প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ০৪ অক্টোবর, ২০২৫
ওয়াশিংটনে হোয়াইট হাউসে গত সোমবারের বৈঠকের পর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু একসঙ্গে দাঁড়িয়ে বললেন- গাজাযুদ্ধ থামাতে তারা ‘ঐতিহাসিক’ একপথ বের করেছেন। ট্রাম্পের ভাষায়, তারা শান্তির দিকে ‘খুব কাছাকাছি’। কিন্তু সেই উচ্ছ্বাসের আড়ালে রয়ে গেল কিছু ভারী অনিশ্চয়তা। প্রস্তাবটি ঘোষণার মুহূর্তে আলোচনায় ছিল না হামাস; তাদের মতামত জানা ছিল না। পরে কাতার ও মিশরের মধ্যস্থতায় এই ২০ দফা পরিকল্পনা হামাসের হাতে পৌঁছায় আর তারা জানায়- প্রস্তাবটি ‘সৎভাবে’ পর্যালোচনা করবে। এদিকে মঞ্চে থাকা দুই নেতা স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, এটি কোনো ‘ওপেন-এন্ডেড’ প্রস্তাব নয়; হামাস না মানলে ‘পরিণতি’ আছে।
হোয়াইট হাউসের নথি বলছে, পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি, হামাসের হাতে থাকা জিম্মিদের মুক্তি এবং তার বিনিময়ে ইসরায়েলে আটক ফিলিস্তিনি বন্দিদের মুক্তি। ধাপে ধাপে ইসরায়েলি সেনা গাজা থেকে সরে আসবে। হামাসকে নিরস্ত্র করতে হবে, টানেল-অস্ত্র-কারখানা ধ্বংস হবে। যুদ্ধ-পরবর্তী অন্তর্বর্তী প্রশাসন চালাবে রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ এক ফিলিস্তিনি ‘প্রযুক্তিবিদ নেতৃত্ব’; তবে এ নেতৃত্ব জনগণ বেছে নেবে না- দেখভাল করবে এক আন্তর্জাতিক সংস্থা, নাম ‘বোর্ড অব পিস’। ট্রাম্প নিজেই বললেন, এ বোর্ডের চেয়ারম্যান হবেন তিনি। টনি ব্লেয়ার যোগ দিতে আগ্রহী সেটিও জানালেন তিনি। ট্রাম্পের কথা, ‘এটা অতিরিক্ত কাজ, তবু এত গুরুত্বপূর্ণ যে, আমি দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত।’
পরিকল্পনার ভাষায়, যারা ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান’-এ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, সেই হামাস সদস্যদের জন্য আছে ক্ষমা ও গাজায় থাকার পথ; কেউ গেলে নিরাপদে যেতে ও ফিরতে পারবে- ‘কাউকে জোর করে তাড়ানো হবে না।’ একইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, আরব দেশ ও অংশীদাররা মিলে নিরাপত্তা দেখবে এক আন্তর্জাতিক ‘স্টেবিলাইজেশন ফোর্স’ বা আইএসএফ, যারা ইসরায়েল ও মিশরের সঙ্গে সীমান্ত নিরাপত্তায় কাজ করবে এবং নতুন প্রশিক্ষিত ফিলিস্তিনি পুলিশ বাহিনীকে সহযোগিতা দেবে। ট্রাম্প মাঝেমধ্যেই যে ‘মধ্যপ্রাচ্যের রিভিয়েরা’র স্বপ্ন দেখিয়েছেন, যাকে ঘিরে সমালোচনা উঠেছিল- নতুন নথিতে বলা হলো, বিশেষজ্ঞ প্যানেল গাজা পুনর্গঠনের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা করবে; কিন্তু ‘কাউকে জোর করে গাজা ছাড়তে হবে না’।
এসবের মাঝেই ফাঁস হওয়া ২১ পৃষ্ঠার খসড়ায় উঠে এসেছে আরেকটি স্পর্শকাতর দিক: যুদ্ধ-পরবর্তী গাজা প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক মুখগুলোকে পাশ কাটিয়ে দেওয়া হতে পারে আর বোর্ডের চেয়ারম্যানের হাতে থাকবে বিস্তৃত ক্ষমতা। পরিকল্পনার এ অংশটুকুই সবচেয়ে বড় বিতর্ক তৈরি করেছে- কে সিদ্ধান্ত নেবে গাজার ভবিষ্যৎ গাজার মানুষ, নাকি বাইরের বোর্ড?
ট্রাম্প বললেন, ‘হামাস যদি মানে, ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সব জিম্মি ফেরত আসবে।’ নেতানিয়াহুর উত্তর, ‘আমি আপনার পরিকল্পনাকে সমর্থন করি; এটি আমাদের যুদ্ধ-লক্ষ্য পূরণ করবে- জিম্মিরা ফিরবে, হামাসের সামরিক সক্ষমতা আর রাজনৈতিক শাসন শেষ হবে, গাজা আর কখনো ইসরায়েলের জন্য হুমকি হবে না।’ কিন্তু কৌশলগত জায়গায় তিনি ভিন্ন সুর তুললেন, ‘ইসরায়েল নিরাপত্তার দায়িত্ব রাখবে, একটি নিরাপত্তাঘেরা পরিধি থাকবে দীর্ঘ সময়। গাজায় বেসামরিক প্রশাসন চলবে, তবে তা হবে না হামাস বা ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের হাতে।’ ট্রাম্প-প্রস্তাবে দীর্ঘমেয়াদে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের জন্য কিছু পথ রাখার কথা থাকলেও নেতানিয়াহু বহুদিন ধরেই ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিরোধী; তার রাজনৈতিক জীবনের বেশিরভাগ সময়ে এ অবস্থান স্পষ্ট। এদিকে জাতিসংঘে কিছু পশ্চিমা দেশ সম্প্রতি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে সমর্থন জানিয়েছে, যা ওয়াশিংটন ও তেল আবিবের অবস্থানের সঙ্গে যায় না। ফলে বোঝাই যায়, ‘রাষ্ট্র’-প্রশ্নে এখনও গভীর ফাঁক রয়ে গেছে।
এ প্রেক্ষাপটে নেতানিয়াহুর দেশীয় রাজনীতিও কম জটিল নয়। জিম্মি পরিবারের চাপ, জনমত আর জোট-রাজনীতির টানাপড়েন তার হাত বাঁধা রাখছে। অতি ডানপন্থি অংশীদাররা মনে করেন, বেশি ছাড় দেওয়া হচ্ছে, যে কোনো মুহূর্তে জোট নড়বড়ে হতে পারে। এ বাস্তবতায় তিনি একদিকে ট্রাম্পকে ‘বন্ধু’ বলে ধন্যবাদ দিচ্ছেন, অন্যদিকে ‘সিকিউরিটি পেরিমিটার’-এর মতো শর্তজুড়ে দিয়ে মাঠ নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখছেন।
দুই নেতা প্রশ্নোত্তরে যাননি। বরং বার্তা দিয়েছেন সোজাসাপ্টা। ট্রাম্প বললেন, ‘হামাস যদি না মানে তোমাদের যা করার করতে হবে, আমাদের পূর্ণ সমর্থন থাকবে।’ নেতানিয়াহু যোগ করলেন, ‘সহজ পথেও হতে পারে, কঠিন পথেও হতে পারে; কিন্তু কাজটা হবেই।’ আলজাজিরার মাইক হান্নার পর্যবেক্ষণ, এটি মূলত এক ‘গ্রিন সিগন্যাল’ হামাস না মানলে গাজায় ইসরায়েলি অভিযানে নতুন গতি আসতে পারে। মারওয়ান বিশারার ভাষায়, প্রস্তাবটি হামাসের কাছে ‘আত্মসমর্পণের’ সমান লাগবে।
ওয়াশিংটনভিত্তিক ফিলিস বেনিস বলছেন, ‘ফিলিস্তিনিদের স্বার্থরক্ষার নিশ্চয়তা এখানে দুর্বল; যে কোনো মুহূর্তে ইসরায়েল বলতেই পারে সহযোগিতা মিলছে না, তাই আবার যুদ্ধ।’ গাজার সাংবাদিক তারেক আবু আজজুম জানালেন, মানুষ যুদ্ধবিরতির আশায় আছে, বন্দিবিনিময়-সেনা প্রত্যাহার চায়; কিন্তু শর্তগুলো বাস্তবায়নের গ্যারান্টি দেখতে পাচ্ছে না।
এই কূটনীতির ফাঁকে ফাঁকে যুদ্ধ চলছে। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ইসরায়েলি ট্যাংক গাজার শহরভাগে আরও ভেতরে ঢুকেছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলায় প্রায় ১ হাজার ২০০ ইসরায়েলি নিহত হয়, ২৫১ জনকে জিম্মি করা হয়। ইসরায়েলের হিসাবে এখনো ৪৮ জন জিম্মি আছে, তাদের মধ্যে ২০ জন জীবিত। গাজার স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ বলছে, ইসরায়েলি অভিযানে এখন পর্যন্ত ৬৬ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত, আহত হয়েছে লাখের বেশি। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে শহর; হাসপাতাল-স্কুল সব ভগ্নচিহ্ন। এ প্রেক্ষাপটে ট্রাম্পের ‘রিভিয়েরা’ কল্পনা যেমন বিতর্ক টানে, তেমনি নতুন নথিতে ‘কাউকে জোর করে সরানো হবে না’ এ বাক্যটিও মানুষের মনে আশার ক্ষীণ রেখা টানে।
এর মাঝেই আরেকটি স্পর্শকাতর খবর, দোহায় হামাস নেতাদের লক্ষ্য করে ইসরায়েলি হামলায় কাতারের এক সৈনিক নিহত হওয়ায় নেতানিয়াহু কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আবদুল রহমান আল-থানির কাছে ফোনে দুঃখপ্রকাশ করেছেন- ট্রাম্পের ভাষায়, এটি ছিল এক ‘হার্ট-টু-হার্ট’ আলাপ। হোয়াইট হাউস বলেছে, ইসরায়েল কাতারের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের জন্য দুঃখিত, ভবিষ্যতে এমন হামলা না করার প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছে। নেতানিয়াহু নিজেও বলেছেন, ‘টার্গেট ছিল সন্ত্রাসীরা, কাতার ছিল না।’ আরেক প্রান্তে, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নেতানিয়াহুর মাথার ওপর ভাসছে- যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে, যার মধ্যে ‘ক্ষুধাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার’-এর মতো মারাত্মক অভিযোগও আছে। এই সব মিলে তার কূটনৈতিক খেলায় চাপ বাড়ছে।
লেখক : সাংবাদিক