প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রকে সর্বশ্রেষ্ঠ শাসনব্যবস্থা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ধারণা করা হয়, এটি এমন এক ব্যবস্থা যেখানে জনগণের কণ্ঠস্বর সর্বোচ্চ প্রাধান্য পায় এবং তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সমাজের সার্বিক কল্যাণে কাজ করে। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রেক্ষাপটে এই ধারণা বেশিরভাগ সময়ই এক ভিন্ন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়। এখানে গণতন্ত্র কেবল একটি বাহ্যিক সাজসজ্জা হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যা আন্তর্জাতিক মহলের কাছে নিজেদের ‘সভ্য’ ও ‘প্রগতিশীল’ প্রমাণ করার একটি উপায় মাত্র।
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রায়শই শুধু নামেই বিদ্যমান। এখানে নির্বাচন হয়, রাজনৈতিক দলগুলো সক্রিয় থাকে এবং সংবিধানের পাতায় জনগণের অধিকারের কথা লেখা থাকে। কিন্তু এই বাহ্যিক কাঠামোর পেছনে লুকিয়ে থাকে ক্ষমতাশালী এলিটদের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ। নির্বাচনে অর্থ, পেশীশক্তি এবং কারচুপি এক সাধারণ ঘটনা। ফলে, সত্যিকারের জনগণের প্রতিনিধিরা ক্ষমতায় আসতে পারে না, বরং নির্বাচিত হন তারাই যারা বিদ্যমান ক্ষমতা কাঠামোকে রক্ষা করতে পারেন। এটি এমন এক ফাঁপা গণতন্ত্র যেখানে ভোট দেওয়ার স্বাধীনতা থাকলেও, সত্যিকার অর্থে পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচিত করার সুযোগ থাকে না।
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে গণতন্ত্রের দুর্বলতার অন্যতম প্রধান কারণ হলো- সীমাহীন অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং লাগামহীন দুর্নীতি। যখন সমাজের একটি বিশাল অংশ দারিদ্র্য ও অশিক্ষার মধ্যে দিনাতিপাত করে, তখন তাদের কাছে রাজনৈতিক অধিকারের চেয়ে দৈনন্দিন জীবনধারণের প্রয়োজন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। এই সুযোগে রাজনীতিবিদরা সামান্য আর্থিক সুবিধা দিয়ে বা মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে সহজেই জনগণের ভোট কিনে নেয়। দুর্নীতির কারণে রাষ্ট্রের সম্পদ কিছু নির্দিষ্ট ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত হয়, যা জনগণের জন্য বরাদ্দকৃত পরিষেবাগুলোকে দুর্বল করে দেয়। এভাবে, গণতন্ত্র এক অভিজাত শ্রেণির পকেট ভরার হাতিয়ারে পরিণত হয়।
গণতন্ত্রের সফলতার জন্য শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান অপরিহার্য। একটি স্বাধীন বিচার বিভাগ, নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন, এবং কার্যকর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গণতন্ত্রের মূল স্তম্ভ। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এসব প্রতিষ্ঠান প্রায়শই রাজনৈতিক প্রভাবাধীন থাকে। বিচারকরা ক্ষমতাসীনদের পক্ষে রায় দিতে বাধ্য হন, নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়, এবং পুলিশ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যখন গণতন্ত্রের রক্ষক প্রতিষ্ঠানগুলোই দুর্বল এবং পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পড়ে, তখন গণতন্ত্রের মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হয়।
গণতন্ত্র মানে শুধু নির্বাচন নয়, এটি হলো ভিন্নমত প্রকাশের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং মতপ্রকাশের অধিকার। কিন্তু অনেক উন্নয়নশীল দেশে সরকার ভিন্নমত সহ্য করতে পারে না। সমালোচনাকারী সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী এবং মানবাধিকার কর্মীদের হয়রানি করা হয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বা এ ধরনের নানা আইনের মাধ্যমে মানুষের বাকস্বাধীনতা সীমিত করা হয়। ফলে, জনগণের মধ্যে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হয়, এবং তারা সরকারের ভুল কাজের প্রতিবাদ করতে সাহস পায় না। এভাবে, গণতন্ত্রের প্রাণশক্তি গণমানুষের অংশগ্রহণ এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ক্রমাগত দুর্বল হতে থাকে।
তাছাড়া, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে গণতন্ত্র কাজ করে না। গণতন্ত্র একটি দরিদ্র দেশকে ধনী দেশে পরিণত করতে পারে না। একটি দেশের গণতন্ত্র অর্জনের মূলনীতি হলো এটি ইতিমধ্যেই একটি অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশ।
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে গণতন্ত্রের এই করুণ চিত্র হতাশাজনক। গণতন্ত্রকে শুধু একটি বাহ্যিক সাজসজ্জা হিসেবে ব্যবহার না করে, এর মূল উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করা জরুরি। এর জন্য প্রয়োজন দুর্নীতি দমন, অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস এবং শক্তিশালী নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান তৈরি করা। জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাও অপরিহার্য। যদি এই মৌলিক পরিবর্তনগুলো না আসে, তাহলে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে গণতন্ত্র চিরকালই একটি ফাঁকা স্লোগান এবং একটি বাহ্যিক প্রদর্শনী হিসেবেই থেকে যাবে।
লেখক : সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
ফিচার, কলাম অ্যান্ড কন্টেন্ট রাইটার্স।