ক্রমেই প্রকৃতি তার অনবদ্য প্রাকৃতিক আবেদন হারিয়ে ফেলছে।
বিশ্বজুড়ে জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য আজ মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন। প্রকৃতি উজাড় করে মানুষ গড়ে তুলছে আবাসন, কলকারখানা, সড়ক ও অন্যান্য অবকাঠামো। আধুনিকতার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে মানুষ এখন শারীরিক পরিশ্রমের থেকে মানসিক পরিশ্রমই বেশি করছে। ফলে মস্তিকের ওপর পড়ছে বাড়তি চাপ। আর চাপ থেকে রেহাই পেতে ও মানসিক প্রশান্তির জন্য প্রয়োজন প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্য। সেই প্রকৃতিকেও মানুষ ঠেলে দিয়েছে ধ্বংসের দারপ্রান্তে। জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক ভারসাম্যের সংকট নিরসনে উত্থিত হয়েছে নতুন ধারণা ইকো-ট্যুরিজম বা পরিবেশবান্ধব পর্যটন। কিন্তু এই ইকো-ট্যুরিজম আদৌ কতটা পরিবেশবান্ধব? প্রকৃতির ক্ষতি না করে একধরনের সহাবস্থান তৈরি করতেই মূলত ইকো-ট্যুরিজম ধারণাটির উদ্ভব হয়। পর্যটকরা প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করবেন প্রকৃতির কোনো ক্ষতি না করে।
ভ্রমণপিপাসুদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের পাশাপাশি পর্যটকদের মাধ্যমে স্থানীয় জনগোষ্ঠী অর্থনৈতিকভাবে উপকৃত হবে। বিশ্বের অনেক দেশ ইকো-ট্যুরিজমকে ধারণ করে প্রকৃতি সংরক্ষণের পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়েছে। যেমন: ল্যাটিন আমেরিকার দেশ কোস্টারিকা ইকো-ট্যুরিজমে সফলতা অর্জন করেছে। সেখানকার ঘন অরণ্য ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের পাশাপাশি পর্যটন খাত থেকে অর্জিত আয় স্থানীয় মানুষের জীবনমান উন্নয়নে ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে প্রকৃতি রক্ষার পাশাপাশি অর্থনৈতিক উন্নয়নও সম্ভব হয়েছে। তর্কের পক্ষে যুক্তি হল ইকো-ট্যুরিজম পরিবেশ সচেতনতা গড়ে তোলে। একজন পর্যটক যখন জঙ্গলে হাঁটতে হাঁটতে বিরল পাখির ডাক শোনেন বা সাগরসৈকতে গিয়ে দেখেন প্রবাল কিংবা সামুদ্রিক প্রাণী যেমন: লাল কাঁকড়া, জেলিফিশ, অক্টোপাস কিংবা সমুদ্র তীরবর্তী বনাঞ্চলের ভঙ্গুর বাস্তুতন্ত্র কতটা সংবেদনশীল, তখন তিনি স্বাভাবিকভাবেই পরিবেশ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন।
এই অভিজ্ঞতা শুধু ভ্রমণের আনন্দ দেয় না- পাশাপাশি তার জীবনাচরণে স্থায়ী প্রভাব ফেলে। তিনি হয়তো নিজ শহরে ফিরে গিয়ে প্লাস্টিক কম ব্যবহার করবেন অথবা জলবায়ু আন্দোলনের সমর্থক হবেন। ভারতের সিকিম রাজ্য ইকো-ট্যুরিজমের একটি বড় উদাহরণ। সেখানে সরকার ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর উদ্যোগে ‘প্লাস্টিক ফ্রি ট্যুরিজম’ চালু হয়েছে। পর্যটকদের প্লাস্টিক বহন নিষিদ্ধ করা হয়েছে, স্থানীয় পরিবারগুলোকে স্থানীয়ভাবে উৎপন্ন পণ্য ব্যবহারে উৎসাহিত করা হয়েছে এবং ভ্রমণকে প্রকৃতিকেন্দ্রিক রাখা হয়েছে। এর ফলে সিকিম আজ ভারতের একটি অন্যতম পরিবেশবান্ধব পর্যটন গন্তব্য। একইভাবে কেরালার ব্যাকওয়াটার হাউসবোট ইকো-ট্যুরিজমও স্থানীয় জেলেদের জীবিকা দিয়েছে, সেইসঙ্গে নদী-খাল সংরক্ষণে অর্থ জুগিয়েছে। কিন্তু এতো এতো উদাহরণের মাঝেও সর্বোচ্চ বিপরীতমুখী অবস্থানে নিদর্শন সৃষ্টি করছি আমরা। সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে পাহাড়ের কোলঘেঁষে বিস্তীর্ণ জলরাশির এক অনন্য সৌন্দর্যের আধার টাঙ্গুয়ার হাওর। তাহিরপুর ও ধর্মপাশা উপজেলার ৪টি ইউনিয়নের ১৮টি মৌজাজুড়ে ছোট-বড় ৫৪টি বিল এবং ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য খাল নিয়ে গড়ে উঠা টাঙ্গুয়ার হাওর এ অঞ্চলের ৮৮টি গ্রামের প্রায় ৬০ হাজার মানুষের জীবন-জীবিকার যোগানদাতা। টাঙ্গুয়ার হাওরে রাত যাপন করতে প্রতিবছর কয়েক লাখ পর্যটক হাউজবোটে অবস্থান গ্রহণ করে। ইঞ্জিনচালিত দৃষ্টিনন্দন হাউজবোটে হাওর ঘুরে বেড়ানো আর রাতযাপনের পাশাপাশি প্লাস্টিক বর্জ্য ও পয়োনিষ্কাশন বর্জ্যে ভয়াবহ দূষণ ঘটাচ্ছে প্রাণ, প্রকৃতি, প্রতিবেশ নিয়ে অসচেতন পর্যটকগণ। টাঙ্গুয়ার হাওর দেশের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক রামসার সাইট।
