ঢাকা শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

নিষ্ক্রিয় বিশ্ব, অনিশ্চিত রোহিঙ্গারা

ফাহিম হাসনাত
নিষ্ক্রিয় বিশ্ব, অনিশ্চিত রোহিঙ্গারা

রোহিঙ্গাসংকট আজ এক বৈশ্বিক মানবিক বিপর্যয়ের নীরব; কিন্তু ভয়াবহ প্রতিচ্ছবি। ২০১৭ সালে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সংঘটিত বর্বরোচিত সহিংসতা ও গণহত্যার শিকার হয়ে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমান প্রতিবেশী বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। এই বিশাল বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ শুধু তার মানবিক দায়িত্বই পালন করেনি, বরং পৃথিবীর সামনে এক বিরল উদারতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তবে, এই সংঘাতময় ঘটনার আট বছর পেরিয়ে গেলেও তাদের দুর্দশার কোনো স্থায়ী সমাধান হয়নি। সময়ের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে প্রাপ্ত মানবিক সহায়তা ক্রমাগত কমে আসছে, ফলে এই বিপুলসংখ্যক মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের ভার এককভাবে বাংলাদেশের কাঁধেই চেপে বসছে। সবকিছু মিলিয়ে বাংলাদেশ একাই বিশাল সংখ্যক রোহিঙ্গাদের বোঝা বইছে, বিশ্ব শুধু দর্শকের ভূমিকা পালন করছে।

এই পরিস্থিতি মানবিক দিক থেকে যেমন করুণ, তেমনি আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্যও তা এক মারাত্মক জটিলতা সৃষ্টি করেছে। তবে, বাংলাদেশের ওপর এই চাপ ক্রমশ কঠিন হয়ে ওঠায় আন্তর্জাতিক মঞ্চে রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধানের প্রয়োজনীয়তা আরও জোরালো হয়েছে। সম্প্রতি জাতিসংঘ সদর দপ্তরে এই বিষয়ে আয়োজিত এক উচ্চপর্যায়ের সম্মেলনে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস যে সাত দফা প্রস্তাব দিয়েছেন, তা এই সমস্যার টেকসই সমাধানে এক বাস্তবসম্মত দিকনির্দেশনা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

তার মূল প্রস্তাবগুলোর মধ্যে রয়েছে- নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের জন্য সুস্পষ্ট রূপরেখা প্রণয়ন, রাখাইনে স্থিতিশীলতা সৃষ্টিতে আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ানো, রোহিঙ্গাদের সামাজিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা, দাতাদের প্রতিশ্রুত অর্থ দ্রুত প্রদান, জবাবদিহি ও ন্যায়বিচারের ব্যবস্থা করা এবং মাদক ও আন্তঃসীমান্ত অপরাধ দমন।

একই সম্মেলনে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসও তিনটি মৌলিক বিষয়ে জোর দিয়েছেন। বেসামরিক মানুষের সুরক্ষা নিশ্চিত করা, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে মানবিক সহায়তা প্রবাহে কোনো বাধা না দেওয়া এবং শরণার্থীদের আত্মনির্ভরশীল করে তুলতে জোরালো উন্নয়ন বিনিয়োগ করা। তবে, এত আন্তর্জাতিক আহ্বান ও প্রস্তাবের পরও প্রধান প্রশ্নটি থেকেই যায়, বাস্তবে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার ওপর আন্তর্জাতিক চাপ কেন কার্যকর হচ্ছে না?

রোহিঙ্গা সংকটের গোড়ায় রয়েছে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, যা শত বছর ধরে একটি জনগোষ্ঠীকে নাগরিকত্ব ও মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে। বাংলাদেশ শুরু থেকেই এই সত্যটি তুলে ধরেছে, রোহিঙ্গা সংকটের উৎস মিয়ানমার এবং সমাধানও তাদের কাছেই। রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ দেশে স্বেচ্ছায়, নিরাপদে এবং মর্যাদার সঙ্গে ফেরত পাঠানো ছাড়া এই সমস্যার কোনো টেকসই সমাধান নেই।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এখনও কার্যকরভাবে মিয়ানমার সরকার এবং আরাকান আর্মিকে একটি বিশ্বাসযোগ্য আলোচনা ও প্রত্যাবাসনের টেবিলে আনতে পারেনি। বরং লক্ষ্য করা যাচ্ছে, এক ধরনের কূটনৈতিক শৈথিল্য, যেখানে ভিন্ন ভিন্ন ভূরাজনৈতিক স্বার্থের কাছে মানবিকতা পিছু হটছে। প্রভাবশালী আঞ্চলিক শক্তিগুলো তাদের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থ রক্ষার জন্য মিয়ানমারের জান্তা সরকারের ওপর কঠোর চাপ প্রয়োগে অনীহা দেখাচ্ছে। এই দুর্বলতা সামরিক জান্তাকে দায়মুক্তির সুযোগ দিচ্ছে, ফলে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বারবার বিলম্বিত হচ্ছে। একইসঙ্গে, মানবিক সহায়তা তহবিলে ঘাটতি এবং প্রতিশ্রুত অর্থ না দেওয়ার প্রবণতাও এই সংকটকে আরও গভীর করেছে।

এইভাবে চলতে থাকলে রোহিঙ্গা সংকট শুধু বাংলাদেশের মানবিক উদ্বেগের কারণ থাকবে না, এটি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্যও মারাত্মক এক হুমকিতে রূপ নেবে। বিশাল শরণার্থী শিবিরে হতাশা ও অনিশ্চয়তা জন্ম দিচ্ছে মাদকপাচার, মানবপাচার এবং আন্তঃসীমান্ত অপরাধের মতো চ্যালেঞ্জ, যা স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় নিরাপত্তার জন্যেই বিপজ্জনক। তাই এখন প্রয়োজন শুধু সম্মেলনের বক্তব্য বা উচ্চাকাঙ্ক্ষী ঘোষণায় সীমাবদ্ধ না থেকে বাস্তব, দৃঢ় এবং সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তার ঐতিহাসিক দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।

প্রথমত, মিয়ানমারের ওপর সর্বাত্মক ও সুনির্দিষ্ট চাপ বাড়াতে হবে। শুধু কূটনৈতিক বার্তা নয়, অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও সামরিক সবধরনের কঠোরব্যবস্থা নিতে হবে। সামরিক জান্তা ও তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর টার্গেটেড নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে এবং মিয়ানমারে অস্ত্র সরবরাহ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতে হবে।

দ্বিতীয়ত, জবাবদিহি ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা আবশ্যক। ২০১৭ সালের গণহত্যার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের সম্মুখীন করার জন্য চাপ অব্যাহত রাখতে হবে।

তৃতীয়ত, মানবিক সহায়তা ও দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ওপর অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত চাপ কমাতে বড় আকারের অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা অপরিহার্য।

রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে সসম্মানে ও নিরাপদে ফিরিয়ে নেওয়াই এই সমস্যার একমাত্র টেকসই সমাধান। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই বুঝতে হবে যে, বাংলাদেশের একার পক্ষে এই বিশাল বোঝা বহন করা অসম্ভব। এখন প্রয়োজন দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং এক অভূতপূর্ব আন্তর্জাতিক ঐক্য, যা মিয়ানমারকে বাধ্য করবে, তার নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে, যাতে ইতিহাসের এই করুণ অধ্যায়ের চূড়ান্ত সমাপ্তি ঘটে। এই মুহূর্তে নিষ্ক্রিয়তা মানে একটি মানবিক বিপর্যয়কে চিরস্থায়ী হতে দেওয়া।

লেখক : রিপোর্টার, বাংলা এডিশন

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত