ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ডেঙ্গুর তীব্রতা : প্রয়োজন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সমন্বিত পদক্ষেপ

ড. মো. আনোয়ার হোসেন
ডেঙ্গুর তীব্রতা : প্রয়োজন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সমন্বিত পদক্ষেপ

এ সময় সর্বাধিক যে রোগটি আমাদের ভীতির কারণ হয়ে সামনে এসেছে, তা হলো ডেঙ্গু। যার বাহক এডিস ইজিপ্টাই এবং এডিস এলবোপিকটাস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিশটি অবহেলিত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রোগের অন্যতম একটি রূপে ডেঙ্গু নির্ণয় করেছে। ডেঙ্গু জ্বর একটি এডিস মশা বাহিত ডেঙ্গু ভাইরাস জনিত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রোগ। এ রোগে জ্বরের তীব্রতা বেশি থাকার কারণে, রোগটিকে হাঁড়ভাঙা জ্বরও বলা হয়। 

বাংলাদেশ আবহাওয়া বিভাগের দৃষ্টিতে রোদ ও বৃষ্টির মধ্যে কেটে যাবে অক্টোবরের বাকি দিনগুলো। কোনো দিন থাকতে পারে কড়া রোদ, আবার হঠাৎ ঝমঝম বৃষ্টিতে রাস্তায় হাঁটু পানিতে হাঁটতে হতে পারে। কিছু কিছু বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা আছে পুবালী ও পশ্চিমা বায়ুর সংমিশ্রণে। থেমে থেমে বৃষ্টি হলে ডেঙ্গু জীবাণুবাহী এডিস মশার বংশ বৃদ্ধির আশঙ্কা থাকবে। এরইমধ্যে কীটতত্ত্ববিদরা পূর্বাভাস দিয়েছেন, এ মাসে ডেঙ্গুর প্রকোপ আরও বাড়বে। ডেঙ্গু অবশ্য এখন আর নির্দিষ্ট মৌসুমের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এই রোগটি এখন বাংলাদেশে সারা বছরের রোগে পরিণত হয়েছে। ফলে আগামী অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্য্ন্ত পুরো তিন মাসেই ডেঙ্গু থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশে এরইমধ্যে ডেঙ্গু তার বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করেছে। এই রোগটি শহুরে রোগ হিসেবে পরিচিত হলেও এটা এখন গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে এবং এখন থেকে সারা বছর গ্রামেও রোগী মিলবে। বাংলাদেশের আবহাওয়ায় কিছুটা পরিবর্তনের কারণেই এমনটা হয়েছে বলে কীটতত্ত্ববিদরা মনে করেন।

পাঁচ অক্টোবর রোববার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তৃক গণমাধ্যমে প্রেরিত এক বিবৃতি অনুযায়ী, ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে অন্তত ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন আরও কমপক্ষে ১০৪২ জন, চলতি বছর যা একদিনে সর্বোচ্চ বলে জানা যাচ্ছে। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকাতেই ডেঙ্গুতে সাতজন মারা গেছেন। এছাড়া ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন একজন এবং চট্টগ্রাম বিভাগে একজন প্রাণ হারিয়েছেন। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গুতে ২১২ জনের প্রাণ গেল। অন্যদিকে, আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে প্রায় ৫০ হাজার ছুঁতে চলেছে। যা খুবই উদ্বেগ জনক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।

ডেঙ্গুকে বলা হতো শহুরে রোগ। দুই যুগের বেশি সময় ধরে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ ও রোগী ব্যবস্থাপনার বড় পরিকল্পনা ছিল রাজধানী ঘিরে। তবু রোগটি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়নি। ঠেকানো যায়নি রাজধানীতে ডেঙ্গুর প্রকোপ। এই ডেঙ্গু এখন শহরের সীমানা পেরিয়ে পৌঁছে গেছে গ্রামে-গঞ্জে। প্রতি বছরের মতো এ বছরও মশাবাহিত রোগটি হানা দিয়েছে। জুনের পর থেকে বাড়তে শুরু করেছে শনাক্তের হার। ঢাকার চেয়ে বাইরের জেলাগুলোতেই এ বছর সংক্রমণ বেশি। এরই মধ্যে অন্তত ১০ জেলায় ডেঙ্গুর উচ্চ সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। বিশেষ করে বরিশাল বিভাগে ডেঙ্গুর প্রকোপ এবার আশঙ্কাজনক রূপ নিয়েছে। রাজধানীর দুই সিটি কর্পোরেশনের চেয়ে এক বরগুনাতেই রোগীর সংখ্যা বেশি। এ বছর শনাক্ত রোগীর অন্তত প্রায় ৮০ শতাংশই ঢাকার বাইরের। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত বেশি বরিশালে, মৃত্যু ঢাকায়। আক্রান্তদের মাঝে বেশিরভাগই পুরুষ। বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন ১৬ থেকে ২৫ বছর বয়সীরা। এ পর্যন্ত যারা ডেঙ্গুতে মারা গেছেন, তাদের অর্ধেকই ঢাকার মহানগরের দক্ষিণাঞ্চলের।

তবে রাজধানীর সরকারি-বেসরকারি প্রায় ৮৭টি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসাব্যবস্থা থাকলেও রাজধানীর বাইরে ডেঙ্গু মোকাবিলায় জরিপ, পর্যাপ্ত প্রস্তুতি, সক্ষমতা কিংবা জনবল নেই। জেলা ও উপজেলা সরকারি হাসপাতালের সামান্য শয্যা আর স্বল্প বাজেটের সীমিত জনবলেই চলছে ডেঙ্গুর মোকাবিলা। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য খাতে বড় বিপর্যয় দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, যদি গ্রামীণ বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চঝুঁকির জেলাগুলোকে ঘিরে প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা নেওয়া না হয়, তাহলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। ঢাকার বাইরে বড় জনগোষ্ঠীকে আরও অন্তত তিন দশক ধরে ভোগান্তি পোহাতে হতে পারে।

সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘ঢাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরু হয় ২০০০ সাল থেকে। এরপর গত ২৫ বছরে আমরা ঢাকায় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। আরও যে কত বছর লাগবে, সেটাও জানা নেই। ঢাকার বাইরে পাঁচগুণ মানুষের বসবাস। অথচ ঢাকার বাইরে মশা নিয়ন্ত্রণে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। অন্তত উচ্চ সংক্রমণের ১০ জেলা ঘিরে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের মহাপরিকল্পনা এখনই গ্রহণ না করলে ধারণা করা হয়, ঢাকার বাইরের ডেঙ্গু আগামী ৩০-৪০ বছর আমাদের ভোগান্তিতে ফেলবে। এটা খুব সহজে অনুমান করা যায়।’

ঢাকার বাইরে চার এলাকা ডেঙ্গুর উচ্চঝুঁকিতে। ঢাকার বাইরে চার পৌর এলাকায় এডিস মশার উপস্থিতি বেশি পাওয়া যাচ্ছে। এই চার পৌরসভা হলো ঝিনাইদহ, মাগুরা, পিরোজপুর ও পটুয়াখালী। এসব এলাকাকে ডেঙ্গুর উচ্চঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত করেছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) সংশ্লিষ্টরা। জরিপ করতে প্রতিটি এলাকায় ৯ ওয়ার্ডে ২১৪টি বাড়ি পরিদর্শন করা হয়। এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব পরিমাপের স্বীকৃত পদ্ধতি হলো ‘ব্রুটো ইনডেক্স (বিআই)’। এই মানদ-ে লার্ভার ঘনত্ব ২০ শতাংশের বেশি হওয়া মানে সেখানে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হয়। এ ছাড়া হাউস ইনডেক্স ১০-এর বেশি হলে ঝুঁকিপূর্ণ বলা হয়।

জরিপে দেখা গেছে, ঝিনাইদহ পৌর এলাকায় ব্রুটো ইনডেক্স ৬০ শতাংশ। এরপর মাগুরায় ৫৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ, পিরোজপুরে ২০ শতাংশ ও পটুয়াখালীতে ১৯ দশমিক ২৬ শতাংশ, কুষ্টিয়ায় ৭ দশমিক ৮৭ শতাংশ। তিন সিটি কর্পোরেশন এলাকার মধ্যে চট্টগ্রামে ৫ দশমিক ৬২ শতাংশ, রাজশাহীতে ৪ দশমিক ৭৯ শতাংশ ও বরিশালে ২ দশমিক ৫ শতাংশ।

বরিশাল বিভাগে, প্রধানত বরগুনায় এত ডেঙ্গু রোগী কেন? এ বছর ডেঙ্গু সংক্রমণের হার বরিশাল বিভাগের বরগুনা জেলায় সর্বোচ্চ। বরগুনা সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক বিবিসিকে জানিয়েছেন, তারা ‘সক্ষমতার বাইরে গিয়ে রোগীর চাপ সামলাতে প্রাণপণ চেষ্টা’ করছেন। তিনি বলেন, হাসপাতালটিতে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য বরাদ্দ বেডের সংখ্যা শুধু ৫০টি হলেও এই মুহূর্তে সেখানে মোট পাঁচ শতাশিক ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছেন।’ এমার্জেন্সিতে অনেকেই আসছেন, ডেঙ্গু পজেটিভ পাচ্ছি। যে বাসায় একজন সদস্য ডেঙ্গুতে আক্রান্ত, ওই বাসায় প্রায় প্রত্যেক সদস্যরই ডেঙ্গু, বলেন তিনি।