১৯৯৯ সালে ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ ঘোষণার পরের বছর ‘রামসার সাইট’ হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও হাওরের প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষায় তেমন কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ এখনও পর্যন্ত পরিলক্ষিত হচ্ছে না। ঠিক তেমনি দেশের সমুদ্রসৈকতগুলো যেমন: কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন, পতেঙ্গা ও কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতও প্লাস্টিক দূষণের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। সমুদ্রসৈকতে মানুষ যায় অবকাশ যাপন করতে; কিন্তু আমাদের দেশের সৈকতগুলো যেন মাদকের অভয়ারণ্য। সৈকতে ধূমপানের উৎকট গন্ধে অনেক পর্যটক বিরক্ত। সূর্যোদয় উপভোগ করতে সৈকতে হাঁটতে গেলে চোখে পড়ে মাদকের বোতল, দ্বীপ উপজেলা মহেশখালীও যেন পর্যটকদের উপদ্রবে ক্লান্ত। যেখানে সেখানে প্লাস্টিকের ছড়াছড়ি। সী-ট্রাকে উন্মুক্ত ধূমপান প্রতিরোধে নেই কোনো উদ্যোগ।
তাছাড়া হিমছড়ি, জাতীয় পার্ক, লালবাগের কেল্লা, বিভিন্ন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, সোয়াম্প ফরেস্ট, জাফলং, সাজেক ভ্যালি, নিঝুম দ্বীপ, মহাস্থান গড়, ষাটগম্বুজ মসজিদসহ আরও অনেক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংবলিত স্থানগুলো প্লাস্টিক বর্জ্য ও বিভিন্ন দূষণের কারণে পর্যটকদের আকর্ষণ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে টমাস কুক প্যাকেজ ট্যুরের মাধ্যমে পর্যটনশিল্পের যাত্রা শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে মেক্সিকান পরিবেশবিদ হেক্টর সেবালোস লাসকিউরেইন ১৯৮০ সালের দিকে পরিবেশ বিপর্যয় ও সংরক্ষণকে গুরুত্ব দিয়ে ইকোট্যুরিজম প্রবর্তন করেন। তিনি ইকোট্যুরিজমে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও স্থানীয় জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। ইকোট্যুরিজমে পরিবেশ সংরক্ষণ এবং স্থানীয় সংস্কৃতিকেও অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। ইকো-ট্যুরিজম হলো- একটি দায়িত্বশীল ভ্রমণ পদ্ধতি। কিন্তু আমাদের দেশে পর্যটন স্পটগুলোতে পর্যটকদের যে অদূরদর্শী কার্যক্রম দৃশ্যমান হয়, তাতে করে ইকো-ট্যুরিজম কতটুকু বাস্তবায়ন সম্ভব তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এর পাশাপাশি অযথা গাছ কাটা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাব এবং অপরিকল্পিত নির্মাণ কার্যক্রম পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করাও ইকো-ট্যুরিজমের জন্য অন্যতম প্রতিবন্ধক।
টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থায়ন এবং সরকারের উদ্যোগের অভাবে ইকো-ট্যুরিজমকে যথাযথভাবে প্রসারিত করা সম্ভব হচ্ছে না। যথাযথ উদ্যোগ এবং পরিকল্পনা নিলে ইকো-ট্যুরিজম বাংলাদেশের অর্থনীতি ও পরিবেশের উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশে ইকো-ট্যুরিজমের সমস্যা সমাধানের জন্য সুপরিকল্পিত এবং সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। এই উদ্যোগগুলোর মধ্যে পরিবেশগত সুরক্ষা, অবকাঠামো উন্নয়ন, স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ এবং পর্যটকদের সচেতনতা বৃদ্ধির মতো বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। টেকসই পরিকল্পনা তৈরি করা একান্ত প্রয়োজন এবং এর মাধ্যমে ইকো-ট্যুরিজম গন্তব্যগুলোতে পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। স্থানীয় জনগণের সঙ্গে পরামর্শ করে প্রকল্প তৈরি করলে তাদের অংশগ্রহণ বাড়বে এবং তারা প্রকল্পগুলোর দেখভালে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসবে। পর্যটকদের জন্য যাতায়াত এবং আবাসনের ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে।
সড়ক, পরিবহনব্যবস্থা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গেলে পর্যটকদের অভিজ্ঞতা আরও ভালো হবে। পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব স্থাপত্য এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য জিনিসপত্র ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। স্থানীয় জনগণকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার মাধ্যমে তাদের ইকো-ট্যুরিজমের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। প্রশিক্ষিত গাইড এবং পরিবেশ রক্ষায় সচেতন কর্মী তৈরি করা গেলে স্থানীয়দের আয়ের সুযোগ বাড়বে এবং পরিবেশও সুরক্ষিত থাকবে। পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য কার্যকর নীতিমালা তৈরি এবং এর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। পর্যটকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে, যাতে তারা দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে পারে। প্রকৃত অর্থে এটি কার্যকর হলে ইকো ট্যুরিজম শুধু পরিবেশ রক্ষাই করবে না বরং আগামী প্রজন্মের জন্য একটি সবুজ ও ভারসাম্যপূর্ণ রাষ্ট্রও গড়ে তুলবে।
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট