প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ০২ অক্টোবর, ২০২৫
চা পানের ইতিহাস বেশ পুরোনো। প্রায় তিন হাজার বছর আগে চীনে প্রথম চা পানের রেওয়াজ চালু হয়। এরপর ক্রমাগতভাবে এটি ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরেও চা পানের প্রচলন সাধারণ মানুষের মধ্যে খুব বেশি ছিল না। তবে, আধুনিক জীবনযাত্রায় চা এক গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক পানীয়। বর্তমানে প্রায় সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ প্রতিনিয়ত চা পান করে থাকে। আমাদের দেশও তার ব্যতিক্রম নয়। গত সপ্তাহে এসডো’র সংবাদ সম্মেলন চা-প্রেমীদের একটি মানসিক ধাক্কা দিয়েছে। টি-ব্যাগে ভারী ধাতুর পরিমাণ গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। এসডো ১৩টি নমুনা বাজার থেকে সংগ্রহ করে ল্যাব টেস্ট করে। যার মধ্যে ১২টি নমুনা ছিল শুধু টি-ব্যাগ, ১টি ছিল চা-পাতা। প্রতিটি নমুনাতেই তারা ভারী ধাতুর উপস্থিতি পেয়েছে। ক্রোমিয়ামের গ্রহণযোগ্য মাত্রা ৫ পিপিএম, কোনো কোনো নমুনায় এটি পাওয়া গিয়েছে ১৬৯০ পিপিএম পর্যন্ত। একইভাবে, লেডের গ্রহণযোগ্য মাত্রা ৫ পিপিএম, পাওয়া গিয়েছে ৫১ পিপিএম পর্যন্ত। যা রীতিমতো অস্বাভাবিক। আরও উদ্বেগজনক হলো- ইউরেনিয়াম ও থোরিয়ামের মতো তেজস্ক্রিয় মৌলও এ তালিকায় রয়েছে। গবেষণায় আরও একটি বিষয় উঠে এসেছে, প্রায় ৯৯% মানুষ টি-ব্যাগে ভারী ধাতুর বিষয়ে একেবারেই অজ্ঞাত। অর্থাৎ আমাদের সচেতনতার মাত্রা ও ভয়াবহতার মাত্রা সমানুপাতিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
চা পাতায় ভারী ধাতুর উপস্থিতি মূলত কয়েকটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে। তন্মধ্যে মাটির গুণাগুণ, চা পাতা প্রক্রিয়াজাতকরণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চা যেহেতু অধিক বৃষ্টিপাত অঞ্চলে জন্মে থাকে এবং চা চাষের জন্য কিছুটা অ্যাসিডিক মাটির প্রয়োজন হয়। এই অ্যাসিডিক মাটি চা-পাতায় ভারী ধাতুর প্রবেশ অনেকটাই সহজ করে দেয়। ইউনিভার্সিটি অব অ্যালবার্টার বেশ কিছু গবেষকও প্রায় একই রকম একটি গবেষণা পরিচালনা করেন। তাদের শিরোনাম ছিল- ‘প্রক্রিয়াজাত চা পাতার উপকারিতা ও ঝুঁকি’। সেখানেও তারা প্রায় প্রতিটি নমুনাতেই ভারী ধাতুর অস্তিত্ব পেয়েছেন। তবে, তাদের প্রাপ্ত ভারী ধাতুর পরিমাণ গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে সামান্য বেশি ছিল। তারা চীন থেকে প্রাপ্ত নমুনায় ভারী ধাতুর অস্তিত্ব পেয়েছিলেন। এজন্য তারা চীনের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রকে অনেকটাই দায়ী করেন। এখান থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়; শুধু মাটি নয়, বায়ুদূষণও এক্ষেত্রে নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে। অর্থাৎ সামগ্রিক পরিবেশের বিপন্নতাই এর জন্য দায়ী।
ভারী ধাতু জনস্বাস্থ্যের জন্য এক মারাত্মক হুমকি। এগুলো দীর্ঘমেয়াদে নানারকম স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে। বিশেষ করে লেড, আর্সেনিক ও ক্রোমিয়াম বিভিন্ন কার্ডিওভাস্কুলার ও নিউরোলজিক্যাল রোগের জন্য দায়ী। এই ধাতুগুলো শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। এমনকি ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সও ঘটাতে পারে। যে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রায় ৩১টি রোগের সাথে জড়িত। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ডায়াবেটিস, হৃদরোগ ও গাঁটসহ বিভিন্ন লাইফস্টাইল ডিজিজ। এছাড়াও এটির একটি বড় অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্ভাবনাও রয়েছে। বাংলাদেশ একটি উন্নতমানের চা-সমৃদ্ধ দেশ। আমাদের চা পাতার যেমন ঐতিহাসিক ভূমিকা রয়েছে, তেমনি রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ভূমিকা। বিখ্যাত সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস তাঁর ‘দ্য লিগ্যাসি অব ব্লাড’ গ্রন্থে’ বলেছেন- ১৯৭৩ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় বাংলাদেশ আরবদের সমর্থন করে। এ জন্য সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ টোকেন হিসেবে কিছু উৎকৃষ্ট চা পাঠায়।
উপহারটি মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সা’দাত খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করেন। এর বিনিময়ে তিনি যুদ্ধ শেষে বাংলাদেশকে ৫৩টি টি-৫৪ ট্যাংক উপহার দিয়েছিলেন। এছাড়াও দেশের বাইরে আমাদের চা-পাতার একটি বড় বাজার রয়েছে। বাংলাদেশ চা বোর্ডের তথ্য মতে, পৃথিবীর মোট উৎপাদনের ১.৫ শতাংশ চা বাংলাদেশে উৎপন্ন হয়। বিদেশের প্রতিটি কাস্টমস ক্লিয়ারিং সেন্টারেই রাসায়নিক ল্যাব রয়েছে। সেখানে মানোত্তীর্ণ না হলে রপ্তানী প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হতে পারে, যা সামগ্রিক চা-শিল্পে এক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
সুতরাং নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে ভোক্তা- অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে জোরালো ভূমিকা পালন করতে হবে।
লেখক : ইন্সট্রাক্টর (রসায়ন), ভেড়ামারা সরকারি টিএসসি, কুষ্টিয়া