প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
মনে করুন, একজন অচেনা ব্যক্তি মাত্র কয়েকশ’ টাকার বিনিময়ে আপনাকে এমন কিছু দিচ্ছে যা কল্পনাকেও হার মানাবে। কাউকে না জানিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি, অবস্থান সংক্রান্ত তথ্য, মাসব্যাপী কলের বিস্তারিত রেকর্ড, এসএমএসের আর্কাইভ, এমনকি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের বিবরণ। ভাবতে অবাক লাগে, শুধু একটি মোবাইল নম্বর কিংবা জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বরের মাধ্যমেই এসব সংবেদনশীল তথ্য হাতের মুঠোয় পাওয়া সম্ভব হচ্ছে। এটি কোনো কল্পকাহিনী নয়, সাম্প্রতিক এক অনুসন্ধানে উন্মোচিত হওয়া এক ভয়াবহ বাস্তবতা যা গোটা দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থার ভঙ্গুরতার চিত্র তুলে ধরছে।
তদন্তে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সরকারি তথ্যপ্রযুক্তি সূত্র জানিয়েছে, এটি কোনো বেসমেন্টে লুকিয়ে থাকা একা হ্যাকারদের কাজ নয়। বরং প্রাথমিক অনুসন্ধানে দেখা গেছে যে, কিছু প্রতিষ্ঠানের ভেতরের লোকের যোগসাজশে এই তথ্য পাচারের চক্র সক্রিয় রয়েছে। ব্যাংক, মোবাইল আর্থিক সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান, এমনকি সরকারি সংস্থাগুলোর আইটি কর্মী এবং কিছু অসাধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যও এতে জড়িত থাকার ইঙ্গিত মিলেছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ‘সবএখানে’ নামের একটি অ্যাপ এবং একটি পরিচয়ভিত্তিক ওয়েবসাইট প্রকাশ্যে মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য লেনদেন করছে। এরা প্রায় ২৫টি ভিন্ন ভিন্ন বিভাগের সংবেদনশীল তথ্য সরবরাহ করছে। এরমধ্যে রয়েছে জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি, পিডিএফ আকারের জাতীয় পরিচয়পত্র, ড্রাইভিং লাইসেন্সের তথ্য, পাসপোর্টের বিবরণ, জন্ম নিবন্ধন, কর শনাক্তকরণ নম্বর, পুলিশের ডাটাবেস থেকে মামলা সংক্রান্ত তথ্য, কলের বিস্তারিত রেকর্ড (সিডিআর), এসএমএস আর্কাইভ, এমনকি মোবাইল ব্যাংকিং এবং ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট সম্পর্কিত লেনদেনের তথ্য।
অপরাধীরা কৌশলগতভাবে টেলিগ্রাম চ্যানেল, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ এবং ফেসবুকে ভুয়া নামে বিজ্ঞাপন প্রচার করছে। তারা ‘বিল গেটস’, ‘মার্ক জুকারবার্গ’ প্রভৃতি ভুয়া পরিচয় ব্যবহার করে মানুষের মধ্যে আস্থা তৈরি করছে এবং তাদের কাছে স্পষ্ট নির্দেশনা দিচ্ছে কিভাবে এই সেবা নেওয়া যাবে। সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হলো, এসব তথ্য সংগ্রহের জন্য কোনো জটিল প্রক্রিয়ার প্রয়োজন নেই। কেবল একটি মোবাইল নম্বর অথবা জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর দিলেই, একটি ছোট পেমেন্টের মাধ্যমে ব্যক্তিগত তথ্য হাতে পাওয়া যাচ্ছে।
ব্যক্তিগত তথ্য চুরি হওয়া কেবল প্রযুক্তিগত সমস্যা নয়, এটি সামাজিক এবং আর্থিক সংকটের জন্ম দেয়। এই তথ্যের মাধ্যমে চাঁদাবাজি, প্রতারণা, ছদ্মবেশ ধারণ এবং আর্থিক চুরি সংঘটিত হচ্ছে। অপরাধীরা চুরি হওয়া জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে জাল সিম নিবন্ধন করছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুয়া একাউন্ট খুলছে এবং তা প্রতারণা ও ব্ল্যাকমেইলিংয়ের জন্য ব্যবহার করছে।
উদাহরণস্বরূপ- সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে, শুধুমাত্র ঢাকা মহানগরীতে গত এক বছরে প্রায় ৪,২০০টি প্রতারণা ও ব্ল্যাকমেইলিং-এর অভিযোগ দায়ের হয়েছে, যার বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্র এবং ব্যাংক সংক্রান্ত তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে। এর ফলে অনেক মানুষ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত এবং আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দেশে প্রতি বছর প্রায় ১,২০০ কোটি টাকার আর্থিক প্রতারণা হচ্ছে যা সরাসরি তথ্য ফাঁস এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা ঘাটতির কারণে ঘটছে।
এই সমস্যার দুটি বড় দিক রয়েছে। প্রথমটি প্রযুক্তিগত, যেখানে সংবেদনশীল ডেটাবেস যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়া পরিচালিত হচ্ছে। দ্বিতীয়টি প্রাতিষ্ঠানিক, যেখানে ভেতরের অসাধু কর্মীরা ব্যক্তিগত তথ্য পাচারের সঙ্গে জড়িত। প্রযুক্তিগত দিক থেকে দেখা যায়, অনেক সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এখনও পুরোনো সফটওয়্যার এবং দুর্বল নিরাপত্তা ব্যবস্থা ব্যবহার করছে। উদাহরণস্বরূপ- এপিআই প্রমাণীকরণ সঠিকভাবে কার্যকর নয়, এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশন নেই এবং রিয়েল-টাইম নজরদারির অভাব রয়েছে। এর ফলে অপরাধীরা সহজেই তথ্য সংগ্রহ করতে পারছে।
তবে সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হলো অভ্যন্তরীণ জড়িত থাকা। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানের ভেতরের বিশেষাধিকারপ্রাপ্ত কর্মীরাই অর্থের বিনিময়ে এই তথ্য পাচার করছে। এটি কেবল প্রযুক্তিগত নয়, নৈতিক সংকটেরও প্রতিফলন।
বিশ্বব্যাপী ডিজিটাল নিরাপত্তার মান নির্ধারণে জিডিপিআর (General Data Protection Regulation) একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ইউরোপীয় দেশগুলোতে কোনো ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহারের আগে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির স্পষ্ট অনুমতি নিতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এখনও কোনো শক্তিশালী ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা আইন কার্যকর হয়নি। ২০২৫ সালের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ৬৫ শতাংশ সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং ৭২ শতাংশ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক মানের তথ্য সুরক্ষা নীতি অনুসরণ করে না। এর ফলে বাংলাদেশ ডিজিটাল নিরাপত্তা সূচকে ১৩৮টি দেশের মধ্যে ১১৫তম স্থানে রয়েছে।
এই সংকট সমাধানে শুধু প্রযুক্তিগত সমাধান যথেষ্ট নয়। দরকার কঠোর আইন এবং নীতিগত সংস্কার। যেমন-
১. ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা আইন প্রণয়ন : একটি শক্তিশালী আইন থাকা জরুরি, যা নির্ধারণ করবে কোন তথ্য কিভাবে ব্যবহার হবে এবং বেআইনি তথ্য ফাঁসের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান থাকবে।
২. তৃতীয় পক্ষের নিরাপত্তা নিরীক্ষা : প্রতি বছর সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য সুরক্ষা ব্যবস্থা পরীক্ষা করা উচিত।
৩. কর্মীদের দায়বদ্ধতা : সংবেদনশীল তথ্যের অ্যাক্সেস সীমিত করতে হবে এবং কর্মীদের প্রতিটি কার্যক্রমের নজরদারি করতে হবে।
৪. অপরাধ দমনে শক্তিশালী সাইবার পুলিশ ইউনিট : বিশেষায়িত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সাইবার পুলিশ দল গঠন করা উচিত, যারা দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানাতে পারবে।
প্রযুক্তিগত সমাধান এবং নীতিগত সংস্কারের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের সচেতনতা বাড়ান অত্যন্ত জরুরি। অপরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর বা ওটিপি শেয়ার করা যাবে না, সন্দেহজনক বার্তা বা অ্যাপ কর্তৃপক্ষের কাছে রিপোর্ট করতে হবে এবং এমএফএস কোম্পানিগুলোর উচিত গ্রাহকদের জন্য স্পষ্ট অভিযোগ নিষ্পত্তি ব্যবস্থা রাখা।
একটি জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশের ৫৭ শতাংশ মানুষ জানেন না কিভাবে তাদের ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষিত রাখতে হয়। তাই গণমাধ্যম, এনজিও এবং সরকারকে যৌথভাবে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা এসেছে যে অন্তত পাঁচ থেকে ছয়টি অনুরূপ অ্যাপ শনাক্ত করা হয়েছে এবং এগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তবে এটি কেবল প্রাথমিক পদক্ষেপ। যতক্ষণ না মূল ডেটাবেসের ভেতরের ফাঁকফোকর বন্ধ হচ্ছে এবং অসাধু কর্মীদের চিহ্নিত করে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে, ততক্ষণ এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। ভবিষ্যতে আরও বড় চ্যালেঞ্জ আসতে পারে, কারণ প্রযুক্তি যেমন দ্রুত বিকশিত হচ্ছে, তেমনি অপরাধীরাও নতুন নতুন কৌশল তৈরি করছে। তাই নিয়মিত আপডেটেড নিরাপত্তা ব্যবস্থা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক নজরদারি এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অপরিহার্য।
এই তথ্য পাচার কেলেঙ্কারি শুধু একটি অপরাধ নয়, এটি আমাদের ডিজিটাল ভবিষ্যতের প্রতি হুমকি। যদি এখনই ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তবে মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য হবে সবচেয়ে বড় অস্ত্র, যা অপরাধীদের হাতে দেশের নিরাপত্তা ও অর্থনীতিকে অস্থিতিশীল করে তুলবে।
এখন সময় এসেছে প্রযুক্তিগত সমাধান, নীতিগত সংস্কার এবং জনসচেতনতার সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার। ব্যক্তিগত তথ্য কেবল ডেটা নয়, এটি মানুষের নিরাপত্তা, মর্যাদা এবং আস্থার প্রতীক। তাই এর সুরক্ষা নিশ্চিত করা আমাদের সবার দায়িত্ব।
লেখক : শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ
ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