হাসপাতালে যারা আসছেন, তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ‘বাড়ি পাঠানো হচ্ছে’ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সক্ষমতা তো থাকতে হবে। হাসপাতালের কোথাও তিল ধারণের ঠাঁই নাই।’ তাই, যারা তুলনামূলক একটু সুস্থ, তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হচ্ছে না।’ এরকম একটা প্রত্যন্ত অঞ্চলে ডেঙ্গুর এত প্রকোপ কল্পনাও করা যায় না, বলেন এই চিকিৎসক। তবে, জেলায় এত বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার কারণ হিসেবে বরগুনায় ব্যাপক জলাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করেন তিনি।’ এ জেলার চারপাশে নদী। কিন্তু ফ্লোয়িং ওয়াটারে তো লার্ভা থাকে না। কিন্তু এখানে জলাবদ্ধতাও প্রচুর। বাড়ির আঙিনা থেকে শুরু করে সব জায়গায় ময়লা-আবর্জনা, পানি জমা থাকে, বলেন তিনি।

তিনি বলছেন, ‘সময়মতো সঠিকভাবে মশার ওষুধ ছিটানো হলে এবং পৌর শহরটা যদি আরও পরিচ্ছন্ন থাকত, তাহলে পরিস্থিতি এই পর্যায়ে যেত না।’ আর যেসব মশার ওষুধ ছিটানো হচ্ছে, তার কার্যকারিতা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেন তিনি। তিনি জানান, বরগুনার সবাই এখন ডেঙ্গু নিয়ে ব্যস্ত। এদিকে, বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক ডেঙ্গুর বিষয়ে বিবিসিকে জানান, ‘গতবার থেকেই ওখানে ডেঙ্গু রোগী বেশি, এবার আরও বেশি।’ কারণ হিসাবে তিনি জানান, ওই এলাকায় থেকে নমুনা নিয়ে দেখা গেছে, যে সেখানে এডিস মশা আছে। তার মতে, বাংলাদেশকে যেহেতু প্রতিবছরই ডেঙ্গু সংক্রমণের মুখোমুখি হতে হয়, তাই এক্ষেত্রেও এ দেশের চিকিৎসকরা অভ্যস্ত।

বাংলাদেশে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না হওয়ার কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে মশা নিয়ন্ত্রণের সমন্বয়হীনতা, জনসচেতনতা ও জনঅংশগ্রহণের অভাব, অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং জলবায়ু পরিবর্তন। বাংলাদেশে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে ডেঙ্গুর কোনো টিকা ব্যবহার করা হয় না। মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতা দেখা যায়। সঠিক পরিকল্পনা ও কার্যকর ব্যবস্থাপনারও অভাব রয়েছে।

বাংলাদেশে টিকা অনুমোদনের বিষয়টি বর্তমানে বিবেচনাধীন আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর অনুমোদন এবং তাদের নিজস্ব দেশের (যেমন বাংলাদেশ) পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এই ঝুঁকিগুলো বিবেচনা করে, বাংলাদেশে ডেঙ্গুর টিকা অনুমোদিত না হওয়া পর্যন্ত, ডেঙ্গু প্রতিরোধে মশা নিধন এবং মশার কামড় থেকে নিজেকে বাঁচানোর উপর জোর দেওয়া উচিত। তাই মশার আবাসস্থল ধ্বংস করে মশার বংশবিস্তার প্রতিরোধ করতে হবে। এ জন্য এডিস মশার বংশবিস্তারের উপযোগী বিভিন্ন আধারে, যেমন কাপ, টব, টায়ার, ডাবের খোলস, গর্ত, ছাদ ইত্যাদিতে আটকে থাকা পানি অপসারণ করতে হবে। শরীরের বেশির ভাগ অংশ ঢেকে রাখে এমন পোশাক পরিধান করতে হবে।

শত্রুটি হলো- মশা নামক একটি পোকা। একে দমন করতে হলে ঢিলেঢালা পদ্ধতিতে কোনো কাজ হবে না। গ্রহণ করতে হবে সমন্বিত কার্যকর পদক্ষেপ। সব পরিসংখ্যানিক উপাত্ত সামনে রেখে সে অনুযায়ী বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রয়োগই আনবে কাঙ্ক্ষিত সফলতা। প্রাবন্ধিক, কথা সাহিত্যিক এবং প্রেসিডেন্ট আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী সংগঠন ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল এন্টি অ্যালকোহল।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত