প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ০২ অক্টোবর, ২০২৫
আমরা দেশের খাই দেশের পরি। কিন্তু দেশের জন্য আসলে কী করি! আমাদের দেশপ্রেম কি শুধুই লোক দেখানো ব্যাপার? নইলে দেশের ক্ষতি হয়, দেশের মানুষ কষ্টে থাকে এমন কাজ আমরা কী করে করতে পারি। রবীন্দ্রনাথের একটি গানের শরণ নিতে পারি। কেন চেয়ে আছ, গো মা, মুখপানে।/এরা চাহে না তোমারে চাহে না যে, আপন মায়েরে নাহি জানে।/এরা তোমায় কিছু দেবে না, দেবে না মিথ্যা কহে শুধু কত কী ভাণে। তুমি তো দিতেছ, মা, যা আছে তোমারি স্বর্ণশস্য তব, জাহ্নবীবারি,/ জ্ঞান ধর্ম কত পুণ্যকাহিনী।/এরা কী দেবে তোরে! কিছু না, কিছু না। মিথ্যা কবে শুধু হীনপরাণে/মনের বেদনা রাখো, মা, মনে। নয়নবারি নিবারো নয়নে/ মুখ লুকাও, মা, ধুলিশয়নে ভুলে থাকো যত হীন সন্তানে।/ শূন্য-পানে চেয়ে প্রহর গণি গণি দেখো কাটে কি না, দীর্ঘ রজনী।/দুঃখ জানায়ে কী হবে, জননী, নির্মম চেতনাহীন পাষাণে।
এই গানটি শুনলে মনটা আর্দ্র হয়ে যায়। সত্যি তো দেশ আমাদের এত কিছু দিচ্ছে; কিন্তু আমরা নিজেকে ছোট করে রেখেছি। দেশের জন্য প্রকৃতার্থে তেমন কিছু করছি না। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশে গবেষণার ক্ষেত্র উন্নত দেশসমূহের তুলনায় বেশ সংকুচিত। তবুও সীমিত সুযোগ-সুবিধার মধ্যে বাংলাদেশি গবেষক ও বিজ্ঞানীরা দেশে-বিদেশে নানান ক্ষেত্রে অবদান রাখছেন। তোষা পাটের জীবন রহস্য উন্মোচনের পর এবার দেশীয় পাটের জীবন রহস্যও উদ্ভাবন করে আমাদের দেশের একদল মেধাবী বিজ্ঞানী। প্রয়াত বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম ও তার দল তোষা পাটের জীবন রহস্য উন্মোচন করে ২০১০ সালে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১২ সালে উন্মোচন করেন ছত্রাকের জীবন রহস্য এবং সর্বশেষ তারই নেতৃত্বে একদল বিজ্ঞানী এবার দেশীয় পাটের জীন রহস্য উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়। পাটের এই জিন নকশা (জিনোম সিকোয়েন্সি) উদ্ভাবনের ফলে এ সংক্রান্ত গবেষণায় পূর্ণতা পায় বাংলাদেশ। অর্থাৎ পাট বললেই এবার বাংলাদেশকে বোঝাবে। পাট কথাটি উচ্চারণের সাথে সাথে বাংলাদেশ কথাটি চলে আসবে।
প্রথমে তোষা পাট এরপর পাটের জন্য ক্ষতিকর ছত্রাক এবং সবশেষ দেশীয় পাটের জীন রহস্য উদ্ভাবন করায় উন্নত জাতের পাট উৎপাদনের ক্ষেত্রে আরও একধাপ এগিয়ে যায় বাংলাদেশ। এসবের স্বত্ব বা পেটেন্ট পেলে বিশ্বের যে কোনো স্থানে এ সংক্রান্ত গবেষণার জন্য অর্থ পাবে বাংলাদেশ। এই উদ্ভাবনের ফলে বাংলাদেশের মর্যাদাও বৃদ্ধি পাবে বহির্বিশ্বে। বলতে গেলে পাট নিয়ে এক অমিত সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ। সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এ সংক্রান্ত উদ্ভাবনকে বাস্তবে রূপ দিতে পারলে পাটই বদলে দেবে বাংলাদেশকে।
আমাদের দেশে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে যত বেশি আলোচনা হয় তার কিয়দশংও যদি অন্যান্য ক্ষেত্র বিশেষ করে গবেষণা সংক্রান্ত বিষয়ে সাফল্যের জন্য হতো তাহলে গবেষণা ক্ষেত্রটা এগিয়ে যেত। আমরা কথায় কথায় দেশের কথা বলি। কিন্তু ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতে পারি না। তাই পাটের ব্যবহার বৃদ্ধির জন্য সরকার উদ্যোগ নিলেও ব্যক্তি স্বার্থে তার বিরোধিতা করি। নানা কূটকৌশল খুঁজি। যাতে আখেরে নিজেরই ক্ষতি। পাটের সোনালি দিন ফিরিয়ে আনতে হলে সত্যিকার দেশপ্রেমিক নাগরিকের এই আত্মোপলব্ধি আজ অত্যন্ত জরুরি।
জীন রহস্য উদ্ভাবন করেই থেমে নেই বিজ্ঞানীরা। উন্নত জাতের পাট কী করে অতি দ্রুত কৃষকের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়, সে লক্ষ্যেও কাজ করছেন তারা। এক ধরনের ছত্রাকের কারণে পাটের খুব ক্ষতি হয়। সেই ছত্রাকের জীন রহস্যও উদ্ভাবন করা হয়েছে। এছাড়া লবণাক্ত পানিতে কী করে পাট চাষ করা যায়, এজন্য লবণাক্ততা সহনশীল পাটের জাত উদ্ভাবনের চেষ্টা চলছে। বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন, পাটের জাতের মধ্যে এমন বৈশিষ্ট্যগুলো যুক্ত করা দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে যার চাহিদা রয়েছে। দেশের বস্ত্র শিল্পে কাপড় তৈরির উপযোগী সুতা বর্তমানে পাট থেকে উৎপাদন পাওয়া যাচ্ছে না। বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন পাটের আঁশ আরও শক্ত এবং সূক্ষ্ম করা যায় কি না। এটি করা গেলে বস্ত্র শিল্পের জন্য উন্নতমানের সুতা পাট থেকেই পাওয়া সম্ভব হবে।
বাংলাদেশকে এক সময় সোনালি আঁশের দেশ বলা হতো। এর কারণ বাংলাদেশের পাটের বিশ্বময় সুখ্যাতি। এছাড়া বৈদেশিক আয়ের সিংহভাগ আসত পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি থেকে। সেই পাটের সোনালি দিন ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। এজন্য পাটের সোনালি দিন ফিরিয়ে আনতে হলে বহুমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। বড় পাটকলের চেয়ে পাটজাত পণ্য তৈরি করতে পারে এমন ছোট ছোট শিল্পের সম্ভাবনা বেশি। কাজেই এ বিষয়টিও খতিয়ে দেখতে হবে। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশকে শক্ত অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে হলে কৃষির ওপর ভর করেই তা করতে হবে। সেজন্য অন্যতম কৃষিপণ্য পাটের প্রতি মনোযোগ দিতে হবে। পাটের সুদিন ফিরে এলে বহু মানুষ তাতে উপকৃত হবে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনও বৃদ্ধি পাবে।
বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এখানে অধিকহারে খাদ্য উৎপাদন করতে গিয়ে সরকারকে হিমশিম খেতে হয়। ধানের বেশ কিছু উন্নততর জাত উদ্ভাবন, ফসল ও বীজ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ ইত্যাদির মাধ্যমে ফসল উৎপাদন উল্লেখযোগ্যহারে বৃদ্ধি পেলেও বিভিন্ন ধরনের রোগবালাইয়ের কারণে ফসলের উৎপাদন প্রতি বছর আশানুরূপ হয় না। এ প্রেক্ষাপটে পাটের জন্য ক্ষতিকারক ছত্রাকের জীবনরহস্য উন্মোচনের ঘটনাটি ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বিজ্ঞানীদের বর্তমান সাফল্য চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সরকারকে এ বিষয়ে আরও সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। জৈব প্রযুক্তি এবং জিনোম গবেষণার মাধ্যমে উৎপাদিত পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজার অনেক বড়। স্বত্ব বা পেটেন্ট প্রতিষ্ঠা করা গেলে ওই বাজারে প্রবেশ করতে পারলে বাংলাদেশের চেহারাই পাল্টে যাবে। কারণ জিনোম গষেণার মাধ্যমে উৎপাদিত পণ্যের বাজারটি কমপক্ষে এক ট্রিলিয়ন (এক লাখ কোটি) ডলারের। জিনোম গবেষণার ফলাফলকে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় নিয়ে যেতে পারলে সেটি আরও কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা যে এনজাইমটির জীবন প্রক্রিয়া জানতে পেরেছে তা বিশ্বের এনজাইম বাজারের ২০ শতাংশ মেটায়। স্বত্ব পেলে কয়েক হাজার কোটি টাকার ওই বাজারেও অংশ নিতে পারবে বাংলাদেশ। ছত্রাকের ওপর যে স্বত্ব দাবি করছে বাংলাদেশ সেটি পেলে বিশ্বের যে যেখানে ওই বিষয় নিয়ে গবেষণা করবেন তাদের বাংলাদেশকে স্বত্ব বাবদ অর্থ দিতে হবে। ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতির চেহারাই পাল্টে যাবে। বাংলাদেশের গবেষণা ক্ষেত্রটি এখনো অনেকটাই সীমিত। গবেষণা খাতে বরাদ্দও কম। এরপরও সীমিত সাধ্যের মধ্যেই বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা যে সাফল্য দেখাচ্ছেন সেটি অবশ্যই সাধুবাদযোগ্য। বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কারে এই যুগে সারাবিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে আমাদেরও গবেষণা ক্ষেত্র আরও বাড়াতে হবে। সেক্ষেত্রে পাট গবেষণায় বাংলাদেশ যে সাফল্য দেখিয়েছে সেটি আরও এগিয়ে নিতে হবে।
আমাদের অর্থের কমতি থাকতে পারে; কিন্তু মেধাবী এবং দেশের জন্য কাজ করার মানুষের যে অভাব নেই সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। আমাদের দেশে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে যত বেশি আলোচনা হয় তার কিয়দশংও যদি অন্যান্য ক্ষেত্র বিশেষ করে গবেষণা সংক্রান্ত বিষয়ে সাফল্যের জন্য হতো তাহলে গবেষণা ক্ষেত্রটা এগিয়ে যেত। আমরা কথায় কথায় দেশের কথা বলি। কিন্তু ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতে পারি না। তাই পাটের ব্যবহার বৃদ্ধির জন্য সরকার উদ্যোগ নিলেও ব্যক্তি স্বার্থে তার বিরোধিতা করি। নানা কূটকৌশল খুঁজি। যাতে আখেরে নিজেরই ক্ষতি। পাটের সোনালি দিন ফিরিয়ে আনতে হলে সত্যিকার দেশপ্রেমিক নাগরিকের এই আত্মোপলব্ধি আজ অত্যন্ত জরুরি।