প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
দুর্গাপূজা, এক অনন্য ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক উৎসব, দক্ষিণ এশিয়ার সমাজজীবনে কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় আচারানুষ্ঠান নয়; বরং এটি বহুবর্ণিল সামষ্টিক ঐতিহ্যের প্রতীক, সহাবস্থানের মহা-অভ্যাস এবং ইতিহাস-সঞ্জাত বাঙালি সংস্কৃতির মৌল ভিত্তি। শত শত বছর ধরে এই উৎসব শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষও এই উৎসবের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত থেকেছে। এটি শুধু ধর্মীয় অনুশীলনের অংশ নয়, বরং এটি একটি সামাজিক বন্ধন, যেখানে প্রতিটি মানুষ তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়, সামাজিক দায়িত্ব ও সহনশীলতার প্রতিফলন পায়। প্রতিটি পূজামণ্ডপ, প্রতিটি আরতি, প্রতিটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সমাজে মিলনমেলার আবহ সৃষ্টি হয়। কিন্তু এই আনন্দমুখর পরিসর এখন এক নতুন ধরনের বিপন্নতায় আক্রান্ত- প্রযুক্তির অদৃশ্য আগ্রাসন, বিশেষ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence বা এআই) নির্ভর ভুয়া তথ্য, ডিপফেক ছবি ও ভিডিও এবং অনিয়ন্ত্রিত গুজবের সুনামি।
আধুনিক সভ্যতায় তথ্যপ্রবাহের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা যাদের হাতে, তারাই সমাজের মনস্তত্ত্বকে প্রভাবিত করতে সক্ষম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, অ্যালগরিদমিক কাঠামো এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অগ্রযাত্রা মানুষের চিন্তা, আবেগ ও আচরণকে অভূতপূর্বভাবে প্রভাবিত করছে। যে যুগে সত্য-মিথ্যার সীমানা ছিল স্পষ্ট, সেই যুগ পেরিয়ে আমরা এসেছি এমন এক সময়ে, যেখানে একটি ভিডিও বা ছবি সত্য নাকি প্রযুক্তি-সৃষ্ট বিভ্রম- তা নির্ণয় করা কঠিন হয়ে পড়েছে। দুর্গাপূজার মতো আবেগপ্রবণ উৎসব এ ধরনের প্রযুক্তিনির্ভর গুজবের জন্য সবচেয়ে স্পর্শকাতর ক্ষেত্র।
মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে উৎসবকেন্দ্রিক সময়কে বলা যায় আবেগীয় উত্তেজনার ঋতু। এই সময়ে মানুষ স্বাভাবিক জীবনের চেয়ে বেশি আবেগী, অধিক সংবেদনশীল এবং সামাজিকভাবে বেশি যুক্ত। দুর্গাপূজা বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে এক গভীর পবিত্রতার প্রতীক। প্রতিমা, পূজামণ্ডপ, আরাধনা, আরতি, অঞ্জলি- সবকিছুই মানুষের ভেতরে সৃষ্টি করে এক অদ্ভুত আত্মিক উচ্ছ্বাস। এই উচ্ছ্বাসের মাঝেই নিহিত থাকে ভঙ্গুরতা। কারণ, এই সময় যে কোনো নেতিবাচক খবর, গুজব কিংবা অবমাননাকর চিত্র মানুষের আবেগে তীব্র অভিঘাত সৃষ্টি করে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, উৎসবকালীন সময়ে গুজব ও উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড তুলনামূলক বেশি প্রভাব ফেলে।
বাংলাদেশ তথা এ ভূখণ্ডের ইতিহাসে গুজবনির্ভর সহিংসতা নতুন কিছু নয়। পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশ পর্যন্ত বহুবার দেখা গেছে, কোনো একটি ভিত্তিহীন খবরের কারণে গ্রামজুড়ে আগুন লেগে গেছে, নিরীহ মানুষের বাড়িঘর ভস্মীভূত হয়েছে, প্রতিমা ভাঙচুর হয়েছে। এক দশক আগেও একটি ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে রামুতে বৌদ্ধবিহার ধ্বংস করা হয়েছিল। একইভাবে কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, দিনাজপুরসহ দেশের নানা স্থানে দুর্গাপূজার সময় সামান্য উসকানিকে কেন্দ্র করে বড় ধরনের সহিংসতা সংঘটিত হয়েছে।
লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক রংপুর